পদ্মা সেতু প্রকল্পঃ সরকারের বক্তব্য গ্রহণ করেনি বিশ্বব্যাংক by শওকত হোসেন

দ্মা সেতু নিয়ে সরকারের বক্তব্য গ্রহণ করেনি বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি জানিয়ে দিয়েছে, বৃহৎ এই প্রকল্পের দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারকে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সেটাই এখন জানতে চাইছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী ও অর্থ উপদেষ্টা ছাড়াও দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) চিঠির জবাব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অর্থমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারের পদক্ষেপ জানতে চাওয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমানকে দেওয়া চিঠিতে সন্দেহভাজন কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করার সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। আর দুদককে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির তথ্য দিয়েছে। সরকারের একাধিক সূত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে। আর চিঠি পাওয়ার কথা দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান নিশ্চিত করেছেন।
সূত্র জানায়, সরকার ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে চিঠি চালাচালি অব্যাহত থাকলেও তাতে সমস্যার কোনো সমাধান হচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া চিঠিগুলোতে দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো তথ্য নেই। আবার দুদকের তদন্তেও উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই; বরং দুদক যোগাযোগমন্ত্রীকে আড়াল করে লোক দেখানো তদন্ত করছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন। তাই পদ্মা সেতু-পরিস্থিতি সেই আগের মতোই অনিশ্চিত হয়ে রয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের মূল অভিযোগ যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে। যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া পর্যন্ত পদ্মা সেতুর কাজ এগোবে না। বিশ্বব্যাংক সরকারের নেওয়া পদক্ষেপে সন্তুষ্ট হলেই কেবল সাহায্য বিতরণের সিদ্ধান্ত নেবে বলে লিখিতভাবে জানিয়ে দিয়েছে। এ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নতুন করে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। পাল্টা বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারা যোগাযোগমন্ত্রী বদল হচ্ছেন কি না, তা এই প্রতিবেদকের কাছে জানতে চেয়েছেন।
তবে যোগাযোগমন্ত্রী সব অভিযোগ অস্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভুল তথ্যে বিভ্রান্ত হয়েছে বিশ্বব্যাংক। এ নিয়ে একটি অভ্যন্তরীণ তদন্তকারী দল বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধেই এখন তদন্ত করছে। আমি নিশ্চিত, তদন্ত শেষে বেরিয়ে আসবে যে আমরাই সঠিক।’
পদ্মা সেতু নিয়ে সরকার একটি প্রেসনোট জারি করে গত ২০ অক্টোবর। এর পরই এই সেতু নিয়ে সরকারের অবস্থান বর্ণনা এবং কিছু প্রস্তাবসংবলিত দুটি চিঠি দেওয়া হয় বিশ্বব্যাংককে। চিঠি দুটি লেখেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান। উভয় চিঠিতেই বিষয়টি নিয়ে দুদক তদন্ত করছে বলে জানানো হয়। এরপর আরেকটি চিঠি লেখে দুদক। সব চিঠিরই জবাব দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এর মধ্যে গত মাসে অর্থমন্ত্রীকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। আর সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক চিঠি দিয়েছে অর্থ উপদেষ্টা ও দুদককে।
দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমানকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, কানাডিয়ান কোম্পানি এসএনসি লাভালিনকে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে কাজ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে একাধিক কর্মকর্তা কোম্পানিটির কাছে কমিশন চান। পরামর্শক হিসেবে কাজ পাওয়ার পর এই কাজের বিনিময়ে যে অর্থ পাওয়া যাবে, তা থেকে একটি অংশ কমিশন হিসেবে চাওয়া হয়। এ বিষয়ে কোম্পানি সম্মত হলে উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতাও হয়। এই চিঠিতে অবশ্য কোনো কর্মকর্তার নাম বা পরিচয় বলা হয়নি।
