অনুভূতির খেরোখাতা

টিনএজ এক আজব বয়স। মন কেমন উড়ূ উড়ূ এই বয়সে! তাই অনুভূতিও উড়ূ উড়ূ খুব, সে কথা জানি আমরা। জানি বলেই তোমাদের সেই একান্ত অনুভূতির কথা জানতে চাই প্রতিনিয়ত। তোমাদের পাঠানো এমন অনুভূতি থেকে তিনটি ছাপা হলো আজকের সংখ্যায় সুরের নাটাইয়ে বাঁধা সোহেল নওরোজ কনকনে শীতের নিশুতি রাতে আন্তঃনগর ট্রেনের কেবিনে আমরা তিনজন মাত্র যাত্রী। ট্রেন চলছে ঢিমেতালে। গন্তব্যে পেঁৗছানোর কোনোরূপ তাড়া অন্তত লক্ষ্য করা যাচ্ছে


না। স্বল্প ওয়াটের টিমটিমে বাতিতে নিজেকে গুছিয়ে জড়সড় হয়ে এক কোনায় গিয়ে বসলাম। পাশে আমার সহযাত্রী বন্ধু চাদর জড়িয়ে আধশোয়া অবস্থায়। সামনের আসনের বড় ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের পর আর একটাও কথা হয়নি। বলা ভালো, সুযোগ পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে ক্রমাগত কথা বলে চলেছেন তিনি। আর একটু পর পর বাইরে গিয়ে সিগারেট ফুঁকে আসছেন।
এ পর্যন্ত তাও বেশ ছিলাম। চরম বিরক্তির উদ্রেক ঘটাতে অগত্যা এক পুলিশ কর্মকর্তা এসে কেবিনের একপাশ দখল করলেন। অন্যের সুবিধা-অসুবিধার ধার না ধেরে দেওয়ালে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে বিকট শব্দে নাকডাকা শুরু হলো। নিছক বাংলাদেশ বলে সব মুখ বুজে সয়ে যেতে হয়! বিশ্বের আর কোনো দেশে আইন রক্ষাকারী বাহিনীর একজন কর্তব্যরত সদস্যের পক্ষে এহেন কার্য কেবল অসম্ভবই নয়, কল্পনারও অতীত।
বিগড়ে যাওয়া মেজাজ ঠিক করতে চায়ের সন্ধানে বের হলাম। অন্য সময় হলে এতক্ষণে দু-চারজন ফেরিওয়ালার সঙ্গে সাক্ষাৎ হতো নিশ্চিত। কিন্তু আজ তাদের সন্ধান পেতে পুরো ট্রেনে তল্লাশি অভিযান চালাতে হবে বলে মনে হচ্ছে। উত্তপ্ত মস্তিস্কের ভাবনাগুলোও মাত্রাহীন হয়ে পড়ছে। একটা কামরা অতিক্রম করতে যাব, এমন সময় দরজার বিপরীতে ঢোল-তবলা নিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা মাঝবয়সী দুজন লোককে দেখে আগ্রহ জাগল। কৌতুহল মেটাতে আগ বাড়িয়ে তাদের কাছে গেলাম।
আমার প্রজন্মের অনেকের কাছে 'কবিগান' শব্দটা তেমন পরিচিত নয়। এরা মূলত কবিগানের দুই শিল্পী। স্থানীয় ভাষায় বলে 'গাতক'। আমার অত্যুৎসাহে তারা তাদের মনোবেদনার কিছু অংশ প্রকাশ করলেন। নিমন্ত্রিত শিল্পী হিসেবে দূরে গিয়েছিলেন গান করতে। কিন্তু অত্র এলাকার কতিপয় প্রভাবশালী রাজনীতিকের হস্তক্ষেপে অনুষ্ঠান থেকে তারা বাদ পড়ে যান। বাইরে থেকে ভাড়া করা মডার্ন গানের নারী শিল্পী দিয়ে অনুষ্ঠান চালানো হয়।
যে দুটো দিন ওখানে ছিলেন তারা, কেউ তাদের খোঁজ-খবর নেয়নি। খাবারটাও জোটেনি ঠিকমতো। ভাড়ার টাকা নেই, তাই তীব্র শীতের রাতে ট্রেনের মেঝেতে বসে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। বাড়ি ফিরে হয়ত দেখবেন, বউ-বাচ্চারা না খেয়ে দিনাতিপাত করছে। তবু তারা গান ছাড়বেন না। নিস্তরঙ্গ জীবনে গান-বাজনা ছাড়া বেঁচে থাকা যায় না। উপলক্ষ এলে তাই সাত-পাঁচ না ভেবে বাদ্য নিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়া_ এটাই তাদের জীবন।
অকস্মাৎ ছুড়ে দেওয়া গাতকের এক প্রশ্নের উত্তরে অপ্রস্তুত আমি নির্বিকার-স্তব্ধ হয়ে গেলাম, 'গানকে ভালোবেসে কি আমরা কোনো অন্যায় করেছি?'
