কৃষিবিজ্ঞানী হারাচ্ছে দেশ by আশরাফুল হক রাজীব

যে কৃষিবিজ্ঞানীদের অবদানে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, যাঁদের মেধার ফসলে ভরে উঠছে উত্তরাঞ্চলের মঙ্গাপীড়িত এলাকার শূন্য গোলা, যাঁদের উদ্ভাবিত লবণসহিষ্ণু ধান প্রাণ জাগিয়েছে দক্ষিণের বিস্তীর্ণ লোনাভূমিতে; সেই কৃষিবিজ্ঞানীরা আজ হতাশ। পেশাজীবনে নানা বঞ্চনার শিকার হয়ে তাঁদের অনেকে পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশে। কেউ বা চাকরি ছেড়ে যোগ দিচ্ছেন অন্য পেশায়। আর যাঁরা সে রকম পারছেন না, তাঁরা ফেলছেন দীর্ঘশ্বাস। এভাবে দেশ ও জাতি হারাচ্ছে অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে তৈরি করা সব সোনালি সম্ভাবনা।


জানা গেছে, প্রতি মাসেই কোনো না কোনো বিজ্ঞানী কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট, পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কৃষিবিজ্ঞানীরা চাকরি ছাড়ার কারণে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগটি কার্যত নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছে। যাঁরা চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন, তাঁদের বিকল্প তৈরি হয়নি। গত মাসেও কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ছেড়েছেন তিন বিজ্ঞানী। ২০ বছর চাকরি করার পর তাঁরা মাত্র একটি পদোন্নতি পেয়েছেন। চাকরির বয়সসীমা ৫৭ বছর হওয়ায় তাঁরা ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। বেশি বেতনে তাঁরা যোগ দিয়েছেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক পদে। যাঁরা গবেষণা পেশা ছেড়ে অধ্যাপনায় যোগ দিয়েছেন তাঁরা হলেন ড. মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস, ড. নজরুল ইসলাম ও ড. শহিদুল ইসলাম। এ ছাড়া গত ১০ বছরে দুই শতাধিক কৃষিবিজ্ঞানী বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ছেড়ে চলে গেছেন বলে জানা গেছে। তাঁদের মধ্যে অনেকে বিভিন্ন ফসলের নতুন জাত বা প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে সহায়তা করেছেন।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বার্ক) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. ওয়াইস কবীর কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শুধু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বা পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটই নয়, চাকরি ছাড়ার এ প্রবণতা সব কৃষি ইনস্টিটিউটে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি গবেষণা সেক্টরে নানা সহায়তা আসছে। কিন্তু সেসব ব্যবহারের জন্য যোগ্য লোক নেই। মেধাবী কৃষিবিজ্ঞানীদের আমরা ধরে রাখতে পারছি না। অনেকে প্রশিক্ষণ বা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গিয়ে আর ফিরছেন না। অনেকে চাকরি ছেড়েই বিদেশে যাচ্ছেন।'
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) মহাপরিচালক ড. মো. রফিকুল ইসলাম মণ্ডল বলেন, 'গত মাসে যে তিনজন কৃষিবিজ্ঞানী কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন, তাঁরা শুধু পদোন্নতি পাচ্ছেন না বলেই চাকরি ছেড়েছেন।'
নিজের চাকরি ছাড়া প্রসঙ্গে ড. মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, '২১ বছর কৃষি গবেষণা-বিষয়ক চাকরি করে আমি সেই চাকরি ছেড়ে এসেছি। এত দিন চাকরি করার পর তা ছেড়ে দিয়ে নতুন পেশায় যোগ দেওয়ার যে বেদনা, তা সংশ্লিষ্টদের বুঝতে হবে। বিশ্বের কৃষিপ্রধান দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে কৃষিবিজ্ঞানীদের তাঁদের সামাজিক মর্যাদার জন্য ধর্না দিতে হয়। ভারত, চীন, থাইল্যান্ডসহ কোনো কৃষিপ্রধান দেশে ৫৭ বছর বয়সে কৃষিবিজ্ঞানীদের অবসরে যেতে হয় না। আমি ২১ বছর চাকরি করে মাত্র একবার পদোন্নতি পেয়েছি। অথচ আমার সঙ্গে যারা লেখাপড়া করেছে, তারা অনেকেই তাদের চাকরির সর্বোচ্চ পর্যায়ে পেঁৗছে গেছে। কৃষি গবেষণায় না গিয়ে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছে তারা আজ অধ্যাপক। তারা চাকরিও করতে পারবে ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত। অথচ আমাকে ৫৭ বছর বয়সে বাড়ি চলে যেতে হবে। বর্তমান সরকারসহ সব সরকারই আমাদের চাকরির বয়সসীমা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, পদোন্নতিসহ সব ধরনের সুযোগ দেওয়ার কথা বলেছে; কিন্তু কেউ কথা রাখেনি।'
