ইউনিয়ন পরিষদের খসড়া আইন by মোহাম্মদ আশিকুর রহমান

তিহাসিকদের মতে, ব্রিটিশ শাসনামলে বঙ্গীয় অঞ্চলে পঞ্চায়েত প্রথা প্রচলিত ছিল। যার সদস্য সংখ্যা ছিল ৫ জন। গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে এই পঞ্চায়েত কমিটি গঠিত হতো। তবে তাদের কোনো আইনগত ভিত্তি ছিল না। বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা অতি প্রাচীনকাল থেকে না হলেও একেবারেই নতুন নয়। ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা পরিষদ ব্যবস্থা অনেক পুরনো। যদিও কালের বিবর্তনে এর পরিবর্তন হতে হতে বর্তমান এই অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ প্রায় ১৫০ বছর আগে তার যাত্রা শুরু করে ।
১৮৭০ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে তাদের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক বিশেষ করে পলল্গী অঞ্চলে ব্রিটিশদের ভিত্তি দৃঢ় করার লক্ষ্যে তখনকার প্রশাসক লর্ড মেয়ো পল্লী অঞ্চলে চৌকিদারি আইন পাস করেন। এই আইনের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো পল্লী অঞ্চলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব হয়। চৌকিদারি আইন পাসের মধ্য দিয়ে পঞ্চায়েত প্রথার পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয় এবং তা আইনগত ভিত্তি অর্জন করে। আবার ১৮৮৫ সালে বঙ্গীয় স্বায়ত্তশাসন আইন প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ স্থানীয় সরকারের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়। এই আইনের অধীনেই ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন কমিটি, মহকুমা পর্যায়ে লোকাল বোর্ড এবং জেলা পর্যায়ে জেলা বোর্ড প্রতিষ্ঠা পায়। আবার ১৯১৯ সালে বঙ্গীয় স্বায়ত্তশাসন আইনের সংশোধনী এনে ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন কমিটির স্থলে ইউনিয়ন বোর্ড গঠন করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৯ সালে মৌলিক গণতন্ত্র অধ্যাদেশ ১৯৫৯-এর মাধ্যমে ইউনিয়ন বোর্ডকে ইউনিয়ন কাউন্সিলে পরিবর্তিত করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর রাষ্ট্রপতির আদেশ ৭ : ১৯৭২ বলে ইউনিয়ন কাউন্সিল নামকরণ বাতিল করা হয়। তার পরিবর্তে নামকরণ করা হয় ইউনিয়ন পঞ্চায়েত। আবারও রাষ্ট্রপতির আদেশ ২২ : ১৯৭৩ অনুযায়ী ইউনিয়ন পঞ্চায়েতের নাম পরিবর্তন করে বর্তমানের ইউনিয়ন পরিষদ নামকরণ করা হয়। এ পর্যন্ত ৭/৮ বার বিভিন্ন সংশোধনীর পাশাপাশি নামকরণেও পরিবর্তন আনা হয়েছে । নামকরণের দিক দিয়ে বাংলাদেশ সরকারও প্রায় ১০০ বছর পেছনে গিয়েছিল ইউনিয়ন পঞ্চায়েত নামকরণের মাধ্যমে। গ্রামীণ স্থানীয় সরকারের এই সর্বশেষ ইউনিট ইউনিয়ন পরিষদের যত পরিবর্তন আনা হয়েছে তত সুফল জনগণ পায়নি। ব্রিটিশদের এই স্তরের প্রয়োজন ছিল একমাত্র তাদের শাসন প্রয়োগের জন্য, কিন্তু বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকারের এই স্তরের প্রয়োজন হলো জনগণ দ্বারা জনগণকে শাসন করার জন্য। যদিও কাগজে-কলমে জনগণ দ্বারা জনগণের শাসন (গণতন্ত্র) বলা হলেও কার্যত তার কোনো বহিঃপ্রকাশ জনগণ কোনো দিন দেখতে পায়নি। ইউনিয়ন পরিষদকে স্বশাসিত ইউনিয়ন পরিষদ বললেও কার্যত এই প্রতিষ্ঠানটি স্বশাসিত নয়।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর যতগুলো কমিশন/কমিটি হয়েছে স্বশাসিত, উন্নত ও শক্তিশালী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য সেগুলোতে ওই সরকারের সুবিধাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গঠিত ‘স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ কমিটি-২০০৭’ রিপোর্টের কথা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে জানানো হয়। বাস্তবে দেখা গেল, জনগণ সুফল পাওয়া তো দূরের কথা ওই রিপোর্টই বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমান সরকারের স্থানীয় সরকার বিষয়ক সংসদীয় কমিটি ইউনিয়ন পরিষদের যে খসড়া চূড়ান্ত করেছে তার বাস্তবায়ন হলে জনগণ ক্ষমতায়িত হওয়া বা কোনো সুফল পাওয়া তো দূরের কথা আরও কোণঠাসা হয়ে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই বিলখেলাপি, ঋণখেলাপি, মাদক ব্যবসায়ী, চোরাচালানি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে দেখা