ইরান নয়, টার্গেট মধ্যপ্রাচ্য-আন্তর্জাতিক by মুহাঃ রুহুল আমীন

ভেম্বরের প্রথম সপ্তাহজুড়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সবচেয়ে উদ্বেগজনক ঘটনা হলো ইরানে ইসরায়েলের সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের হুঙ্কার। সম্ভাব্য ইরান আক্রমণে যুক্তরাষ্ট্রের সবুজ সংকেত, ইসরায়েলের ইউরোপীয় মিত্র ব্রিটেন ও ফ্রান্সের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদ এবং বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদীর সমর্থন নিয়েই ইসরায়েল এ দুঃসাহসিক ও বিপজ্জনক পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে।


  1. সম্ভাব্য আক্রমণের টার্গেট কেবল ইরান নয়, বরং সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়নক শাসকদের বিরুদ্ধে উদ্গীরিত গণআন্দোলন দমনের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে কৌশলে ইরান আক্রমণের মধ্য দিয়ে সেই মহাপরিকল্পনার ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করা হচ্ছে।ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের বিষোদগর বা তার ইরান আক্রমণের হুমকি নতুন ঘটনা নয়। উপসাগরীয় এলাকায় এতদিনের একমাত্র রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের সব শক্তি বিনাশ করে ওই অঞ্চলে পাশ্চাত্যের প্রতিষ্ঠিত বন্ধু ইসরায়েলকেই আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের সব শক্তি, কৌশল ও অর্থ ব্যয় করে আসছে। কয়েক বছর ধরে অনেক জল্পনা-কল্পনা, নানা তৎপরতা, সামরিক মহড়া এবং সাম্প্রতিক হামলার হুমকি-ধমকি মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পাশ্চাত্যের বাস্তববাদী পরিকল্পনা হিসেবে বিবেচিত হতে চলেছে, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থের অগ্রাধিকার।
  2. সেই সত্তরের দশকে পাশ্চাত্যের পদলেহী শাসক একনায়ক শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আধুনিক ইরানের গোড়াপত্তন করা হয়। এক ঝাঁক জাতীয়তাবাদী প্রাজ্ঞ প্রবীণ দেশহিতৈষী নেতা জাত্যাভিমানী ইরানি তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে এমন এক সুদৃঢ় জাতি-রাষ্ট্রের সৃষ্টি করেন, যার কাঠামোগত বিন্যাস ছিল সম্পূর্ণভাবে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। সঙ্গত কারণেই নতুন রাষ্ট্রটির কর্ণধার এবং আবালবৃদ্ধবনিতা আপামর জনসাধারণ ফুঁসে ওঠে দেশটিতে সাম্রাজ্যবাদের সর্বগ্রাসী শোষণের বিরুদ্ধে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আমেরিকা ও পাশ্চাত্য পুঁজিবাদবিরোধী অসংখ্য মিছিল বের করে ইরানের রাস্তায় রাস্তায়। পেশাজীবী, কর্মচারী-কর্মকর্তা, শ্রমিক শ্রেণী, নর-নারী নির্বিশেষে অযুত জনগণের অতন্দ্র প্রহরায় বলিষ্ঠভাবে বেড়ে ওঠে নতুন জন্মলাভ করা এ দেশটি। কিন্তু বিশ্বসমাজে এ দেশটির চলার পথে পদে পদে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আসছে আগ্রাসী বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী চক্র।
  3. একটি শান্তিপূর্ণ, শক্তিশালী ও গণতান্ত্রিক জাতি-রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের দীর্ঘদিনের ধূমায়িত রোষাগি্নতে ঘৃতাহুতি দিয়েছে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির অন্তরালে নিহিত থাকা সম্ভাব্য পারমাণবিক ক্ষমতা অর্জনের ইস্যুটি। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব প্রতিদিন প্রচার করছে _ শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির ছদ্মাবরণে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্রের উচ্চাভিলাষ রয়েছে এবং এমন খবর প্রমাণ করতে পর্যাপ্ত তথ্য ও উপাত্তও তাদের কাছে রয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের আইএইএকে ব্যবহার করে তেহরানের গোপন পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর 'নিশ্চিত প্রমাণ' উপস্থাপন করতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সাম্রাজ্যবাদী স্থায়ী সদস্যত্রয় বিভিন্ন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