কৃষি গবেষণা ছেড়ে অধ্যাপনায় যোগদানকারী অন্য এক কৃষিবিজ্ঞানী হলেন ড. শহীদুল ইসলাম। গতকাল যোগাযোগ করা হলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রশাসন বা অধ্যাপনাসহ যেকোনো পেশায় বিনোদন ছুটি রয়েছে। নেই কেবল কৃষিবিজ্ঞানীদের। এ বিভেদ তুলে দেওয়ার জন্য গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডারের বাধার মুখে তা সম্ভব হয়নি বলে আমরা জেনেছি। বর্তমানে যে প্রণোদনা প্যাকেজ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তাতেও প্রশাসন ক্যাডারের বাধা রয়েছে বলে জানা গেছে। যা-ই হোক, সব কিছুর ঊধর্ে্ব এ দেশের কৃষি গবেষণাকে স্থান দিতে হবে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে। যখন কৃষিবিজ্ঞানীদের বেশি করে কাজে লাগানো দরকার তখন তাঁদের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা অবশ্যই হতাশাজনক। সারা বিশ্বেই কৃষিবিজ্ঞানীদের জন্য স্বতন্ত্র পে-স্কেল রয়েছে। নেই কেবল বাংলাদেশে।'
বাংলাদেশ ভুট্টা চাষে বিরাট সাফল্য পেয়েছে। স্বাধীনতার সময় যেখানে তিন হাজার টন ভুট্টা হয়েছে, সেখানে এখন ভুট্টা চাষ হচ্ছে দুই লাখ টন। যাঁদের হাত ধরে এ সাফল্য এসেছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভুট্টা প্রজননবিদ ড. নিজামউদ্দিন আহমদ। জানা যায়, পদোন্নতি না পেয়েই তিনি কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ছেড়ে বিদেশে চলে যান। ভুট্টা প্রজননবিদ ড. কাজী মোরতজা কবীরও চাকরি ছেড়েছেন। ডাল নিয়ে গবেষণায় অসামান্য সাফল্য পাওয়ার পরও চাকরিজনিত অসন্তোষ নিয়ে দেশ ছেড়েছেন প্রজননবিদ ড. চৌধুরী দোজা মো. সারওয়ার আহমদ ও ড. জুলিয়াস। এ ছাড়া তেলবীজ প্রজননবিদ কৃষ্ণপদ বিশ্বাস, ড. মির্জা সিরাজুল হক, ড. হাসিনা বেগম, ড. সিরাজুল হক, দিলরুবা খানম, ড. ওয়াহেদুজ্জামানও চাকরি ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। উদ্ভিদ প্রজননবিদ ড. দৌলতুন্নেসা চৌধুরী, দীপক কুমার সাহা ও ড. দীলিপ কুমার পাল দেশ ছেড়েছেন। এ ছাড়া কৃষিতত্ত্ববিদ ড. অরবিন্দ সাহা, ড. প্রণবেশ পোদ্দার, ড. সন্তোষ রায়, আবদুস সাদেক, সরদার মো. ফরিদ, ড. নজরুল ইসলাম, মো. খাইরুল কবীর, মো. রেজাউল কবীর, ড. কামাল আহমেদ দেশ ছেড়েছেন। কীটতত্ত্ববিদ ড. মো. ইব্রাহিম যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণা করছেন। এ ছাড়া কৃষি অর্থনীতিবিদ এনামুল হুদা, উদ্যানবিশারদ অতীশ কুমার সাহা চাকরি ছেড়েছেন। প্রাণ-রসায়নবিদ আবদুল আউয়াল হাওলাদার, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ববিদ ড. বেনজির আহমেদ, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ববিদ হায়দার আলী, মৃত্তিকাবিদ ড. মো. আলতামাস কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের চাকরি ছেড়ে দেশও ছেড়েছেন।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে তিনজন লন্ডনে যান। গবেষণা শেষে লন্ডনে পিএইচডি করে ফেরত আসেননি মো. মজিবুল ইসলাম ও ড. মোয়াজ্জেম হোসেন। আর চাকরির বাধ্যবাধকতা আমলে নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন ড. আবু বকর সিদ্দিক। কয়েক দিন পর তিনিও লন্ডনে ফিরে যান। এ ছাড়া গত কয়েক বছরে যাঁরা পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট ছেড়েছেন তাঁরা হলেন ড. আবুল কালাম আজাদ, ড. সিকদার আবদুল মান্নান. ড. জিয়াউল হাসান চৌধুরী, ড. জেবুন্নাহার, ড. কিবরিয়া, ড. হোসনে আরা ফেরদৌস।
অনুসন্ধান বলে, কৃষিবিজ্ঞানীদের এ হতাশার পেছনে রয়েছে মূলত 'রাষ্ট্রীয় অবমূল্যায়ন'। কৃষিবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, কৃষিপ্রধান দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে কৃষিবিজ্ঞানীদের চাকরির বয়সসীমা ৫৭ বছর। এ সময়সীমায় পেঁৗছলে বিজ্ঞানীদের তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়ি চলে যেতে হয়। এ সময় সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী যদি ফসলের কোনো নতুন জাত উদ্ভাবনের চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকেন, তার পরও তাঁকে অবসর নিতে হয়।