যায়, যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে, তখন সে সরকারের রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পেয়ে থাকে। মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামা দেয়ার বিধান থাকলে কিছুটা হলেও দুর্নীতিবাজ, বিলখেলাপি, ঋণখেলাপী, মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীরা নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধার সম্মুখীন হতেন। এতে করে যারা মন্দের ভালো তারাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ পেতেন। স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ কমিটির রিপোর্ট-২০০৭’র মতে, একবছর পূর্বে ঋণখেলাপির পুনঃতফসিল করার সুযোগ থাকলে যারা প্রকৃতপক্ষে জনগণের প্রতিনিধি হয়ে জনসেবা করতে চান তারা ন্যূনতম একবছর পূর্ব থেকে মানসিক প্রস্তুতি নিতেন এবং জনসংযোগ শুরু করতেন। তাতে করে জনগণের সুবিধা-অসুবিধা কোথায়, তাদের চাওয়া পাওয়া কী তা তারা বুঝতে পারতেন। সবচেয়ে বড় যে অর্জনটুকু হতো তা হচ্ছে একবছর ওই ব্যক্তি সব অনিয়ম, অনৈতিকতার ঊর্ধ্বে থাকতেন। সংসদীয় কমিটির খসড়া আইন অনুযায়ী যদি একদিন পূর্বে পুনঃতফসিল করার সুযোগ রাখা হয় তাহলে এর সত্যতা যাচাই করার সুযোগও থাকবে না। বর্তমান স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) খসড়ামতে, যত প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন তাদের মধ্যে বহুলাংশেই অনিয়ম, অনৈতিকতা ও অসামাজিক কার্যকলাপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট—এটাই স্বাভাবিক। ‘স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ কমিটি-২০০৭’র রিপোর্ট বাস্তবায়িত হলে ওই শ্রেণীর লোকদের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া থেকে দূরে রাখা সম্ভব হতো। এতে প্রকৃতপক্ষে যোগ্য ব্যক্তিরাই নির্বাচনে জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ পেতেন। হলফনামা তৈরির জন্য নোটারি পাবলিকের কাছে যাওয়া একটা বিড়ম্বনার কাজ, মাঠ পর্যায়ে নির্বাচনে প্রার্থীদের পক্ষে এসব কাগজপত্র সংগ্রহ করা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন সংসদীয় কমিটি। সংসদীয় কমিটিকে প্রথমে ভেবে দেখতে হবে যে, হলফনামার ব্যবস্থা থাকলে উন্নত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সহায়ক হবে কিনা। যদি সহায়ক হয় সে ক্ষেত্রে তা অবশ্যই ভেবে দেখা উচিত। প্রার্থী যে ভালো তার যাচাই-বাছাই তো হবে নির্বাচনে ব্যালটের মাধ্যমে। এর আগে তো ভালো বলা যাবে না, কারণ একদল বলবে ভালো, অন্য দল বলবে খারাপ। নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য অবশ্যই প্রশাসনিক স্বচ্ছতারও প্রয়োজন আছে। শুধু গুটিকয়েক মানুষ একজন প্রার্থীকে ভালো বললেই তিনি নির্বাচনের জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন না। ভেবে দেখা উচিত, বিলখেলাপি, ঋণখেলাপি ব্যক্তি মানেই হচ্ছে ব্যবসায়ী। আর কোনো ব্যবসায়ীকে দিয়ে জনসেবা আশা করা কতটা যৌক্তিক? ব্যবসায়ীকে দিয়ে জনপ্রশাসন চলতে পারে না। জনপ্রশাসনের জন্য চাই প্রকৃত রাজনীতিবিদ। সুতরাং কোনো বিলখেলাপিকে নির্বাচনে সুযোগ না দেয়াটাই যৌক্তিক হবে। এই বিষয়টি সংসদীয় কমিটিকে ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ থাকল। বর্তমানকে বিবেচনায় না নিয়ে ভবিষ্যেক উপলব্ধি করে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কার্যক্রম ইত্যাদি পর্যালোচনা করে দীর্ঘমেয়াদি একটি আইন পাস করা হোক, যাতে করে প্রতিবছর বা প্রতি সরকারের আমলেই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার উন্নতির জন্য নতুন রিপোর্ট প্রণয়ন কমিটি/কমিশন গঠন করে অর্থ অপচয় না হয় ও বিভিন্ন জটিলতায় পড়তে না হয় এবং ইউনিয়ন পরিষদ যাতে হয় স্বশাসিত স্থানীয় সরকারের একটি ইউনিট—এটাও সংসদীয় কমিটিকে ভেবে দেখতে হবে। তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি স্থায়ী স্থানীয় সরকার কমিশন গঠনের বিষয়টিও ভাবা উচিত। স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন) নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞ গবেষণা করেছেন ও করছেন, প্রয়োজনে ওইসব বিশেষজ্ঞের গবেষণা পর্যালোচনা করা যেতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.