  4. ইরানে সম্ভাব্য আক্রমণ বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্য আক্রমণের যুগান্তকারী একটি পদক্ষেপ রচনা মাত্র। এর পর একে একে তা তুরস্কসহ উদীয়মান সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মিসর, ইরাক ও লিবিয়াসহ অন্যত্র ছড়িয়ে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে একটি উত্তপ্ত রণাঙ্গন তৈরি করতে সাম্রাজ্যবাদী জোট যে বদ্ধপরিকর, তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
  5. এ বছরের শেষে ইরাক থেকে মার্কিন সৈন্যদের সরিয়ে নেওয়ার কথা রয়েছে। আল আরাবিয়া টেলিভিশনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মার্কিনবিরোধী জাতীয়তাবাদী নেতা মুক্তাদা আল সদর আগামী বছর থেকে যে কোনো মূল্যে ইরাকে সব ধরনের মার্কিন উপস্থিতি প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছেন। এ সময় পর তারা আর একজন মার্কিনিকেও ইরাকে অবস্থানের অনুমতি দেবেন না। অন্যথায় তা দখলদারিত্ব বিবেচিত হবে বলে তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। মিথ্যা কারণ দেখিয়ে প্রতারণামূলকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ কিছু পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী দেশ হিউম্যানিটেরিয়ান ইন্টারভেনশন বা মানবতাবাদী হস্তক্ষেপ নাম দিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম ইরাকে হামলা চালিয়ে দীর্ঘ নয় বছর ধরে দেশটির সব সম্পদ লুণ্ঠন করেও শেষ পর্যন্ত বিদায় নিতে চাইবে না হয়তো। আল জাইদির মতো জাতীয়তাবাদী তরুণের অসংখ্য জুতার বাড়ি না খাওয়া পর্যন্ত হয়তো মার্কিনিরা সেখানে আধিপত্য ধরে রাখতে চাইবে।
  6. পাশ্চাত্যের বিশ্বস্ত বন্ধু বেন আলি ও হোসনি মোবারকের শোচনীয় পতনে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে পাশ্চাত্যের মৃত্যুঘণ্টা বেজে উঠেছে। তিউনিসিয়ায় সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী পার্টি আল নাহদা নজিরবিহীন সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। পাশ্চাত্য আদর্শানুসারী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের শোচনীয় পরাজয়ের ফলে উত্তর আফ্রিকার এ দেশটিতে ঘোরতর পাশ্চাত্যবিরোধীদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্রদের কাছে মধ্যপ্রাচ্যনীতির পুনর্মূল্যায়ন বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
  7. গদি ছাড়ার আগে হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে পরিচালিত আন্দোলন স্বাধীনতা চত্বরে (তাহরির স্কয়ার) আছড়ে পড়ে। 'তাহরির চেতনা' সৃষ্টিতে মিসরে নিষিদ্ধ ঘোষিত মুসলিম ভ্রাতৃসংঘের (ইখওয়ান) নেতৃবৃন্দের শীর্ষস্থানীয় ভূমিকা মিসরের রাজনীতিতে তাদের শক্তিশালী অবস্থান সৃষ্টি করেছে।
  8. মিসরের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র তার স্থায়ী মিত্র ইসরায়েলকে এ অঞ্চলে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। কিছুদিন আগে কায়রোর ইসরায়েলি দূতাবাসে কিছু তরুণ ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে ইসরায়েলের প্রতি সাধারণ মিসরীয়দের ঘৃণার প্রকাশ ঘটায়। আগামী সাধারণ নির্বাচনের পর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে পাশ্চাত্যের কৌশলগত মিত্র দেশ মিসর শক্তিশালী পাশ্চাত্যবিরোধী রাষ্ট্রের রূপ পরিগ্রহ করবে নিঃসন্দেহে_ এ ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়।
