মা ছিলেন কোচের মতোই

নিজে না খেয়ে ছেলেমেয়েদের খেতে দেওয়ার আনন্দ আর অভাবী সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে ক্ষুধা লুকাতে গিয়ে পেটের পীড়ায় পড়ার ঘটনাও হয়তো মিলে যাবে বাংলাদেশের অনেক মায়ের সঙ্গে। ৩৫ বছর আগে যেমনটা হয়েছিল আর্জেন্টিনার ভিয়া ফিয়োরিতো শহরের একটি নিম্নবিত্ত পরিবারে। পাঁচ মেয়ে আর তিন ছেলেকে নিয়ে অভাবের সংসার টানতে হতো ম্যারাডোনার মা দালমা সালভাদোরা ফ্রাঙ্কোকে। স্বামী দিয়েগো ম্যারাডোনা সিনিয়র কারখানার ছোট
একটা চাকরি করতেন। অভাবী সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার জন্য দালমা সালভাদোরা চেয়েছিলেন ম্যারাডোনাকে কোনো অফিসের হিসাবরক্ষক বানাতে। মায়ের মৃত্যুর পর সে সব কঠিন দিনের কথাই স্মৃতিচারণ করেছেন ম্যারাডোনা। 'মা আমাদের সব ভাইবোনকে খেতে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। যখন আমাদের খাওয়া শেষ হতো, তখন জিজ্ঞেস করতাম, মা তুমি খাবে না। হেসে উত্তর দিতেন, আমি খেয়েছি এখন ক্ষুধা নেই। তখন আমার মাত্র ১৩ বছর বয়স। মায়ের লুকোনো সত্যটা তখনও জানতাম না। এরপর মা যখন পেটের অসুখে হাসপাতালে ভর্তি হন তখনই শুনতে পেলাম, না খেতে খেতে পেটে অসুখ হয়েছে। কষ্ট লেগেছিল ভীষণ; কিন্তু কিছু করার ছিল না আমার। আমি তখন খুব ছোট ছিলাম। মা মিথ্যা বলতেন, কারণ মায়ের খাওয়ার জন্য যথেষ্ট খাবার থাকত না ঘরে। কী মধুর মিথ্যে কথা! আমি এ মানুষটিকে ভীষণ ভালোবাসি।' আর্জেন্টিনার একটি দৈনিকে এভাবেই ছেলেবেলায় মায়ের কাছে থাকার কথা স্মরণ করেছেন ম্যারাডোনা।
মাঝের জীবনটা এমন ছন্নছাড়া কেটেছে যে, নিজের পরিবারের দিকে খেয়ালই রাখতে পারেননি দিয়েগো ম্যারাডোনা। ফুটবল ছাড়ার পর মাদকের নীল নেশায় এতটাই বুঁদ হয়েছিলেন যে, কয়েকবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন। তখন প্রিয় মানুষদের মধ্যে ম্যারাডোনার মা দালমা সালভাদোরা ফ্রাঙ্কো ছেলের পাশে ছিলেন। আর্জেন্টিনার মানুষ এই রত্নগর্ভাকে 'দোনা টোটা' বলেই ডাকতেন। ৮১ বছর বয়সে গত মাসেই মারা গেছেন দোনা টোটা। পাঁচ মেয়ে আর তিন ছেলের মধ্যে ম্যারাডোনাও এসেছিলেন মায়ের অন্তিম সৎকারে। দুবাইয়ের আল ওয়াসেল ক্লাবের কোচ ম্যারাডোনার জন্য মায়ের চলে যাওয়াটা ছিল বেশ কষ্টের। কারণ মা ছিলেন তার কাছে সত্যিকারের কোচের মতো। 'আমরা ভিয়া ফিয়োরিতোয় একটা গরিব পরিবারের মধ্যে থেকেই বড় হয়েছিলাম। আমাকে এবং আমার ভাইদের প্রচুর ভালোবাসা, করুণা আর শাসনের মধ্যে বড় করেছিলেন মা। সারা জীবন আমি যা-ই করেছি, তা সে খারাপ হোক বা ভালো, মা আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ঠিক একজন ভালো কোচের মতো, মা জানতেন কখন শাসন করতে হয় আর কখন সমর্থন করতে হয়। মা আমাকে সবসময় ইতিবাচক এবং সৎ পরামর্শ দিতেন। মা চাইতেন না আমি ফুটবলে আসি। কখনও কখনও মাঠেও যেতে দিতেন না; কিন্তু যখন খেলা শুরু হতো তার কিছু আগে ঠিকই বলতেন, গিয়ে গোল করে আসো। কখনও কখনও তিনিও আমার সঙ্গে মাঠে যেতেন। মায়ের মৃত্যুর পর যে সব বন্ধু আমার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন, তার জন্য ধন্যবাদ।'

No comments

Powered by Blogger.