শহীদ মিনারের লাল সূর্যের এক কারিগর by নওশাদ জামিল

হীদ মিনারের দিকে তাকালেই চোখে ভাসে লাল টুকটুকে এক সূর্য। এ সূর্য জানান দেয় শহীদদের রক্তভেজা আত্মত্যাগের, নতুন দিনের। প্রথম দিকে শহীদ মিনারের সঙ্গে এ প্রতীক যুক্ত ছিল না। পরে শহীদ মিনার বিনির্মাণের সময় এর পেছনে লাল সূর্য স্থাপনের প্রস্তাব করেন ভাষাসৈনিক শিল্পী ইমদাদ হোসেন। সবাই তাঁর এ প্রস্তাবে সায় দিলে শহীদ মিনারে ওঠে রক্তরাঙা প্রতীক লাল সূর্য।


রাষ্ট্রভাষা বাংলার অধিকার নিয়ে শুধু সরাসরি লড়াইয়েই নয়, ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিস্মারক শহীদ মিনারের নকশায় মূল স্তম্ভের পেছনে লাল সূর্যটি এসেছিল শিল্পী ইমদাদ হোসেনের উদ্যোগেই। কিন্তু এ তথ্য অনেকের কাছেই অজানা। ভাষার জন্য, সংস্কৃতির জন্য, মানুষের জন্য অনেকটা অন্তরালে থেকে কাজ করে গেছেন এ শিল্পী।
শিল্পীর বন্ধু ও সহযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নেপথ্যে থেকে কাজ করতেন তিনি। আত্মপ্রচারে ছিল বড় অনীহা। শিল্পীর বন্ধু ভাষাসৈনিক ড. আহমদ রফিক গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ইমদাদ ছিলেন নেপথ্যের নায়ক।
গ্রামাঞ্চলে মেলার সংস্কৃতি অনেক দিনের। তবে শহরে এ মেলার আয়োজন করা যায়, তা হয়তো অনেকেই ভাবতে পারেননি। সবাই যা ভাবেননি, তা ভেবেছিলেন শিল্পী ইমদাদ হোসেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে রাজপথের লড়াকু সৈনিক এই শিল্পীর উদ্যোগেই রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলা, বসন্ত মেলা, মধুমেলাসহ নানা উৎসবের।
প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয় বিশাল এক 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'। এখন বাঙালি সংস্কৃতির একটি বড় অনুষঙ্গ এটি। কিন্তু অনেকের কাছেই এ তথ্য জানা নেই যে, শোভাযাত্রার প্রধান উদ্যোক্তাদের তিনি অন্যতম। 'মঙ্গল শোভাযাত্রা' নামটিও তিনিই দিয়েছিলেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ টেলিভিশনের লোগোটি তাঁরই করা।
আমৃত্যু সংগ্রামী ছিলেন এ শিল্পী। ভাষা আন্দোলনের পরও নানা সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন তিনি। ১৯৬১ সালে ছায়ানট প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই শিল্পী ইমদাদ হোসেন ছিলেন সংগঠনটির একজন সক্রিয় সদস্য। ১৯৬৯ সালে স্বাধিকার আন্দোলনে তুমুল ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে শিল্পী কামরুল হাসানের সঙ্গে মিলে 'চারুশিল্পী সংস্থা' গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি।
শিল্পী ইমদাদ সারা জীবনই যুক্ত ছিলেন সৃষ্টিশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের শেষ দিকে তৎকালীন চারুকলা ইনস্টিটিউটের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষের শোভাযাত্রা শুরুর সময়েও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তিনি।
ব্যক্তি ইমদাদ হোসেন সম্পর্কে গ্যালারি চিত্রকের প্রধান নির্বাহী শিল্পী মনিরুজ্জামান গতকাল বলেন, 'তিনি সব সময় ছিলেন এককথার মানুষ। তাঁর মতো ভালো মানুষ খুব কমই আছেন এ সমাজে।'
১৯৬০ সালে ইস্ট পাকিস্তান ডিজাইন সেন্টারে নকশাবিদ হিসেবে পেশাজীবন শুরু করেন ইমদাদ। পরের বছরই শিল্প নির্দেশক হিসেবে যোগ দেন 'ইউএসএআইডি মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন সেন্টার'-এ। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতায় যোগ দেন তিনি। ১৯৬৬ সালে প্রধান নকশাবিদ হিসেবে কাজ শুরু করেন পাকিস্তান টেলিভিশনের ঢাকা কেন্দ্রে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ টেলিভিশনের লোগোর নকশা করেন শিল্পী ইমদাদ। ১৯৭৬ সালে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেন বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে।
১৯৭৬ সালেই যোগ দেন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনে (বিসিক)। ১৯৯১ সালে অবসরে যাওয়ার সময় তিনি ছিলেন এর প্রধান নকশাবিদ। এ সময় বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতির বিকাশ ও প্রসারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এ ছাড়া ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য তাঁর অবদান তো ভোলার নয়।
বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, পৃথিবীতে বাঙালি যত দিন থাকবে তত দিন শহীদ মিনারের লাল সূর্য অস্তমিত হবে না। তেমনিভাবে থাকবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। থাকবে উৎসব-মেলার ঐতিহ্য। নেপথ্যে থেকে এসব যিনি করেছেন তিনি শিল্পী ইমদাদ হোসেন। শহীদ মিনারের লাল সূর্যের মতো তাঁর অবদান কোনো দিন নিভে যাবে না ইতিহাস থেকে।

No comments

Powered by Blogger.