  9. কট্টর পাশ্চাত্যবিরোধী গাদ্দাফির পতন নিশ্চিত করলেও ভবিষ্যৎ লিবিয়ায় পাশ্চাত্যের দীর্ঘমেয়াদি স্বপ্ন লালন হয়তো সম্ভব হবে না। কারণ গণতান্ত্রিক জোয়ারে ভেসে যাওয়া মধ্যপ্রাচ্যের অপর দুটি রাষ্ট্রের মতো এখানেও হান্টিংটনের 'সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ' (ঈঁষঃঁৎধষ ৎবপড়হভরমঁৎধঃরড়হ) দেদীপ্যমান অন্য দুটি দেশের মতো এখানকার এনটিসি যোদ্ধা ও নেতৃবৃন্দের জাতীয়তাবাদী কণ্ঠস্বরও বলিষ্ঠভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। হয়তো লিবিয়ায় গণবিদ্রোহ চলতে থাকবে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত। হয়তো গৃহযুদ্ধও শুরু হবে, কিন্তু এক পর্যায়ে জাতীয়তাবাদীরা শক্তিশালী প্লাটফর্ম তৈরি করতে সক্ষম হবে, যা পাশ্চাত্য স্বার্থের প্রতি সরাসরি হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হবে।
  10. ইয়েমেন, সিরিয়াসহ বিক্ষোভরত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এক পর্যায়ে জাতীয়তাবাদীদের পতাকা উত্তোলন করবে_ এমন প্রতিক্রিয়া তত্ত্ব (উড়সরহড় বভভবপঃ) অনেক বিশ্লেষকের লেখনীতে স্থান পাচ্ছে। পাশ্চাত্য কখনও চাইবে না ইরানের মতো জাতীয়তাবাদী, শক্তিশালী ও আধুনিকতার গুণাবলি নিয়ে মধ্যপাচ্যে একাধিক রাষ্ট্রের জন্ম হোক। ইতিমধ্যে তুরস্ক-ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের মিত্রতায় এখন ফাটল ধরেছে, যা আর পুনর্নির্মাণ হয়তো সম্ভব নয়। কারণ জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রদর্শনের অধিকারীরা এখন তুরস্কের মসনদে আসীন। তারা কখনও সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠিত অত্যাচারী ইসরায়েলের চোখরাঙানি সহ্য করতে প্রস্তুত থাকবে না।
  11. মধ্যপ্রাচ্যের এমনি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে পাশ্চাত্য কিংকর্তব্যবিমূঢ়। গণআন্দোলন দমনে পাশ্চাত্যের মদদপুষ্ট শাসক-শেখ-রাজরা চরম ব্যর্থ হলে পাশ্চাত্য কৌশলে বিপ্লবীদের সমর্থন দিলেও এর পশ্চাতে তাদের দন্ত-নখরের করাল থাবা লুক্কায়িত রেখেছে। মধ্যপ্রাচ্যে এ মুহূর্তে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করাই হলো পাশ্চাত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতি-কৌশল।
  12. কিন্তু কোনোভাবেই সরাসরি এসব দেশে তারা হস্তক্ষেপ করে বিশ্বব্যাপী পাশ্চাত্যবিরোধী ঘৃণার উন্মেষ ঘটাতে চায় না। এ জন্য প্রথমেই তারা ইরানের ওপর আঘাত হানার কৌশল অবলম্বন করতে আগ্রহী। এর ফলে ইরান পাল্টা আঘাত হানতে ব্যস্ত হয়ে উঠবে এবং মধ্যপ্রাচ্যের উদীয়মান গণতন্ত্র বিকাশে ইরানের ভূমিকা পালন অসম্ভব হয়ে পড়বে। তুরস্ক হয়তো কিছুদিন নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করবে। এক পর্যায়ে এমন কোনো ইস্যু হয়তো তৈরি করা হবে, যাতে তুরস্কও ইসরায়েল ও পাশ্চাত্যের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে বাধ্য হয় এবং এ অঞ্চলের গণতন্ত্র বিকাশে তার কার্যকর অবদান রাখতে অক্ষম হয়।
  13. আমরা নিশ্চিত, সম্ভাব্য ইরান আক্রমণের টার্গেট তাই কেবল ইরান একা নয়; এ হামলার টার্গেট গোটা মধ্যপ্রাচ্য। আর এ আশু আক্রমণও ইরানের বিরুদ্ধে পরিচালিতব্য একমাত্র ইসরায়েলি আক্রমণ নয়, বরং তা পুরো পাশ্চাত্যের সম্মিলিত আক্রমণ।
  14. এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর আগ্রাসনবিরোধী সম্মিলিত শান্তি প্রচেষ্টার উদ্যোগ গ্রহণ। তুরস্ক, ইরান, মিসর, ইরাক, তিউনিসিয়াসহ অন্য আরব দেশগুলো একা একা যুদ্ধ করে সাম্রাজ্যবাদকে পরাজিত করার ইতিহাস রচনা করতে সক্ষম হয়েছে। বিজয়ের এ ঐতিহাসিক প্রেরণা আরবদের নতুন করে একতার বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারলে পাশ্চাত্যের শোচনীয় পরাজয় অবধারিত, আরবদের বিজয় অনিবার্য।
  15. মুহাঃ রুহুল আমীন : সহযোগী অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
  16. john_nirjhar@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.