এক নক্ষত্রের মহাপ্রয়াণ

সিরাজুল ইসলাম কাদির: ১৯৯৮ সালের শুরুর দিকের কথা। মানবজমিন প্রকাশিত হওয়ার জন্য প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে। আমাদের প্রিয় প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী আমাকে কাজ এগিয়ে রাখতে বললেন  পৃষ্ঠা ১৭ কলাম ১
। নিয়মিত প্রতিবেদন ছাড়াও অর্থনীতির পাতার দায়িত্ব আমার ওপরে। দেশের বিশিষ্ট এবং সফল শিল্পোদ্যোক্তাদের একটি তালিকা করে তাদের সাক্ষাৎকার নিতে বললেন। যাতে পত্রিকা প্রকাশিত হওয়ার পর প্রতি সপ্তাহে একটি করে সাক্ষাৎকার পত্রস্থ করা যায়। আমি প্রথমে স্কয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান স্যামসন এইচ চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু সমস্যা হলো- এত উঁচু দরের শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার তাঁকে কবে নাগাদ হাতের কাছে পাবো। বলতে হবে সৌভাগ্য। টেলিফোন করতেই পেয়ে গেলাম এবং তিনিও স্বাচ্ছন্দ্যে সম্মতি দিলেন। আমাদের আলোকচিত্রী এ হাই স্বপনকে নিয়ে মহাখালীতে স্কয়ারের প্রধান কার্যালয়ে পূর্ব থেকে বেঁধে দেয়া সময়ে আমরা পৌঁছে গেলাম। তিনি আমাদের এক ঘণ্টা সময় দিলেন। একটি চারাগাছ আজ কি করে এই মহীরুহে উন্নীত হয়েছে সেই গল্প শোনালেন আমাদের অবলীলায়- কোন রাখ-ঢাক না করে। তাঁর স্বপ্ন আর মেধা কিভাবে পরিশ্রমের সঙ্গে নিবিড়ভাবে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে সাফল্যের সোনালী আকাশকে স্পর্শ করেছে সেই কাহিনী। বাণিজ্যের বহুমাত্রিকতা কিভাবে একজন মানুষের স্বপ্নকে ব্যক্তি থেকে নৈর্ব্যক্তিক স্তরে উন্নীত করতে পারে সেই কাহিনী আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলাম আর তা যান্ত্রিক ফিতায় বন্দি করলাম- পাছে আমাদের স্মৃতির দুর্বলতার সুযোগে তথ্যের বিভ্রাট ঘটে। তাঁর স্বপ্ন কখনও আকাশকুসুম ছিল না। ছিল এই দেশের মাটি, মানুষ আর প্রকৃতির সঙ্গে সেতুবন্ধনে রচিত। তিনি যেখানে হাত দিয়েছেন সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন। ওষুধ শিল্প, বস্ত্র শিল্প, প্রসাধনী শিল্প এমন কি রান্নার উপকরণ শিল্পেও তাঁর সাফল্যের সোনার কাঠি দেশ-বিদেশের ভোক্তাদের করেছে মন জয়। স্কয়ার ওষুধ শিল্প এক সময় হাঁটি হাঁটি করে এগিয়ে এখন দেশের শীর্ষস্থান দখল করে আছে। ইসলাম ধর্ম হালাল ব্যবসাকে উৎসাহিত করেছে। তিনি অন্য ধর্মপন্থি হওয়া সত্ত্বেও ইসলামের এই মর্মকথা তাঁর ব্যবসায়িক জীবনে অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত করে গেছেন। সততা, ন্যায়পরায়ণতা এবং নৈতিকতার মতো মূল্যবোধগুলোকে তিনি ব্যবসায়িক জীবনে উজ্জ্বল করে রেখেছেন।
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর অন্যতম সাহাবী আবু সায়ীদ নবীকে উদ্ধৃত করে বলেন, ‘সত্যপরায়ণ, ন্যায়নিষ্ঠ এবং বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী শেষ বিচারের দিনে নবীদের, সাধক পুরুষদের এবং শহীদদের সঙ্গী হবেন’। (তিরমিযী)
আমাদের সাক্ষাৎকার পর্বটি এক সময় শেষ হয়ে যায়। আমাদের তিনি লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দেন। আমাদের দু’জনের হাতে কিছু উপহার সামগ্রী তুলে দেন স্নেহের নিদর্শন হিসেবে- যার সবই ছিল তাঁর প্রতিষ্ঠানে তৈরি ব্যবহার্য সামগ্রী।
এই সাক্ষাৎকারের পর তাঁর সঙ্গে আমার পেশাগত জীবনে বহুবার বহু অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎ হয়েছে। আর তিনি সব সময় আমাদের কুশল জানতে ছিলেন আগ্রহী। জানতে চাইতেন- কাগজ কেমন চলছে। প্রতি বছর বাজেট প্রণয়নের আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড দেশের ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে সংলাপে বসে থাকে। অর্থমন্ত্রী এই সংলাপ থেকে বাজেটের উপকরণ সংগ্রহ করেন। বিগত সরকারের সময়ে এ ধরনের প্রতিটি সংলাপে অংশগ্রহণের সুযোগ হতো। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান যেসব প্রবীণ এবং সফল শিল্পোদ্যোক্তাদের বিশেষভাবে সম্মান করতেন এবং গুরুত্ব দিতেন স্যামসন এইচ চৌধুরী ছিলেন তাদের পুরোধা। ঋণখেলাপি সংস্কৃতি এবং কর ফাঁকির চর্চার বাইরে নিজের শ্রমলব্ধ পুঁজি এবং মেধার সমন্বয় ঘটিয়ে সততা নির্ভর সফল শিল্পোদ্যোক্তা স্যামসন চৌধুরী ছিলেন প্রবীণ মূল্যবোধের ধারক এক আধুনিক মনস্ক ব্যক্তিত্ব।
মানুষ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পৃথিবীর ক্ষেত্র থেকে বিচ্যুত হয়। কিন্তু বেঁচে থাকে তার মানব কল্যাণধর্মী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। যেভাবে বেঁচে থাকবেন বহুকাল স্যামসন চৌধুরী। তাঁর অনুপস্থিতিতে এ দেশের শিল্পজগতে তারই মুখচ্ছবি মর্মব্যথায় প্রকাশিত হতে থাকবে। জীবনের নানা বিচ্ছেদ, মৃত্যু- নব প্রজন্মের জন্য নতুন বারতা নিয়ে আসে। তাঁর পথচলা সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের সেই রানার কবিতার মতো-
‘এমনি করেই জীবনের বহু বছরকে পিছু ফেলে,
... ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে।
... রাত নির্জন, পথে কত ভয়, তবুও রানার ছোটে
দস্যুর ভয়, তারো চেয়ে ভয় কখন সূর্য ওঠে।
... তবু তো পথের পাশে পাশে
প্রতি ঘাসে ঘাসে
লেগেছে বিস্ময়।
সেই মোর জয়॥
লেখক বর্তমানে রয়টার্সের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

No comments

Powered by Blogger.