বিদায় সক্রেটিস

মৃত্যু তাঁর প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। তবে ওই মহান গ্রিক দার্শনিকের আদর্শের রেশ এখনো হীরকখণ্ডের মতোই দীপ্তিময়। সক্রেটিস নামে সেই একজনকেই চিনত বিশ্ব। গত শতকের আশির দশক কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর নামেরই আরেকজন। তেমনই শ্মশ্রুমণ্ডিত, তেমনই মেধার ঝলকে_তবে পার্থক্য হলো, এই সক্রেটিস আলো ছড়িয়েছেন দর্শনে না, ফুটবলে। কিংবদন্তির নামে ভাগ বসানো ওই মহান ফুটবলারের জীবনাবসানও হয়ে গেল কাল।


৫৭ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া কাটালেন ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা এ মিডফিল্ডার।শরীরটা তাঁর ভালো যাচ্ছিল না বেশ কিছুদিন ধরেই। অতিরিক্ত মদপানের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় অসুস্থ হয়ে আগস্টে ৯ দিন হাসপাতালে ছিলেন সক্রেটিস। পরের মাসে আবার ১৭ দিন। এ দফায়ও আলবার্ট আইনস্টাইন ইসরায়েলি হাসপাতালে শয্যা নিয়েছিলেন গেল বৃহস্পতিবার থেকে। ডাক্তারদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে কাল সক্রেটিস পাড়ি জমালেন অচেনা ভুবনে।
সক্রেটিস ব্রাসিলেইরো সাম্পাইয়ো দি সৌজা ভিয়েইরা দি অলিভেইরা। নামটা বিশাল, তবে শুধু সক্রেটিস নামেই হয়েছিলেন পরিচিত। গড়পড়তা ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারের মতো নন, তিনি জন্মেছিলেন সচ্ছল পরিবারে। ফুটবলের পাশাপাশি পড়াশোনাও তাই চালিয়ে গেছেন নিয়মিত। এই করতে করতে একসময় পুরোদস্তুর চিকিৎসকের ডিগ্রিও পেয়ে গেলেন। কিন্তু তত দিনে যে ফুটবল মিশে গেছে অস্থি-মজ্জায়। আর ফুটবল দেবতাও তো ঠিক করে রেখেছিলেন সক্রেটিসের গতিপথ।
সেই পথে তাঁর অর্জন অসংখ্য। ধ্রুপদী প্লে-মেকার ছিলেন, মৌমাছির চোখ দিয়ে পুরো মাঠটা যেন দেখতে পেতেন একসঙ্গে। ব্লাইন্ড হিল পাস ছিল ট্রেডমার্ক, ওই ব্যাকহিলে কত গোল যে করেছেন ও করিয়েছেন! দাড়ি-গোঁফ আর হেডব্যান্ড দিয়ে সহজেই চেনা যেত সক্রেটিসকে। বোতাফোগো দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু হলেও আলো ছড়ানো শুরু করেন করিন্থিয়ান্সে এসে। '৭৮ থেকে '৮৪_ক্যারিয়ারের স্বর্ণসময়ের এই ছয়টি মৌসুম খেলেছেন সেখানে। এরপর ইউরোপে গিয়ে ইতালির ফিওরেন্তিনায় এক মৌসুম। মন টেকাতে পারেননি। ব্রাজিলে ফিরে ফ্ল্যামেঙ্গো, সান্তোস হয়ে ১৯৮৯ সালে আঁতুড়ঘর বোতাফোগোয় ফিরে নেন অবসর। দেড় দশক পর এই সক্রেটিস আবার ফিরেছিলেন মাঠে। ২০০৪ সালে ইংল্যান্ডের নর্দার্ন ফুটবল ইস্ট ফুটবল লিগের ক্লাব গারফোর্থ টাউনের হয়ে মাঠে নেমেছিলেন কেবল একটি ম্যাচে, মিনিট বারোর জন্য।
ফুটবল বিশ্ব সক্রেটিসকে মনে রেখেছে ১৯৮২ বিশ্বকাপে ব্রাজিল দলের অধিনায়ক হিসেবে। সক্রেটিস-জিকো-ফ্যালকাওয়ের সেই দলটিকে অনেকেই মানেন, বিশ্বকাপ না জেতা ইতিহাসের সেরা দল হিসেবে। ওই ব্রাজিলের আর্মব্যান্ড ছিল সক্রেটিসের হাতে। ব্রাজিলের হয়ে ৬০ ম্যাচ খেলে করেছেন ২২ গোল। ১৯৭৯ সালে শুরু করেছিলেন, '৮৬-এর বিশ্বকাপের পরই অবসর। শেষ ম্যাচে ফ্রান্সের বিপক্ষে পেনাল্টি মিস হয়ে আছে জীবনের বড় আক্ষেপ। করিন্থিয়ান্সে, বোতাফোগোর হয়ে ভূরি ভূরি সাফল্য কিংবা ১৯৮৩ সালে দক্ষিণ আমেরিকার বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার ছাড়িয়ে সেই আক্ষেপ সক্রেটিসকে পুড়িয়েছে শেষ দিন পর্যন্ত।
খেলা ছাড়ার পর চিকিৎসক হিসেবে প্র্যাকটিস করেছেন নিয়মিত। এরপর শুরু করেন পত্রপত্রিকায় কলাম লেখা। ফুটবল না, রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়েও লিখেছেন অনেক। সমান্তরালে মদপানটা চালিয়ে যাচ্ছিলেন নিয়ম করে। শেষ পর্যন্ত সেটিই হলো কাল! ব্রাজিলের '৯৪-এর বিশ্বকাপ অধিনায়ক রাই-এর বড় ভাইকে তাই কাল আশ্রয় নিতে হলো মৃত্যুর কোলে।
স্বভাবতই এমন মৃত্যুতে শোকের চাদরে ঢেকে গেছে ব্রাজিলের ক্রীড়াঙ্গন। উত্তরসূরি কিংবদন্তি রোনালদো যেমন বলেছেন, 'ভীষণ খারাপভাবে শুরু হলো দিনটা। শান্তিতে ঘুমাও ডা. সক্রেটিস।' সাবেক বিশ্বসেরা টেনিস খেলোয়াড় গুস্তাভো কুয়ের্তেনও মুহ্যমান, 'তিনি টেনিস ভালোবাসতেন, ডেভিস কাপের কয়েকটি ম্যাচ দেখতে এসেছিলেন স্টেডিয়ামে। তাঁকে আমরা সবাই মিস করব।'
সক্রেটিসকে আসলে মিস করবে পুরো বিশ্বই! তাঁর নামের দার্শনিককে যেমন করে এখনো। মৃত্যুর আড়াই হাজার বছর পরও! ওয়েবসাইট

No comments

Powered by Blogger.