মেয়র লোকমান হত্যাকাণ্ড-খুনিরা চিহ্নিত হয়েছে : ডিসি-যুবক আটক, কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ, খোকন কারামুক্ত by সুমন বর্মণ,

রসিংদীর জনপ্রিয় পৌর মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেনের হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে নরসিংদী পৌরসভা পরিষদ ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গতকাল রবিবার সকালে জেলা প্রশাসককে (ডিসি) স্মারকলিপি দিতে গেলে তিনি এমনটা দাবি করেছেন। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, শিগগির তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।


ডিসির এ বক্তব্যের পর সন্ধ্যায় গোয়েন্দা পুলিশ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে টিপ্পন কাজী (২৮) নামের এক যুবককে আটক করেছে। তিনি নরসিংদী শহরের কুমিল্লা কলোনির নূর মোহাম্মদ কাজীর ছেলে। পুলিশ জানায়, গোপালগঞ্জের গোপীনাথপুর থেকে টিপ্পনকে আটক করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে দুটি হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে ২১টি মামলা রয়েছে। লোকমান হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের সূত্র ধরে আটক করা সেলিমের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী টিপ্পনকে আটক করা হয়।
এ ছাড়া ঢাকায় আরো পাঁচজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। তবে পুলিশ বিষয়টি স্বীকার করেনি। একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। কোথায়, কী অবস্থায় তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, সেটা জানায়নি সূত্রটি।
এদিকে লোকমান হত্যার রাতে গ্রেপ্তার হওয়া বিএনপির কেন্দ্রীয় শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ও নরসিংদী জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য খায়রুল কবির খোকন গতকাল মুক্তি পেয়েছেন।
স্মারকলিপি দানকারীদের উদ্দেশে জেলা প্রশাসক ওবায়দুল আজম বলেন, 'পুলিশ লোকমান হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে দ্রুততার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। তদন্তে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিও হয়েছে। দুজন ডিআইজি নরসিংদীতে এসে তদন্তের অগ্রগতি দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। শিগগির তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।' তিনি আরো বলেন, 'আপনাদের আকুতির সঙ্গে আমিও একমত। লোকমানের মৃত্যুতে আমরা সবাই শোকাহত। সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের নির্দেশ মোতাবেক পুলিশ নিরপেক্ষভাবেই তদন্তকাজ করছে। কারো কাছে কোনো তথ্য থাকলে তা পুলিশ বিভাগ ও আমাদের জানিয়ে সহযোগিতা করবেন।'
একই দাবিতে গতকাল পুলিশ সুপার খ. মুহিদ উদ্দিনকেও স্মারকলিপি দেওয়া হয়। এ সময় পুলিশ সুপার বলেন, 'লোকমান হত্যা মামলায় আমাদের আন্তরিকতার অভাব নেই। আমরা অচিরেই এর তদন্তকাজ শেষ করব।'
এ সময় উপস্থিত ছিলেন নরসিংদী পৌরসভার প্যানেল মেয়র জহির আহমেদ, কাউন্সিলর আজিজুর রহমান আকতার, মোজাম্মেল হক, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফিরোজ সরকার, নির্বাহী প্রকৌশলী মনিরুজ্জামান, নরসিংদী পৌর কর্মচারী সংসদের সভাপতি সুজিত সাহা, সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান মিয়া, সাংগঠনিক সম্পাদক হোসাইন লিটন প্রমুখ।
সন্দেহভাজন যুবক আটক : গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি প্রসূন মণ্ডল গোপীনাথপুরের লোকজনের বরাত দিয়ে জানান, টিপ্পন সেখানে এক আত্মীয়র বাসায় অবস্থান করছিলেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে সাদা পোশাকের একদল লোক গাড়িতে তুলে তাঁকে নিয়ে যায়। তবে এ ব্যাপারে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ও গোয়েন্দা পুলিশ কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
নরসিংদীর পুলিশ সুপার খ. মুহিদ উদ্দিন সন্দেহভাজন যুবককে আটকের সত্যতা নিশ্চিত করে সাংবাদিকদের জানান, মেয়র লোকমান হোসেনকে হত্যা করে যাওয়ার সময় হত্যাকারীরা তাদের ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেল ফেলে চলে যায়। এর সূত্র ধরে চার দিন আগে টঙ্গী এলাকা থেকে সিরাজ উদ্দিনের ছেলে সেলিমকে আটক করা হয়। তাঁর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী গতকাল সন্ধ্যায় গোপীনাথপুর থেকে টিপ্পনকে আটক করা হয়েছে। তিনি লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন বলে সেলিম পুলিশকে জানিয়েছেন।
গত ১ নভেম্বর সন্ত্রাসীদের গুলিতে নরসিংদীর মেয়র লোকমান হোসেন নিহত হন। এ ঘটনায় নিহত মেয়রের ভাই কামরুজ্জামান বাদী হয়ে ১৪ জনের বিরুদ্ধে নরসিংদী সদর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ঘটনার ১৩ দিন অতিবাহিত হলেও এজাহারভুক্ত কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ।

