চট্টগ্রামের জনসভায় খালেদা জিয়া-১২ মার্চ ঢাকায় মহাসমাবেশ by টিপু সুলতান, তানভীর সোহেল ও প্রণব বল

ত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে ১২ মার্চ ঢাকায় মহাসমাবেশ ডেকেছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। গতকাল সোমবার চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ড মাঠের জনসভা থেকে খালেদা জিয়া এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ‘চলো চলো ঢাকায় চলো’ বলে তিনি ১২ মার্চের কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। বিশাল এই সমাবেশে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অতীতের ভুলত্রুটি শোধরানোরও অঙ্গীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি বলতে


চাই, আমরা মানুষ, ফেরেশতা নই। আমাদের সময়ে ভুলত্রুটি হয়ে থাকতে পারে। কথা দিচ্ছি, সেই সব ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা আগামীতে কাজ করব, আর ভুল হবে না।’ খালেদা জিয়া সরকারের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণভাবে মহাসমাবেশ করব। কোনো বাধা দেবেন না। যদি বাধা দেন, তার দায়দায়িত্ব আপনাদের নিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আপনারা ব্যর্থ হয়েছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়ে নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাই করুন। এত চুরিচামারি করলে কি শেষরক্ষা হয়?’
ঢাকার মহাসমাবেশের আগে ২৯ জানুয়ারি ঢাকাসহ সব বিভাগীয় ও জেলা সদরে গণমিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারিতে এসএসসি পরীক্ষা। তাই এই সময়ে কঠোর কোনো কর্মসূচি রাখা হয়নি। ফেব্রুয়ারিতে দেশব্যাপী গণসংযোগ, সভা-সমাবেশ করা হবে।
গতকাল চট্টগ্রামের জনসভার মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে চারদলীয় জোটের রোডমার্চ কর্মসূচি শেষ হলো। গত বছরের অক্টোবর মাসে সিলেট ও উত্তরাঞ্চলের চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং নভেম্বরে খুলনা অভিমুখে রোডমার্চ করেছিল চারদলীয় জোট।
গতকালের সমাবেশ উপলক্ষে চট্টগ্রাম মহানগরজুড়ে তোরণ, ব্যানার, পোস্টারে ছেয়ে গেছে। জনসভা সফল করতে কয়েক সপ্তাহ ধরে নগরসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামজুড়ে ব্যাপক প্রচার চালিয়েছে বিএনপি।
গতকাল পলোগ্রাউন্ড মাঠে দুপুর ১২টা থেকে জনসভার কার্যক্রম শুরু হলেও সকাল আটটা থেকে জনসমাগম শুরু হয়। সকালেই জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা মাঠে আসতে শুরু করেন। তাঁরা মঞ্চ ও জনসভাস্থলের প্রবেশমুখে যুদ্ধাপরাধের মামলায় আটক দলীয় নেতাদের মুক্তির দাবিতে পোস্টার নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যান।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকসমাগম বাড়তে থাকে। নগরের বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের গাড়িতে, হেঁটে, ঢোল বাজিয়ে, নেচেগেয়ে জনসভাস্থলে আসতে দেখা যায়। বেলা দুইটার মধ্যে প্রায় দুই লাখ বর্গফুট আয়তনের পলোগ্রাউন্ড মাঠ ভরে যায়। মাঠের পাশের দেয়ালের কিছু অংশ ভেঙে দিয়ে রেললাইনের ওপরও মানুষ দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়।
বিকেল চারটা নাগাদ মাঠ ছাপিয়ে আশপাশের কদমতলী মোড়, টাইগার পাস মোড়, দেওয়ানহাট ওভারব্রিজ পর্যন্ত লোকজন ছড়িয়ে পড়ে। এসব মোড়ে মাইক লাগিয়ে ও বড় পর্দায় জনসভার বক্তব্য সরাসরি প্রচার করা হয়। জনসভার কারণে নগরের সাধারণ যাতায়াতব্যবস্থা প্রায় স্থবির হয়ে যায়।
এই রোডমার্চ কর্মসূচির প্রধান সমন্বয়ক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার তাঁর বক্তৃতায় দাবি করেন, গতকালের এই জনসভায় ১০ লাখ মানুষের সমাগম হয়েছে। জনসভায় সভাপতিত্ব করেন নগর বিএনপির সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, আবদুল্লাহ আল নোমান, এম মোরশেদ খান, মীর মোহাম্মদ নাছিরউদ্দিন, বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক, জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ, এলডিপির সভাপতি অলি আহমদ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) আন্দালিব রহমান, খেলাফত মজলিসের আমির মো. ইসহাক, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার থাকা বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের ও তাঁর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ মন্জুর আলমসহ বিএনপি ও জামায়াতের স্থানীয় নেতারা বক্তব্য দেন।