আমার ক্ষমতা সীমিত। কিংবা কে জানে, ক্ষমতা থাকলে হয়ত সঙ্গীত-অন্তঃপ্রাণ এসব মানুষকে ভুলে গিয়ে আমিও কথিত মডার্নদের পক্ষে সায় দিতাম। উঠতে যাব, এমন মুহূর্তে তারা সমস্বরে গেয়ে উঠলেন_
একদিন মাটির ভেতরে হবে ঘর
ও মন আমার
কেন বান্ধো দালান ঘর।
অন্তরে হাহাকার নিয়ে সুরের মূর্ছনায় ডুব দেওয়া যায় না। আমিও পারলাম না। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এমন মানুষদের কথা ভেবেই বোধকরি 'আমার আপন আঁধার' বইয়ে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন, 'আমরা টাকা-পয়সা খরচ করে দূরের সমুদ্র দেখতে যাই, অথচ আমাদের আশপাশের মানুষরাই বুকে সমুদ্র ধারণ করে ঘুরে বেড়ান। সেই সমুদ্র আমাদের চোখে পড়ে না'। সঙ্গীতের সমুদ্র বুকে ধারণকারী গাতকদের জন্য নতুন বছরের শুভেচ্ছা আর ভালোবাসার অর্ঘ্য সাজানো রইল। দরদ ভরা কথা আর সুরের আবহে ব্যথা-বেদনা, অতৃপ্তি-হতাশা, বঞ্চনা-গঞ্জনা উবে যাক চিরতরে।
হ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
স্বপ্ন দেখে মন
মিজানুর রহমান মিজান
জীবনে কত সূর্যোদয় দেখেছি, সূর্যাস্ত দেখেছি, জোছনার মোহনীয় সেই পূর্ণিমার চাঁদ দেখেছি। শুধুই দেখেছি, দেখার মতো করে দেখলাম আর কী? মানুষ আশা-নিরাশার দোলাচলে দুল্যমান, স্বপ্ন দেখে, অনেক বড় স্বপ্ন, এক একটি স্বপ্ন পৃথিবীসমেত। আমিও মানুষ, আমারও মন আছে, বিবেক আছে, বুদ্ধি আছে, সবই আছে। আমিও স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নে বিচরণ করি সারাক্ষণ, স্বপ্নকে স্বীয় মাধুর্যতা দিয়ে রোপণ করি যেন প্রস্ফুটিত হয় সমহিমায়। আলোকবর্তিকা দিশারি হয়ে যেন আমাকে হাতছানি দেয়। মনের গহ্বরে সৃজন করি এক অপূর্ব স্বপ্নের রানী। আমি দেখি, ওই যে ছাদের ওপর যেন এক হলুদ ছাঁ। আমি পুষতে চাই দুধ-কলা-ভাত আর খাঁচায় বন্দি করে নয়, মুক্ত আকাশের নিচে যেথায় বিচরণে কোনো বাধা নেই। যেখানে মনের টানে বাতাসে বীণা বাজে আর ছন্দের মালা গেঁথে মাধুর্যতার ভাব নিয়ে যেখানে গীতির মিতালি নবৎ রাগের নৃত্য তোলে। ঋতুরাজের পাখিরা যেথায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গান করে। আমি তেমন করে পুষে নেব, প্রকৃতির অপরূপ লাবণ্যে রাঙিয়ে দেব। তবে উড়ে আসতে হবে না, হাতছানি দিলেই চলবে। আর চোখের আড়িপাত যেখানে মনের কথা লুকিয়ে থাকে, যদি তার ক্ষীণ প্রকাশ পায়, তবেই না উজাড় করে বিলিয়ে দেব স্বীয় তনু।
হ সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম
জীবনের ধূসর পথে
রৌদ্র সীমান্ত
তবুও ভাবি, নিষ্ঠুর হয়ে যাব।
কিন্তু যতবারই তা ভাবি, কেউ একজন পথ আগলে সঙ্গী হতে চায়। তাকে সঙ্গী করে নিই। একটু এগোলে অন্য কেউ সঙ্গী হতে চায়। তাকেও সঙ্গী করে নিই। এভাবে কিছু সময় পথ চলতে থাকি সঙ্গীদের নিয়ে। মনে হয় জীবনটা যেন রঙিন পথের সময়ের সমষ্টি!