খোকন কারামুক্ত
খায়রুল কবির খোকনকে গ্রেপ্তারের পর তাঁর বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করা হয়। এর একটিতে অব্যাহতি ও অন্য দুটিতে জামিন পাওয়ার পর গতকাল বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে তিনি নরসিংদী জেলা কারাগার থেকে মুক্তি পান। এ সময় তাঁকে স্বাগত জানান বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। এর আগে সকালে তিনি নরসিংদী রেলস্টেশন ভাঙচুর ও পোড়ানোর মামলায় জামিন পান।
সকালে নরসিংদীর প্রধান বিচারিক আদালতের বিচারক মো. শাহজাহানের আদালতে স্টেশন ভাঙচুরের মামলায় খায়রুল কবিরের জামিনের আবেদন করা হয়। এক ঘণ্টা শুনানির পর আদালত তাঁকে জামিন দেন। এ খবরে আদালতপাড়ায় উপস্থিত বিএনপিপন্থী আইনজীবী ও নেতা-কর্মীরা উল্লাসে ফেটে পড়েন।
খায়রুল কবির খোকনকে স্বাগত জানাতে গতকাল দুপুর থেকেই নরসিংদী জেলা কারাগারের ফটকের সামনে বিএনপি নেতা-কর্মীরা সমবেত হতে থাকেন। বিকেলে তাঁদের ভিড়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিকেল সাড়ে ৩টায় খোকন জেলা কারাগার থেকে মুক্তি পেলে নেতা-কর্মীরা তাঁকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেন। খায়রুল কবির খোকন মহাসড়কের পাশে চিনিশপুরে তাঁর বাসভবনে যাওয়ার পর মহাসড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
খোকন সন্ধ্যায় শহরের শালিদায় নরসিংদী পৌর কবরস্থানে নিহত পৌর মেয়র লোকমান হোসেনের কবর জিয়ারত এবং শোক বইয়ে স্বাক্ষর করেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের কয়েক শ নেতা-কর্মী ছিলেন। তিনি নিহত মেয়রের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করেন।
খোকন এ সময় সাংবাদিকদের বলেন, 'লোকমান ভিন্ন দলের নেতৃত্ব দেওয়া সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে আমার ভাইয়ের সম্পর্ক ছিল। এ নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের জন্য সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি আমরা। আমি সুস্থ রাজনীতির পক্ষে আজীবন সংগ্রাম করেছি। কিন্তু তাঁর এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা কোথায়?'
খোকন বলেন, 'লোকমান হত্যাকাণ্ডে সরকারি দলের বড় বড় নেতার সংশ্লিষ্টতার খবর এসেছে। বিএনপি-আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনৈতিক সংঘাত লাগিয়ে দিয়ে প্রকৃত হত্যাকারীদের আড়াল করতে আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়েছে।' তিনি হত্যাকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
জামিনের পর আদালত প্রাঙ্গণে খায়রুল কবির খোকনের আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, ঘটনার সময় খায়রুল কবির খোকন ঢাকায় অবস্থান করেছিলেন। এ পর্যন্ত তদন্তে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আদালত তাঁকে রেলস্টেশন ভাঙচুর ও পোড়ানোর মামলায় জামিন মঞ্জুর করেছেন।
খোকনের স্ত্রী মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা বলেন, এ রায়ের মধ্য দিয়ে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে ষড়যন্ত্রমূলক ও রাজনৈতিকভাবে খোকনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
 

No comments

Powered by Blogger.