কেমন আছ মা-লাশ না পাইয়া নদীতে গায়েবানা জানাজা দিছি-সবুরা বিবি

বিজয়ের ৪০ বছর পূর্ণ হচ্ছে এই ডিসেম্বরে। দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গকারী শহীদদের মায়েরা কেমন আছেন, তা নিয়েই ধারাবাহিক এই আয়োজনভাত খাইতে খাইতে মালেক কইলো, মা এইডা চিনেন? এইডার নাম গ্রেনেড। আইজকা ওই রাজাকারডারে (হুমায়ুন রাজাকার) উড়াইয়া দিমু। বিকেলে খবর পাইলাম, অন্য মুক্তিযোদ্ধাগো না পাইয়া রাজাকার হুমায়ুন মিয়ার ওপর একাই গ্রেনেড ছুইড়া মারে মালেক।
গ্রেনেডডা হের গায়ে না লাইগা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। রাজাকারের লোকেরা ধাওয়া করলে সে দৌড় দেয়। দৌড়ানোর একপর্যায়ে সে পইড়া যায়, তার সঙ্গে থাকা আরেকটা গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়; ব্যাংচোরা নামের একটা জায়গায় গুরুতর আহত হয় দুঃসাহসী মালেক। ওইখান থিক্যা টাইন্যা-হিঁচড়াইয়া বাহাদুরপুর বাজারে আমার পোলারে নিয়া যায় রাজাকাররা। দড়ি দিয়া গাছে ঝুলাইয়া রাইখ্যা, পানির বদলে মুত (প্রস্রাব) খাওয়াইয়া নির্মমভাবে অত্যাচার কইরা আমার পোলারে কই নিয়া গেছে রাজাকাররা আর খবর পাই নাই।
আমার স্বামীর নাম হালিম মাতবর। পোলা একদিন ফিইরা আসব_তিনিও এই অপেক্ষা করতেন। রাজাকারের ওপর হামলা চালানোর ওই সাহসী কাজের জন্য পোলারে লইয়া গর্ব করতেন। বছর দেড়েক আগে উনি মারা গেছেন। আমার সাত ছেলে এক মেয়ের মধ্যে সবার বড় ছিল আবদুল মালেক। সে ছিল ছাত্রনেতা। শিবচর সরকারি বরহামগঞ্জ কলেজে ডিগ্রিতে পড়ার সময় সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। আমাদের বাড়িতেই মুক্তিযোদ্ধারা ভারত থিক্যা প্রশিক্ষণ শেষে প্রথমে আশ্রয় নেয়। আমার বীর পোলা অনেক সম্মুখযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। যুদ্ধ শুরু হলে শিবচরের কুখ্যাত রাজাকার বাহাদুরপুরের হুমায়ুন মিয়ার প্ররোচনায় হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকারদের অত্যাচার বাইড়া যায়। শিবচরে ১৭ মে ও পরে কয়েক দফায় হামলা চালাইয়া হত্যা করে অন্তত ৩০ জন মানুষরে। চলে লুটপাট, অসংখ্য নারী ধর্ষণের শিকার হয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা সিদ্ধান্ত নেয়, ১৮ শ্রাবণ রাজাকার হুমায়ুনরে হত্যার জন্য হামলা চালানো হবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক ওই দিন নির্ধারিত সময়েই আবদুল মালেক বাহাদুরপুরে পেঁৗছায়। কিন্তু ততক্ষণে অন্য মুক্তিযোদ্ধারা না পেঁৗছায় একাই দুইডা গ্রেনেড দিয়া অভিযান শুরু করে মালেক। একটা গ্রেনেড ছুড়লে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ওই সময় রাজাকারের সহযোগীরা মালেকরে ধাওয়া করলে সে দৌড় দেয়। দৌড়ানোর একপর্যায়ে পইড়া গেলে সঙ্গে থাকা আরেকটা গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়, গুরুতর আহত হয় মালেক। রাজাকাররা মালেকের হাত-পা দড়ি দিয়া বাইন্ধা গাছের সঙ্গে ঝুলাইয়া নির্মম নির্যাতন চালায়। ক্ষতবিক্ষত মালেক পানি খাইতে চাইলে রাজাকাররা মুত খাওয়ায় আমার বীর পোলারে। এরপর মুমূর্ষু মালেকরে লঞ্চে কইরা মাদারীপুরের দিকে নিয়া যায়। তারপর আর ফিইরা আসে নাই আবদুল মালেক। লোকমুখে জানতে পারি, আড়িয়াল খাঁ নদে হাত-পা বাইন্ধা ফালাইয়া দিছে আমার বীর পোলারে।
এই খবর পাইয়া আমার পরিবারের লোকজন নদীতে অনেক খোঁজাখুঁজি করে। লাশ না পাইয়া শেষমেশ নদীতেই গায়েবানা জানাজা দেয় তারা। কিন্তু মায়ের মন কি আর তাতে বুঝ মানে! ২৫ নভেম্বর রক্তক্ষয়ী সম্মুখযুদ্ধে শিবচর মুক্ত হয়। তারপরও আমার নিখোঁজ পোলারে খুঁজছি। পাই নাই। আইজও খুঁজি তারে, আমার মালেক এই আইলো বুঝি!
পোলারে খুঁজি, চোখের জল ফেলি। ওরা আমার পোলার লাশটাও দেয় নাই। যে লঞ্চে আমার মালেকরে নিয়া গেছিল, সেই লঞ্চের মাস্টার কইছিল, হানাদার বাহিনী লাশ মাদারীপুরের কাছে কালিয়াকৈরের কাছে আড়িয়াল খাঁয় ফেলাইছে। গাঁওয়ের মৌলবি কইয়া দিছিল, লাশ না পাইলে গায়েবানা জানাজা দিতে। আমরা অনেক খোঁজাখুঁজির পর লাশ না পাইয়া, ওই নদীতেই গায়েবানা জানাজা দিছি। 'মা, মাগো ভাত দাও'_মালেকের এই ডাক আমি প্রায় দিনই শুনি। আমার মালেক এহনও মরে নাই। ও দেইখ্যো আইবো, আমার নাড়িছেঁড়া ধন আইবোই।
কত দিন হইয়া গেল, আমার পোলারে আমি ভুলতে পারি না। কিন্তু অন্য কেউ তো মনে রাখে না। আবদুল মালেকের স্মৃতি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ কেউ নেয় নাই।
সবুরা বিবি : মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার মাতবরচর ইউনিয়নের বাখরেরকান্দি গ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মালেকের মা।
অনুলিখন : প্রদ্যুৎ কুমার সরকার, শিবচর (মাদারীপুর) প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.