খালেদা জিয়া বেলা তিনটা ৫০ মিনিটে মঞ্চে এসে পৌঁছান। বক্তৃতা শুরু করেন পৌনে পাঁচটায় আর শেষ করেন সাড়ে পাঁচটায়। ৪৫ মিনিটের বক্তৃতায় বিরোধীদলীয় নেতা সরকারের ব্যাপক সমালোচনা করেন। তিনি অভিযোগ করেন, সরকার কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে গিয়ে দলীয় লোকদের ব্যাপক লুটপাটের সুযোগ করে দিয়েছে। আর এই ভর্তুকির চাপ পড়ছে মানুষের ওপর।
খালেদা জিয়া দাবি করেন, গত তিন বছরে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের জন্য, মানুষের জন্য কোনো কাজ করেনি। নির্বাচনের আগে যেসব ওয়াদা করেছিল, তার কোনোটা রক্ষা করেনি।
ক্ষমতায় গেলে বিএনপি যা করবে: খালেদা জিয়া বলেন, আগামী দিনে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করবে। দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখবে। দেশে যেসব হত্যা-গুম-অপহরণের ঘটনা ঘটছে, তার বিচার করবে। নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী প্রশাসন গড়ে তুলবে। মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করবে।
খালেদা জিয়া তরুণদের উদ্দেশে বলেন, ‘তোমরা আমাদের পেছনে থাকবে, আমরা তোমাদের এগিয়ে নেব সামনের দিকে।’
সরকার সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করতে চায়: খালেদা জিয়া অভিযোগ করেছেন, সরকার সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করতে চায়। কারণ তারা বাংলাদেশকে ভারতের করদ রাজ্যে পরিণত করতে চায়। তাঁর অভিযোগ, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারাও এখন গুম হচ্ছেন। যোগ্য অনেক সেনা কর্মকর্তাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, বন্দী করে বিচার করা হচ্ছে।
বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, তাঁর দল ক্ষমতায় গেলে এসবের বিচার এবং চাকরিচ্যুতদের পুনর্বহাল করবে। আর বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তার হত্যার সঠিক তদন্ত করে বিচারের ব্যবস্থা করবে।
ভারতকে কেবল আ.লীগের সঙ্গে বন্ধুত্ব করলে হবে না: খালেদা জিয়া ভারত সরকারের উদ্দেশে বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হলে এ দেশের জনগণের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হবে। কেবল আওয়ামী লীগের সঙ্গে বন্ধুত্ব করলে চলবে না। তিনি অভিযোগ করেন, ‘এই সরকারের আমলে ভারত বাংলাদেশ থেকে সবকিছু নিয়ে গেছে, কিন্তু এই দেশকে কিছুই দেয়নি। তারা বর্ষাকালে বাংলাদেশে তিস্তা নদী দিয়ে পানি দিতে চায়। আসলে বাংলাদেশকে ওই সময় পানি দিয়ে ভাসিয়ে দিতে চায়, বাংলাদেশকে ভাসিয়ে দেওয়াই তাদের কাজ।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘বাংলাদেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এসেছিলেন। আমরা ভেবেছিলাম, ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের এত ভাব, এত বন্ধুত্ব, এবার হয়তো এ দেশের জনগণ কিছু পাবে। কিন্তু কিছুই পায়নি। পায়নি কারণ, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আপত্তি করেছেন। অথচ আমরা জানি, তাঁদের মধ্যে কত সম্পর্ক। একে অন্যকে হাসু আপা আর মমতা দিদি বলে ডাকেন।’
বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, ‘ভারতের গাড়ি চলার জন্য তিতাস নদীর ওপর দিয়ে কোনো রাস্তা হবে না। রাস্তা কেটে দেওয়া হবে। আগে দেশের গাড়ি চলবে, তারপর অন্য চিন্তা।’
এরশাদের ঋণ শোধ: খালেদা জিয়া বলেন, ১৯৮৬ সালে এরশাদের পাতানো নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী অংশ নিয়েছিল। কিন্তু বিএনপি সেই নির্বাচনে যায়নি। এবার আওয়ামী লীগ এরশাদকে নিয়ে পাতানো নির্বাচন করে ক্ষমতায় যেতে চায়। তারা পরিকল্পনা করেছে, এরশাদ আর আওয়ামী লীগ নির্বাচন করবে। এরশাদের জাতীয় পার্টি হবে বিরোধী দল। এরশাদও পাতানো নির্বাচনে অংশ নিয়ে ঋণ শোধ করতে চান। কিন্তু সেই নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। নির্বাচন হতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।

No comments

Powered by Blogger.