বাংলাদেশের ২২ সেঞ্চুরির গল্প

বাংলাদেশের ১১তম ব্যাটসম্যান হিসেবে পরশু ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি করলেন নাসির হোসেন। ১৯৯৯ সালে মেহরাব হোসেনের প্রথম সেঞ্চুরির পর ওয়ানডে ইতিহাসে এ নিয়ে ২২টি সেঞ্চুরি পেল বাংলাদেশ। সেই গল্পই শোনাচ্ছেন রাহেনুর ইসলামপ্রথম সেঞ্চুরি ৩০তম ম্যাচে২৫ বছর, ২৫৭ ম্যাচ, ৭০ জয়, ১৮৫ হার আর ২২টি সেঞ্চুরি_সংক্ষেপে এই হচ্ছে বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাস। ২২ বছরের ক্যারিয়ারে ৪৫৩টি ওয়ানডেতে শচীন টেন্ডুলকারের সেঞ্চুরি ৪৮টি।


সেখানে ২৫ বছরে পুরো বাংলাদেশ দলের তিন অঙ্কের ইনিংস মাত্র ২২! ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতার ছবিটা পাওয়া যায় এখানেই। ২৫-৩০-কে ফিফটি আর ৬০-৭০ রানের ইনিংসগুলো তিন অঙ্কে পরিণত করতে না পারার ব্যর্থতা আর অধারাবাহিকতার কারণেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখার ২৫ বছর পরও বাংলাদেশ 'ছোট' দল। এখনো মুশফিক-সাকিবদের কাছে হারটা তাই পেনাল্টিতে গোল করতে না পারার মতো ব্যর্থতাই মনে করে ক্রিকেট পরাশক্তিরা!
ওয়ানডেতে বাংলাদেশের ২২ সেঞ্চুরির প্রথমটি আসে ৩০তম ম্যাচে, ১৯৯৯ সালের ২৫ মার্চ। বাংলাদেশ, কেনিয়া, জিম্বাবুয়েকে নিয়ে অনুষ্ঠিত 'মেরিল ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট টুর্নামেন্ট'-এর ষষ্ঠ ম্যাচে তিন অঙ্কের সেই ম্যাজিক ফিগারে দেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে নাম লেখান মেহরাব হোসেন (অপি)। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ম্যাচটিতে শাহরিয়ার হোসেন-মেহরাব হোসেনের উদ্বোধনী জুটিতে বাংলাদেশ পায় ১৭০ রান। ৬৮ করে শাহরিয়ার ফিরলেও মেহরাব ফেরেন সেঞ্চুরি করেই। বাংলাদেশ ক্রিকেটে তখন পর্যন্ত অচেনা সেই মাইলফলকে নাম লেখানোর পর অবশ্য বেশিক্ষণ ক্রিজে থাকতে পারেননি সুদর্শন এ ওপেনার। ১১৬ বলে ৯ বাউন্ডারি ও ২ ছক্কায় ১০১ করে অ্যাডাম হাকলের বলে ক্যাচ দেন ডার্ক ভিলজোয়েনকে। অপির ঐতিহাসিক সেই সেঞ্চুরিও অবশ্য জয় এনে দিতে পারেনি বাংলাদেশকে। আমিনুল ইসলামের দলের ২৫৭ রান ৩ বল আর ৩ উইকেট হাতে রেখে পেরিয়ে যায় জিম্বাবুয়ে।
নিজের পঞ্চম ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি করে অমিত সম্ভাবনা জাগানো মেহরাবের ওয়ানডে ক্যারিয়ার থেমে গেছে ১৮ ম্যাচে ৪৪৯ রান করেই। এই সেঞ্চুরিটার সঙ্গে দুটি ফিফটিও আছে সাবেক এ ওপেনারের।
তারপর ছয় বছরের অপেক্ষা
বাংলাদেশের ক্রিকেটে মোহাম্মদ আশরাফুল একই সঙ্গে বিপুল প্রত্যাশা আর হতাশার প্রতিচ্ছবি! ২০০১ সালে সবচেয়ে কম ১৭ বছর ৬১ দিন বয়সে টেস্ট সেঞ্চুরি করে সুবাস ছড়ানো শুরু তাঁর। সেই সৌরভে সুশোভিত হওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের। কিন্তু হায়! অধারাবাহিকতা আর নিজের প্রতিভা কাজে লাগাতে না পেরে বারবার হতাশ করেছেন সেই আশরাফুলই। এ কারণে বয়স মাত্র ২৭ হলেও অনেকেই আজকাল বলে ফেলছেন, 'ওকে যথেষ্ট সুযোগ দেওয়া হয়েছে, আর নয়।'
