মহাপ্রয়াণ-চলে গেলেন চিরসবুজ দেব আনন্দ by জনি হক

ভারতীয় চলচ্চিত্রের চিরসবুজ নায়ক দেব আনন্দ (৮৮) আর নেই। শনিবার রাতে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে বলে পরিবারের সদস্যরা জানান। কয়েক দিন ধরে অসুস্থ বোধ করায় স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য লন্ডনে গিয়েছিলেন ভারতের এই 'এভারগ্রিন রোমান্টিক সুপারস্টার'। সেখানে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। অবশেষে মৃত্যুর কাছে হেরে গেল চলচ্চিত্রের প্রতি তার অসীম স্পৃৃহা ও আবেগ।


২০০৭ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, 'চলচ্চিত্র শিল্প, ছবি ও কাজ ছাড়া বেঁচে থাকতে পারব না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চলচ্চিত্র নির্মাণ ও অভিনয়ই আমার প্রথম ও শেষ ভালোবাসা হয়ে থাকবে।' মৃত্যুকালে ছেলে অভিনেতা সুনীল তার পাশে ছিলেন। আগামী সপ্তাহে লন্ডনেই তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে।
দেব আনন্দকে বলা হতো রূপালি পর্দার চিরন্তন প্রেমের ও আনন্দদায়ক এক নায়ক। ৬৫ বছরের ক্যারিয়ারে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ভারতের অনন্য এক অভিনেতা-নির্মাতা। বার্তা সংস্থা এএফপি গতকাল তার মৃত্যুর খবরের শিরোনাম
করেছে_ "বলিউডের 'গ্রেগরি পেক' দেব আনন্দ মারা গেছেন ৮৮ বছরে।" চলচ্চিত্রের জন্য মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত অসীম স্পৃৃহা ও আগ্রহ ছিল তার। এ জন্যই তাকে মার্কিন অভিনেতা গ্রেগরি পেকের নামানুসারে 'বলিউডের গ্রেগরি পেক' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সদানন্দ এই শিল্পীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্প ভেসেছে শোকের সাগরে। শোক প্রকাশ করেছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিল ও প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন, অনুপম খের, শাবানা আজমি, শাহরুখ খান, লেখক সালমান রুশদি থেকে শুরু করে বিখ্যাত অনেকেই শোকাহত। তাকে সবাই হৃদয়বান, আবেগপ্রবণ, সাহসী, স্পষ্টভাষী, আনন্দদায়ক, উৎসাহদাতা, সমকালীন, নেতা ও একজন ভালো মানুষ হিসেবে স্মৃতিচারণ করেছেন। টুইটারে অমিতাভ বচ্চন লিখেছেন, 'এই মৃত্যুর মাধ্যমে একটি সোনালি অধ্যায়ের সমাপ্তি হলো। তিনি চলে গিয়ে যে শূন্যতা তৈরি করলেন তা কখনও পূরণ হওয়ার নয়। সম্প্রতি এক প্রদর্শনীতে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। তাকে দেখতে দুর্বল মনে হচ্ছিল কিন্তু স্পৃহার কমতি ছিল না।'
অবিভক্ত পাঞ্জাবের গুরুদাসপুরে ১৯২৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর দেব আনন্দের জন্ম। লাহোরের সরকারি আইন কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করেছেন তিনি। তিন ভাইয়ের মধ্যে দেব আনন্দ ছিলেন দ্বিতীয়। তার ভাই চেতন আনন্দ এবং বিজয় আনন্দ চলচ্চিত্র পরিচালনা করতেন। পড়াশোনা শেষে ভাই চেতনের সঙ্গে ভারতের পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত হন দেব। বোন শীলকান্তা কাপুর বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার শেখর কাপুরের মা।
'হাম এক হ্যায়' চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ১৯৪৬ সালে রূপালি পর্দায় দেব আনন্দের পথচলা শুরু। অভিনেতা অশোক কুমারের সহযোগিতায় এর পর তিনি হাতে পান 'জিদ্দি' (১৯৪৮)। ছবিটি মুক্তির পর তিনি সুপারস্টার হয়ে যান। ওই ছবির ব্যবসায়িক সাফল্য তাকে প্রযোজনায় উদ্বুদ্ধ করে। ১৯৪৯ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নবকেতন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্মস। তার প্রতিষ্ঠান থেকে ৩১টি ছবি নির্মাণ করা হয়েছে। ক্যারিয়ারে ১০০টিরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন দেব আনন্দ। তার অভিনীত 'গাইড' ভারতীয় চলচ্চিত্রের মধ্যে প্রথমবার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যায়। এর প্রদর্শনী হয়েছিল নিউইয়র্কে।
চলি্লশের দশকের শেষভাগে গায়িকা-অভিনেত্রী সুরাইয়ার সঙ্গে বেশ কিছু ছবিতে কাজ করার প্রস্তাব পান দেব আনন্দ। তারা একসঙ্গে সাতটি ছবিতে অভিনয় করেন। এসব ছবিতে কাজ করার সময় দু'জনের মধ্যে মন দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দেব হিন্দু ধর্মের বলে সুরাইয়ার দাদি এ সম্পর্ক মেনে নেননি। এ কারণে সুরাইয়া আজীবন কুমারী থেকে যান। ১৯৫৪ সালে অভিনেত্রী কল্পনা কার্তিককে (প্রকৃত নাম মোনা সিংঘা) বিয়ে করেন দেব আনন্দ।
রাজনৈতিক অঙ্গনেও দেব আনন্দ সক্রিয় ছিলেন। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি আইনের বিরোধিতা করেছিলেন। এর কিছুদিন পরই নিজের রাজনৈতিক দল গঠন করেন।
১৯৭০ সালে 'প্রেম পূজারী' তৈরির মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন দেব আনন্দ। তার হাত ধরে অনেক তারকার আগমন হয়েছে বলিউডে। তিনি ১৯টি ছবি পরিচালনা করেন। তার পরিচালিত সর্বশেষ ছবি 'চার্জশিট' মুক্তি পায় গত সেপ্টেম্বরে। এ ছাড়া ১৩টি ছবির গল্পকারও তিনি। কিছুদিন আগে তিনি 'সংস অব লাইফ' নামে একটি চলচ্চিত্র পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত হন। মৃত্যুর কাছে তিনি হেরে যাওয়ায় তা অসম্পূর্ণই থেকে গেল।
চলচ্চিত্র শিল্পে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০১ সালে তাকে পদ্মভূষণ খেতাব দেয় ভারত সরকার। ২০০২ সালে মর্যাদাপূর্ণ 'দাদাসাহেব ফালকে' সম্মাননাও পান তিনি। এ ছাড়া 'কালাপানি' ও 'গাইড' ছবিতে অভিনয়ের জন্য ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান। ১৯৯১ সালে ফিল্মফেয়ার তাকে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করে। তার আত্মজীবনী 'রোমান্সিং উইথ লাইফ' প্রকাশ হয় ২০০৭ সালে। ৮৮ বছরে পদার্পণ করে তিনি বলেছিলেন, '২০ বছর বয়সে যেমন উচ্ছ্বাস হতো, এখনও আমার মনটা তেমনই আছে।'

No comments

Powered by Blogger.