কৃষিবিজ্ঞানীরা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ বছর। বিচারপতির অবসরের বয়সসীমা ৬৭ বছর। সেখানে কেন কৃষিবিজ্ঞানীদের অবসরের বয়সসীমা ৫৭ হবে? কৃষিবিজ্ঞানীদের অবসরের বয়সসীমাও ৬৫ করা দরকার, যুক্তি দেখিয়ে তাঁরা বলেন, বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। তাই কোনো কারণে তাঁদের চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো সম্ভব যদি নাও হয় তাহলে ফসলের কোনো নতুন জাত, প্রযুক্তি, পদ্ধতি উদ্ভাবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের গবেষণা শেষ না হওয়া পর্যন্ত চাকরিতে রাখা দরকার। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে অথবা সুপার নিউমারি পদ সৃষ্টি করে মেধাবী বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে সেবা নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। এই বিজ্ঞানীরা আরো বলেন, যে বয়সে নিবিড় গবেষণা করে দেশের সেবা করা যায়, সেই বয়সে কৃষিবিজ্ঞানীরা অবসরে চলে যান। এতে দেশই বঞ্চিত হয়। কারণ একজন কৃষিবিজ্ঞানী গড়ে তুলতে রাষ্ট্রকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। আর এসব কৃষিবিজ্ঞানী সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিলেও বসে থাকেন না। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে যোগ্যতার প্রমাণ ঠিকই রাখছেন। এ ছাড়া দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে।
কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষকদের প্রারম্ভিক পদ (এন্ট্রি পোস্ট) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। এ পদে নিয়োগের নূ্যনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা হচ্ছে কৃষিবিজ্ঞানে সম্মান। কৃষিবিজ্ঞানে এমএস বা পিএইচডি ডিগ্রিধারীরাও এ পেশায় ঢুকছেন। কিন্তু কৃষিবিজ্ঞানে সম্মান আর পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের একই মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে। গবেষণার কাজে উচ্চ ডিগ্রিধারীদের জন্য কোনো প্রাধিকারমূলক ব্যবস্থা নেই। এ কারণে অনেক গবেষক কৃষি গবেষণাকাজে আগ্রহ হারাচ্ছেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, এ অবস্থা দূর করার জন্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে নিয়োগের জন্য এমএস ডিগ্রিধারীদের দুটি এবং পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের তিনটি ইনক্রিমেন্ট দেওয়া দরকার। তাহলে পিএইচডি ডিগ্রিধারীরা এ পদে আসার আগ্রহ দেখাবেন। তিনি আরো বলেন, অনেক কৃষিবিজ্ঞানী চাকরিতে যোগদানের পরপরই এমএস বা পিএইচডি ডিগ্রির জন্য বিদেশে যোগাযোগ শুরু করেন। তাঁদের অনেকেই প্রেষণে চার-পাঁচ বছরের জন্য বিদেশ চলে যান। এতে করে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘ সময়ের জন্য সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীর সেবা থেকে বঞ্চিত হয়।
হতাশার কারণ আরো আছে। বাংলাদেশে কৃষি নিয়ে গবেষণা হয় একাধিক প্রতিষ্ঠানে। এর মধ্যে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পেনশন স্কিমের আওতায় এসেছেন। কিন্তু ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট ও পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে পেনশন স্কিম চালু হয়নি। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গবেষণা সংশ্লিষ্ট পদ তুলনামূলকভাবে অনেক কম। অন্যদিকে এসব পদে পদায়ন উপযোগী যোগ্য ও অভিজ্ঞ গবেষক অনেক বেশি। পদোন্নতির সব ধরনের যোগ্যতা থাকার পরও তাঁরা পদের অভাবে পদোন্নতি পাচ্ছেন না। এ ক্ষেত্রে পদের পর্যায় উন্নয়নের মাধ্যমে (ইনসিটো) পদোন্নতি দেওয়া যেতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