সেই আশরাফুলের ব্যাটেই ছয় বছর পর ওয়ানডেতে দ্বিতীয় সেঞ্চুরিটা পায় বাংলাদেশ। সে সময়ের প্রতাপশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে করা সেঞ্চুরিটা আবার বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা ইনিংস। কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়ার ২৪৯ রানের জবাবে ব্যাট করতে নেমে চতুর্থ উইকেটে হাবিবুল বাশারের সঙ্গে ১৩০ রানের জুটি গড়েছিলেন এ মিডলঅর্ডার ব্যাটসম্যান। জয়ের ভিতটা গড়া হয় তাতেই। ৯৫ বলে ৯২ রান নিয়ে ৪৭তম ওভারে গ্লেন ম্যাকগ্রার মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। প্রথম বলটাই বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে স্কোরটা নিয়ে যান ৯৬-এ। সেই ওভারে দুটি সিঙ্গেলস আর একটি ডাবল নিয়ে দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন আশরাফুল। দুই হাত শূন্যে তুলে সেঞ্চুরি উদ্যাপন করা আশরাফুলকে অভিনন্দন জানান রিকি পন্টিং, ম্যাকগ্রারাও। সেঞ্চুরি করার পরের বলেই অবশ্য গিলেস্পি ফিরিয়ে দেন আশরাফুলকে। বাংলাদেশ জয়বঞ্চিত হয়নি তাতেও। আশরাফুলের ১০১ বলে ১১ বাউন্ডারিতে করা ১০০-এর ওপর ভর করে ৪ বল বাকি থাকতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয়টি পায় বাংলাদেশ।
দেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি সাকিবের
১৯৮৬ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত মাত্র দুটি সেঞ্চুরি পেয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ২০০৫ থেকে ২০১১_এই ছয় বছরে এসেছে আরো ২০টি। ওয়ানডে অলরাউন্ডারদের র‌্যাংকিংয়ে শীর্ষে থাকা সাকিব আল হাসান করেছেন সর্বোচ্চ ৫টি সেঞ্চুরি। ৫ সেঞ্চুরির প্রথমটি করেন ২০০৭ সালে অ্যান্টিগার সেন্ট জোন্সে কানাডার বিপক্ষে। সেই ম্যাচে করা সাকিবের অপরাজিত ১৩৪ আবার বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। নিজের ২০তম ওয়ানডেতে প্রথম সেঞ্চুরি করা সাকিব আরো চারটি তিন অঙ্কের ইনিংস পেয়েছেন ২০০৮ সালে মুলতানে পাকিস্তানের বিপক্ষে (১০৮), ২০০৯ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বুলাওয়েতে (১০৪), ২০০৯ সালে মিরপুরে জিম্বাবুয়ের সঙ্গে (১০৫*) আর সর্বশেষ গত বছর মিরপুরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে (১০৬)। এ ছাড়া ৪টি সেঞ্চুরি আছে শাহরিয়ার নাফিস, ৩টি করে তামিম ইকবাল ও মোহাম্মদ আশরাফুলের আর একটি করে নাসির হোসেন, মেহরাব হোসেন, রাজিন সালেহ, ইমরুল কায়েস, জুনায়েদ সিদ্দিকী, অলক কাপালি ও মুশফিকুর রহিমের।
