ভাষাসৈনিক শিল্পী ইমদাদ হোসেন-তাঁর স্মৃতি অমর হোক

বাংলাদেশের আকাশ থেকে আরেকটি নক্ষত্র কক্ষচ্যুত হলো, অসীমে হারিয়ে গেল। তিনি হলেন আমাদের সবার প্রিয় ইমদাদ ভাই। শিল্পী ইমদাদ হোসেন একজন ভাষাসৈনিক। কিন্তু এই মানুষটির প্রতিভা, মেধা, মনন ও গুণের যেন কোনো অভাব ছিল না। দেশের জন্য, সমাজের জন্য তাঁর যে অবদান, সাধারণ মানুষের জন্য তাঁর যে মমতা, সেসব কথা বলে শেষ করা যাবে না। গতকাল সকালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। আজ সকাল ১০টায় তাঁর মরদেহ সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তাঁরই স্মৃতিধন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে।


ইমদাদ ভাইয়ের মতো সদালাপী ও নিরহংকার মানুষ খুব কমই দেখা যায়। অবিভক্ত বাংলা বা ব্রিটিশ ভারতে জন্ম নেওয়া ইমদাদ হোসেন কৈশোর থেকেই ছিলেন প্রগতিশীল আন্দোলনের একজন অকুতোভয় সৈনিক। '৫২-এর ভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন একজন নেতৃস্থানীয় কর্মী এবং রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একজন সদস্য। কমিউনিস্ট পার্টি বা সংশ্লিষ্ট আন্দোলনের সঙ্গেও তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল কর্মের মধ্যেই। পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন কিংবা বিভিন্ন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠনের পোস্টার-ফেস্টুন প্রয়োজন? ছুটে যাও ইমদাদ ভাইয়ের কাছে। তাঁর ঘরে রাতভর চলত সেসব আয়োজন। বিটিভির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে শুরু করে এ দেশের উত্তাল গণসংগ্রামের দিনগুলোতে অসংখ্য মঞ্চসজ্জা, নাটকের শিল্পনির্দেশনা_সবকিছুতেই ছিল ইমদাদ ভাইয়ের জাদুকরী হাতের ছোঁয়া। '৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, '৬৯-এর গণআন্দোলন থেকে শুরু করে তাঁর জীবৎকালে গণমুখী এমন কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম নেই, যেখানে ইমদাদ ভাইয়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল না। '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক হিসেবেও তাঁর অবদান অসামান্য। স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার (বিসিক) 'চিফ ডিজাইনার' হিসেবে চাকরি নয়, নেশার মতো করে তিনি কাজে ডুবে থাকতেন। সন্তানতুল্য ভালোবাসায় তিনি সেখানকার তরুণ শিল্পীদের অনুপ্রাণিত করেছেন, গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। নিজে যেমন ছিলেন অত্যন্ত উঁচু মানের একজন শিল্পী, তেমনি তরুণদের উচ্চমানে নিয়ে যেতে তাঁর ছিল নিরন্তর প্রচেষ্টা। এটাকেও তিনি একটি সংগ্রাম হিসেবেই দেখতেন।
ইমদাদ ভাই ছিলেন অত্যন্ত উঁচু মানের প্রকৃতিবিদ। প্রাণী ও উদ্ভিদ সম্পর্কে তাঁর যে জানাশোনা ছিল, যে ভালোবাসা ছিল, তাও অত্যন্ত বিরল। কেরানীগঞ্জে তাঁর নিজ বাড়িটি ছিল পাখিদের একটি অভয়াশ্রম। বিশেষ করে সন্ধ্যায় চারদিক থেকে পাখিরা উড়ে এসে আশ্রয় নিত তাঁর বিশাল বাড়িটিতে থাকা গাছপালায়। গ্রামের ছেলেপেলেদের তিনি বোঝাতেন, তারা যেন পাখি বা বন্য প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ না করে। মানুষকে নির্বিচারে সাপ মারতে দেখলেও তিনি ব্যথিত হতেন। আলাপ করতেন, মানুষের মধ্যে থাকা এই অজ্ঞতা কিভাবে দূর করা যায়। কেবল মজা পেতেই তিনি উদ্ভিদের ফটোট্রাপিজম নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। বৃদ্ধকালেও শিশুর মতোই সরল ছিল এই মানুষটির মন। এমন একজন মানুষের অনুপস্থিতিকে মেনে নেওয়া সত্যিই বড় বেশি কষ্টকর।
মানুষ মরণশীল। শারীরিক বা নিজস্ব অবয়ব নিয়ে ইমদাদ ভাই আর আমাদের মধ্যে আসবেন না। কিন্তু মানুষ ইমদাদ ভাই, মানবদরদি ইমদাদ হোসেন চিরকালই আমাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন। তাঁর আরব্ধ কাজগুলোকে এগিয়ে নেওয়াটাই হবে তাঁর প্রতি আমাদের সবচেয়ে বড় শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। আমরা তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারকে গভীর সমবেদনা জানাই।

No comments

Powered by Blogger.