'আসলেই কী জীবনপথ রঙিন?' মাঝে মধ্যে প্রশ্ন জাগে ছোট্ট মনে। প্রশ্নের উত্তরও পেয়ে যেতে সময় লাগে না। লাগাবেইবা কেন? সময়ের গতিধারার সঙ্গেই সুদূরের হাতছানি আমাকে ভবিষ্যতের সত্যের কাছে ছুড়ে ফেলে।
উত্তর পেয়ে যাই।
জীবন নামক পথ আসলে রঙিন নয়। 'তাহলে জীবন পথের রঙ কী?'
অন্যপ্রশ্ন এসে ঘিরে ধরে আমায়। পেছনে ফিরে দেখি। অস্পষ্ট কুয়াশায় ঢেকে আছে জীবনপথের ফেলে আসা দিনগুলো। রঙ খুঁজতে থাকি। কিন্তু বারবার অস্পষ্টতাই ধরা দেয় সাদা-কালোর দু'চোখে। বুঝে উঠতে পারি না জীবনপথের আসল রঙ।
হঠাৎ 'ধূসর' শব্দটা এসে টোকা দেয় মনের দরজায়। ভাবতে থাকি ধূসরকে নিয়ে। ভেসে উঠে ধূসরের চিত্র। দ্বিধাহীন মনে মিল খুঁজে পাই ধূসরের সঙ্গে জীবনপথের ফেলে আসা কুয়াশাময় দিনের রঙের।
'তাহলে জীবনপথের রং চলার সময় কেন রঙিন মনে হয়?' প্রশ্নের সম্মুখীন আবারও হই আমি। তবুও উত্তর দিয়ে ধারণাকে স্বচ্ছ করি। জীবনপথে চলার সময় সঙ্গীদের কাছ থেকে নানা রঙের আভা খুঁজে পাই।
কখনও নীল অথবা গোলাপি, আবার কখনও আকাশি রঙের কৃত্রিম সৌন্দর্যের মিথ্যা আকৃষ্টে জীবনপথকে রঙিন মনে হয়। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সঙ্গীদের নিষ্ঠুরতায় সত্যের কাছে পেঁৗছানোর পর পিছে ফিরে দেখি বর্ণিল সেই রঙগুলোর কৃত্রিমতা; যা ধূসর হয়েই ধরা দেয় ক্ষুদ্র চোখে। তাহলে এখন যা দেখছি তা রঙিন কেন? না, বাস্তবে তা রঙিনের কৃত্রিমতা, যার সঠিক রঙ ধূসর।
আমি ধূসর পথ দিয়েই হেঁটে চলেছি এতদিন। লক্ষ্য একটাই_ পথের শেষের ওই উজ্জ্বল নক্ষত্রকে ছোঁয়া। তাই আর মায়ায় জড়াব না, রঙিনের কৃত্রিমতায়ও গা ভাসাব না।
তাই এখন একাকী হেঁটে চলি জীবনের ধূসর পথে।
হ ঠিকানাবিহীন

No comments

Powered by Blogger.