তামিম দুটি কারণে এগিয়ে
সেঞ্চুরির পর ১০০ থেকে ১১৫ রানের মধ্যে থেমে গেছে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের পক্ষে করা ২২টি সেঞ্চুরির ১৬টিই। ১১৮ থেকে ১৩৪ রানের মধ্যে শেষ হয়েছে ৫টি। দেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ১৫৪ রানের ইনিংসটা তামিম ইকবালের। উইজডেনের সাবেক এ বর্ষসেরা ক্রিকেটারের বীরত্বে ২০০৯ সালের আগস্টে ৩০০ রানের বেশি তাড়া করে নিজেদের ইতিহাসের একমাত্র জয়টা পায় বাংলাদেশ। চার্লস কভেন্ট্রির অপরাজিত ১৯৪-এর সুবাদে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে জিম্বাবুয়ে করেছিল ৩১২ রান। জবাবে ১৩৮ বলে ৭ বাউন্ডারি ও ৬ ছক্কায় তামিমের ১৫৪-তে ১৩ বল বাকি থাকতে ৪ উইকেটের জয় পায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে কম বয়সে সেঞ্চুরির রেকর্ডটিও তাঁর। ২০০৮ সালে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ১২৯ রানের ইনিংসটি খেলার সময় তামিমের বয়স ছিল ১৯ বছর।
দ্রুততম সেঞ্চুরি সাকিবের
সর্বোচ্চ ৫ সেঞ্চুরির মতো দেশের পক্ষে ওয়ানডেতে দ্রুততম সেঞ্চুরিটির কৃতিত্বও সাকিব আল হাসানের। ২০০৯ সালে বুলাওয়েতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৬৩ বলে করা সেঞ্চুরিটা আবার ওয়ানডে ইতিহাসের দ্রুততম শতরানের তালিকায় ১২ নম্বরে জায়গা করে নিয়েছে। ৬৩ বলে ৮ বাউন্ডারি ও ৪ ছক্কায় সাকিব পেঁৗছেছিলেন ১০০-তে। ম্যাচটিতে ১০৪ রান করে রান আউট হয়ে ফিরেছিলেন তিনি। ২০০৯ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই মিরপুরে তিন অঙ্কে পেঁৗছেছিলেন মাত্র ৬৮ বলে। জিম্বাবুয়ের কাছে সাকিব তাই হয়ে আছেন আতঙ্কের নাম।
মেহরাব হোসেন অপি সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন তাঁর পঞ্চম ওয়ানডেতে। ক্যারিয়ার শুরুর পর ম্যাচের হিসেবে এটা বাংলাদেশি কোনো ব্যাটসম্যানের দ্রুততম সেঞ্চুরি। নাসির হোসেন নবম আর ইমরুল কায়েস সেঞ্চুরি পেয়েছেন দশম ওয়ানডেতে।
আউট করা যায়নি নাফিসকে
সেঞ্চুরি এমনিতেই বড় অর্জন। সেটা পরপর দুই ম্যাচে করতে পারাটা আরো বেশি কৃতিত্বের। একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে সেই কৃতিত্ব শাহরিয়ার নাফিসের। ২০০৬ সালের অক্টোবরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয়পুরে তিনি করেছিলেন অপরাজিত ১২৩। নিজের পরের ম্যাচে সেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই শুরু করেছিলেন যেন জয়পুরের শেষ করা ইনিংসটা থেকেই। সেই ম্যাচেও তিনি অপরাজিত থাকেন ১০৫ রানে। ৭৪ ওয়ানডের ক্যারিয়ারে নাফিসের সেঞ্চুরি ৪টি। ৪টির ৩টিই জিম্বাবুয়ে আর অপরটি বারমুডার বিপক্ষে। মজার ব্যাপার, ৪ সেঞ্চুরির কোনোটিতেই আউট করা যায়নি নাফিসকে!
বাংলাদেশের ২২ সেঞ্চুরি

No comments

Powered by Blogger.