পরিবেশ-ডাইক্লোফেনাক কেন নিষিদ্ধ হচ্ছে না? by পাভেল পার্থ

রু, মহিষ ও ছাগলসহ গবাদি প্রাণিসম্পদের চিকিৎসায় ব্যবহূত ‘ডাইক্লোফেনাক’ ওষুধটি প্রতিবেশবাদী ও গবেষকদের জোর দাবির মুখে ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার দেশে এর উৎপাদন, ব্যবহার ও বিক্রি নিষিদ্ধ করে। সরকারি ঘোষণা ও তফসিলে ডাইক্লোফেনাক ‘নিষিদ্ধ’ হলেও দেশের সর্বত্র তা হরদম বিক্রি ও ব্যবহার হচ্ছে।


গবাদি প্রাণিসম্পদের আর্থ্রাইটিস, ত্বকের প্রদাহ, অ্যানথ্রাক্স, জ্বর ও হাড়-মাংসের বেদনায় প্রশ্নহীনভাবে দেশের গ্রামীণ জনপদে ব্যবহূত হয়ে আসা নিষিদ্ধ এই ডাইক্লোফেনাক বিক্রি হচ্ছে একেবারেই সরকারের চোখের সামনে, সরকার কর্তৃক অনুমোদিত বিক্রয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে। এটি ইনজেকশন ও বড়ি—দুভাবেই বিক্রি হতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের এগ্রোভেট ডিভিশনের তৈরি ‘ক্লোফেনাক-ভেট’-এর মতো ওষুধের পাশাপাশি ঝিনাইদহের এফএনএফ কোম্পানির ডিপেইনও নিষিদ্ধ হওয়ার পর এখনো বিক্রি হচ্ছে। দুনিয়ায় শকুন পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে গবাদি প্রাণিসম্পদের চিকিৎসায় ব্যবহূত এই ডাইক্লোফেনাকটি চিহ্নিত হওয়ায় অনেক দেশেই একে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যখন কোনো গবাদি প্রাণীকে ডাইক্লোফেনাক দিয়ে চিকিৎসা করা হয়, তারপর যদি ওই প্রাণীটি মারা যায় এবং সেই মৃত প্রাণীর মাংস যদি শকুন খায়, তবে শকুনের পাকস্থলী নষ্ট হয়ে মারা যায়। শকুনের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে নিশ্চিহ্ন হওয়ায় বাংলাদেশও ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল।
বাংলাদেশ ও ভারতে ২০০৩ সালে ৯৫ শতাংশ এবং ২০০৮ সালে ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশ শকুন কমে যাওয়ার পেছনে অনেকেই গবাদি প্রাণিসম্পদের চিকিৎসায় ব্যবহূত ডাইক্লোফেনাককে দায়ী করেছে। ১৯৭৩ সালে সিবা-গেইগি ডাইক্লোফেনাক প্রথম বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি শুরু করে (সূত্র: http://en.wikipedia.org /wiki/Diclofenac। গবাদিপশুর চিকিৎসায় ব্যবহূত এই ওষুধ শকুনের পরিপাক ও রেচনপ্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত করে। ডাইক্লোফেনাক গ্রহণকারী কোনো পশুর মাংস খেলে শকুনের শরীরে তা বিষক্রিয়া তৈরি করে এবং অসুস্থ হয়ে ধীরে ধীরে পাখিটি মারা যায়। নেচার সাময়িকীর ২০০৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় পাকিস্তানে শকুনের বংশ কমে যাওয়ার পেছনে গবাদিপশু ও পাখি চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাকের ব্যবহার-বিষয়ে একটি গবেষণা প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। প্রথম আলো জানিয়েছে, দেশে বাংলা শকুনের সবচেয়ে বড় বিচরণ এলাকা শ্রীমঙ্গলের ফুলছড়ি চা-বাগান থেকে শকুন নির্বংশ হওয়ার জন্য ডাইক্লোফেনাক ওষুধের ব্যবহার, বন উজাড় ও খাদ্যসংকট দায়ী। ২০১০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চায়ের আবাদ সম্প্রসারণ করার সময় কিছু বড় গাছ কাটা এবং ঝড়ে কিছু গাছ পড়ে যাওয়ার পর থেকে ফুলছড়ি চা-বাগান এলাকায় শকুনের আনাগোনা অনেকাংশে কমে গেছে। বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল ডাইক্লোফেনাকের কবল থেকে শকুন রক্ষায় Manifesto on Diclofenac and vulture conservation ঘোষণা করেছে। শকুন সংরক্ষণ এবং শকুন রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ বছরের ৪ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস পালিত হয়।