কৃষিবিজ্ঞানীরা বলেছেন, আন্তর্জাতিক সুযোগ কাজে লাগাতে উচ্চতর ডিগ্রিধারী বিজ্ঞানীর সংখ্যা বাড়ানো দরকার। এ ক্ষেত্রে সরকারি সহায়তায় বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রির ব্যবস্থা করা দরকার। অনেক সময় কৃষিবিজ্ঞানীরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেন এবং গবেষণার সুযোগ পান। এসব গবেষণা অনেক সময়ই কৃষিবিষয়ক হয় না বলে এ থেকে দেশ কোনো উপকার পায় না। কৃষিবিজ্ঞানীরা কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে এমএস অথবা পিএইচডির মতো উচ্চশিক্ষা অর্জন করছেন। কিন্তু বাংলাদেশের উচ্চতর ডিগ্রিধারী বিজ্ঞানীদের সংখ্যা পার্শ্ববর্তী কৃষিনির্ভর দেশের তুলনায় অনেক কম। বাংলাদেশের কৃষিবিজ্ঞানীদের প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কাজে আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকল্পে বিদেশি বিজ্ঞানীদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করতে হয়। সার্ক ও এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের কৃষিবিজ্ঞানীদের সঙ্গে বাংলাদেশ বিভিন্নভাবে যুক্ত। উচ্চশিক্ষার অভাবেও অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা পেছনে পড়ে থাকেন বলে জানা গেছে।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিত্তবিনোদন ভাতা থাকলেও কৃষি গবেষণায় নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত বলে জানা যায়। কৃষিবিজ্ঞানীরা আরো বলছেন, ফসলের নতুন জাত বা প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য কোনো পুরস্কার বা সম্মাননার ব্যবস্থা নেই। অথচ কৃষিপ্রধান অন্য দেশগুলোতে এ ধরনের আবিষ্কারের জন্য রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক সম্মাননা দেওয়া হয়। এ ধরনের সম্মাননা বা পুরস্কার থাকলে কৃষিবিজ্ঞানীরা উদ্ভাবনী কাজে উৎসাহিত হন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক কৃষিসচিব ড. এ এম এম শওকত আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম যেখানে গতিশীল করা দরকার সেখানে আরো দুর্বল হচ্ছে। গবেষকদের নূ্যনতম সুযোগ দেওয়া যাচ্ছে না। তাঁরা সুষ্ঠু পরিবেশের অভাবে দেশ ছাড়ছেন। দেশে থেকেও পেশা পাল্টাচ্ছেন। এটা কৃষির জন্য খুবই অশনিসংকেত। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ সমস্যা দূর করা দরকার।'
তুলা উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক নির্বাহী পরিচালক হরিপদ মজুমদার বলেন, 'সরকারের অন্যান্য ক্যাডার সার্ভিসের সঙ্গে কৃষিবিজ্ঞানীদের এক করে দেখলে চলবে না। কৃষিবিজ্ঞানীদের অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। তাঁদের চাকরির বয়সসীমা বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন পদ সৃজন করা প্রয়োজন।'
মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই কৃষিবিজ্ঞানীদের প্রণোদনা প্যাকেজ দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এ প্যাকেজে কৃষিবিজ্ঞানীদের চাকরির বয়স বাড়ানো, নতুন পদ সৃজনসহ বিভিন্ন বিষয় রয়েছে। বিভিন্ন ক্যাডারের বিশেষ করে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে কৃষিবিজ্ঞানীদের প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কৃষিবিজ্ঞানীরা দেশ ছাড়ায় বড় ধরনের সমস্যা হচ্ছে। এটা যেমন সত্য, তেমনি সত্য হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা। সরকার ইচ্ছা করলেই রাতারাতি কিছু পাল্টে দিতে পারে না। সব পেশাজীবীকে সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। তার পরও আমরা কৃষি বিজ্ঞানীদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। তাঁদের জন্য একটি প্যাকেজের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। দেখা যাক, কতটুকু করা যায়।'
কৃষি মন্ত্রণালয়ের গবেষণা শাখা সূত্রে জানা গেছে, দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য কৃষিবিজ্ঞানীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। স্বাধীনতার পর জনসংখ্যা দ্বিগুণ হলেও খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। শুধু ধান নয়_গম, আলু, ভুট্টা, সবজি উৎপাদনেও তাঁরা আশাতীত সাফল্য দেখিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.