তবে বিশ্বব্যাংক এর আগে যে তদন্ত প্রতিবেদন সরকারকে দিয়েছে, তাতে বলা আছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিভিন্ন কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য ঘুষ বা কমিশন চেয়েছেন সৈয়দ আবুল হোসেনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সাকো ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধিরা। সৈয়দ আবুল হোসেনের নাম ব্যবহার করে অর্থ চাওয়া হয়েছে। কমিশন দিলে কাজ পেতে যোগাযোগমন্ত্রী নিজেই সহায়তা করবেন বলেও আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংককে পাঠানো চিঠির জবাব পেয়েছেন বলে জানান দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘চিঠির উত্তর আমরা পেয়েছি। তবে কানাডিয়ান পুলিশ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এখনো কোনো উত্তর পাইনি।’ যোগাযোগমন্ত্রীকে তলব করা হবে কি না, প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মন্ত্রীকে তলব করা বা তাঁর বক্তব্য নেওয়ার জন্য তদন্তে এখন পর্যন্ত যথাযথ কোনো তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করা সম্ভব হয়নি।
তবে সূত্র জানায়, কোনো মন্ত্রীকে তলব করার মতো অবস্থান এখনো দুদক তৈরি করতে পারেনি। ফলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকার পরও দুদক যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুঠোফোনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পদ্মা সেতু বিষয়ে মন্ত্রী বা যে কেউ দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হলে বর্তমান দুদক আইন অনুযায়ী কমিশন তাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পারে। এতে কোনো আইনগত বাধা নেই, যদি না রাজনৈতিক বা অন্য কোনো প্রভাব পেছনে থাকে। আর কমিশনের কাজে কোনো প্রভাব বাধা হয়ে দাঁড়ালে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
জানা গেছে, দুদক কেবল দুর্নীতির তথ্য চেয়ে চিঠি দিলেও অর্থমন্ত্রী ও অর্থ উপদেষ্টার চিঠিতে নতুন একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়। মূলত সরকারের জারি করা প্রেসনোটের বক্তব্যই ছিল দুই চিঠিতে। প্রস্তাবটি হলো, এসএনসি লাভালিনকে কালো তালিকাভুক্ত করে অন্যদের মধ্য থেকে পরামর্শক নিয়োগের দরপত্র চূড়ান্ত করা। নীতিবহির্ভূত কাজ করার অভিযোগে এসএনসি লাভালিনের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে কানাডা সরকার।
তবে বাংলাদেশের এ প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। মসিউর রহমানকে লেখা চিঠিতে বিশ্বব্যাংক বলেছে, এসএনসি লাভালিনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে। তদন্ত শেষে এ বিষয়ে সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত এসএনসি লাভালিনকে পরামর্শক নিয়োগ-প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়া বা কালো তালিকাভুক্ত করা যাবে না।
সরকারের একটি উচ্চ পর্যায়ের সূত্র জানায়, অর্থমন্ত্রীকে দেওয়া চিঠিতে বিশ্বব্যাংক বলেছে, পদ্মা সেতু নির্মাণ-প্রক্রিয়ায় যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে, তদন্ত করে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি বৃহৎ এই প্রকল্পে সম্ভাব্য দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকার কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়, তা-ও ঠিক করতে হবে। এ বিষয়ে সরকার চাইলে বিশ্বব্যাংক কারিগরি সহায়তা দিতে রাজি আছে।
বিশ্বব্যাংকের চিঠি পাওয়ার পর সরকারের কারও পক্ষ থেকেই কোনো জবাব দেওয়া হয়নি। তাই বন্ধ হয়ে আছে পদ্মা সেতুর সব ধরনের কাজ।
পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংক প্রথম আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করেছিল গত ২১ সেপ্টেম্বর। বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি প্রতিরোধসংক্রান্ত সংস্থা ইন্টেগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্সি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে একটি চিঠি দিয়ে যোগাযোগমন্ত্রী ও তাঁর মালিকানাধীন কোম্পানি সাকো ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির বিবরণ দেয়। এ সময় সংস্থাটি জানিয়ে দেয়, জালিয়াতি ও দুর্নীতির বিষয়টির সুরাহা না হলে এ প্রকল্পে তারা অর্থায়ন করবে না। ২৯০ কোটি ডলার ব্যয়ের পদ্মা সেতুতে ১২০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার কথা বিশ্বব্যাংকের। একই কারণে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ অন্য দাতারাও অর্থ ছাড় আটকে রেখেছে।

No comments

Powered by Blogger.