দেশে নিষিদ্ধ ডাইক্লোফেনাক বিক্রির জন্য সরাসরি রাষ্ট্র দায়ী। কারণ রাষ্ট্রের অনুমোদন ও নজরদারি ছাড়া আর যা-ই হোক কোনো বিক্রিবাট্টা হওয়া অসম্ভব। ২০১১ সালে দেশের হাওর, পাহাড়, সুন্দরবন, সমুদ্র-উপকূল, বিল, নদীপ্লাবন, চর, বরেন্দ্র, বন, সমতল অঞ্চল ঘুরে দেখেছি, গ্রামগঞ্জের দোকানসহ সর্বত্র দেদার বিক্রি হচ্ছে নিষিদ্ধ ডাইক্লোফেনাক। বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, দেশের প্রায় সব অঞ্চলের বিক্রেতারাই জানেন ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ ওষুধ। তাঁরা আরও বলেছেন, এটি তাঁরা জেনেছেন তাঁদের কোম্পানির মাধ্যমে এবং কোম্পানি থেকে বলা হয়েছে, নতুন ওষুধ না আসা পর্যন্ত তা বিক্রি করতে। দেশের কোথাও ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ হওয়ার কোনো সরকারি প্রচার-প্রচারণা হয়নি। ওষুধ বিক্রয়কারীরা জানলেও গ্রাম-জনপদের মানুষ, যাঁদের ডাইক্লোফেনাক ব্যবহার করতে বাধ্য করানো হয়েছে। তাঁরা জানেন না এটি নিষিদ্ধ হয়েছে। আজ পর্যন্ত ওষুধের দোকানগুলোতে সংশ্লিষ্ট কোনো সরকারি কর্মকর্তা কি প্রশাসনের কেউ যাননি নিষিদ্ধ ডাইক্লোফেনাক বিক্রি হচ্ছে কি না, তা যাচাই ও পর্যবেক্ষণ করতে। অনেক জায়গায় জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা ও প্রশাসনের সঙ্গে নিষিদ্ধ ডাইক্লোফেনাক বিক্রয়কারী দোকানের ‘অবৈধ টাকার লেনদেনভিত্তিক সম্পর্ক আছে’।
যা-ই হোক, যেভাবেই হোক নিষিদ্ধ ডাইক্লোফেনাক বিক্রয় ও ব্যবহারের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আনা জরুরি। কারণ ডাইক্লোফেনাক বিক্রি ও ব্যবহার বহাল রেখে কোনোভাবেই দেশের প্রাণিসম্পদ ও শকুনের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যাবে না। সরকার একদিকে কাগজে-কলমে ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ করেছে, অন্যদিকে এর বিক্রি ও ব্যবহার বহাল রাখছে। আবার একই সরকার শকুন বাঁচাতে তৈরি করেছে ‘বাংলাদেশ বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন, ২০১০’। প্রতিবেশের প্রাকৃতিক পরিচ্ছন্নকর্মী এই শকুন নিশ্চিহ্ন হওয়ায় দেশের সামগ্রিক বাস্তুসংস্থানে একধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। শকুনের অনুপস্থিতি বর্তমানের অ্যানথ্রাক্স বিপর্যয়ের মাধ্যমে স্পষ্টত প্রতিবেশের অসুস্থতাকেই হাজির করছে। বাসস্থান ও বিচরণ এলাকা কমে যাওয়া, বড় ও উঁচু দেশি গাছের সংকট, খাদ্যাভাব, শকুন-সম্পর্কিত রাষ্ট্রীয় সংরক্ষণ উদ্যোগের অভাবসহ শকুন কমে যাওয়ার পেছনে ডাইক্লোফেনাকও দায়ী। অবিলম্বে সরকারকে ডাইক্লোফেনাকের বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। যেসব দোকানে এখনো নিষিদ্ধ ডাইক্লোফেনাক বিক্রি হচ্ছে এবং যেসব প্রতিষ্ঠান এখনো তা উৎপাদন ও বিক্রি করছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান করতে হবে। ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধকরণের বিষয়টি সরকারি প্রচার-প্রচারণায় সর্বত্র জানাতে হবে। ডাইক্লোফেনাক শকুনের মৃত্যুর সঙ্গে কীভাবে জড়িত এবং কী কী কারণে এটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তা রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রাম-জনপদে প্রচার করতে হবে। গবাদি প্রাণিসম্পদের লোকায়ত স্থানীয় চিকিৎসাকে স্বীকৃতি ও গুরুত্ব দিয়ে এর গবেষণা ও উন্নয়নে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি ডাইক্লোফেনাকের মতো করপোরেট কোম্পানিনির্ভর ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসা-বাণিজ্য আইন করে বন্ধ করতে হবে।
নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সৃষ্ট এ ধরনের সর্বনাশী বাণিজ্য-কারবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার মানসিকতাই হয়তো সরকারকে কোনোভাবেই টনক নড়ায় না। সরকারের চোখের সামনে নিষিদ্ধ ডাইক্লোফেনাক বিক্রি হলেও সরকার দেখেও না দেখার ভান করে। কারণ সরকার মনে করে না সে একই সঙ্গে মানুষ, গরু ও শকুনেরও দরকার। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর্যায় থেকে রাষ্ট্রকে সরে আসতে হবে। বুঝতে হবে মানুষ, গরু-ছাগল ও শকুনের সম্মিলিত সংসারের জটিল গল্প। নিষিদ্ধ ডাইক্লোফেনাককে সত্যিকারভাবেই নিষিদ্ধ করে রাষ্ট্র তার ন্যায়পরায়ণতার দৃষ্টান্ত হাজির করুক এখনই।
পাভেল পার্থ: গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ।
animistbangla@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.