জাতীয় সক্ষমতা অর্জন কি কঠিন?-তেল-গ্যাস উত্তোলন by আবু সাঈদ খান

বিভিন্ন মহল থেকে আকসার এ কথা শোনা যায় যে, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ঐকমত্য নেই। জাতীয় স্বার্থে রাজনৈতিক দল শুধু নয়, নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী, গণমাধ্যমের ঐকমত্য দরকার। তবে সরকার ও বিরোধী দল সব বিষয়েই যে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে থাকে সে কথাটি পুরোপুরি ঠিক নয়। বরং কিছু কিছু ইস্যুতে শাসক দলগুলোর মধ্যে বিস্ময়কর ঐকমত্য পরিলক্ষিত হয়।


যেমন_ তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ক্ষেত্রে অনুসৃত নীতি। সরকারের সঙ্গে বিদেশি কোম্পানির সম্পাদিত চুক্তির বেলায় সরকার আওয়ামী লীগ নাকি বিএনপি সেটি বড় প্রশ্ন হয়ে ওঠে না। সম্পাদিত চুক্তি বা নীতিনির্ধারণেও দলের আদর্শ প্রভাব ফেলে না। ১৯৯৩-৯৪ সাল থেকে এ সময় পর্যন্ত বিদেশি তেল-গ্যাস উত্তোলনকারী কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যেসব প্রফিট শেয়ারিং কন্টাক্ট (পিএসসি) বা উৎপাদন অংশীদারি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে তা নিয়ে শাসক দলগুলোর মধ্যে তেমন মতপার্থক্য দেখা যায় না। বরং এ বিষয়ে সব শাসক দলের নেতা অভিন্ন সুরে কথা বলেন। তবে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন থাকাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছিলেন, ৫০ বছরের জন্য ব্যবহার্য গ্যাস মজুদ না রেখে তা রফতানি করা হবে না। কিন্তু বর্তমান শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার সেই অবস্থানে রয়েছে তা বলা যাবে না। ৫০ বছরের ব্যবহার্য গ্যাস মজুদের বিষয়টি নিশ্চিত না করেই কনকো-ফিলিপসের সঙ্গে সরকারের স্বাক্ষরিত চুক্তিতে গ্যাস রফতানির সুযোগ আরও অবারিত হয়েছে।
বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় থাকা তিনটি দল_ আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি যখন তেল-গ্যাস ইস্যুতে অভিন্ন নীতি ধারণ করছে, তখন বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাংবাদিক, নারীকর্মী, ছাত্র-শিক্ষক, বামদলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত তেল-গ্যাস-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি এর নিরবচ্ছিন্ন বিরোধিতা করে যাচ্ছে। আন্দোলন-সংগ্রামের কর্মসূচিও পালিত হচ্ছে। সমাবেশ-মিছিল-লংমার্চও করছে। এ আন্দোলনের সঙ্গে তেল-গ্যাস বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। সাধারণ মানুষকেও ইস্যুটি স্পর্শ করেছে। সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনার সন্ধিস্থলে সুনেত্র গ্যাসক্ষেত্র অভিমুখী লংমার্চে শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, যুবক, লেখক-সাংবাদিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু সম্ভবত বড় কোনো দল না থাকায় এসব কর্মসূচি মিডিয়ায় তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না।
বিভিন্ন ইস্যুতে দেখা যায়, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের ক্ষোভ থাকে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় সংস্থা পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সের প্রশংসা করা হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, বাপেক্সকে শক্তিশালী করার কথাই বলা হচ্ছে। এ আন্দোলন জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট হলেও এ নিয়ে সরকারের কোনো উচ্চবাচ্য নেই। তবে মাঝে মধ্যে পুলিশ আন্দোলনকারীর ওপর চড়াও হয়েছে। মন্ত্রীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছেন। তেল-গ্যাস-বন্দর রক্ষা কমিটির নেতাদের টোকাই বলে তাচ্ছিল্য করেছেন।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার রীতি হচ্ছে_ জনগণের মাঝ থেকে উত্থাপিত যে কোনো দাবিকে আমলে নেওয়া, এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা দেওয়া। এ ধরনের সওয়াল-জওয়াব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অপরিহার্য শর্ত। এর চেয়ে বড় কথা, এ ধরনের জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট চুক্তি নিয়ে সংসদে বা সংসদের বাইরে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। কেউ কেউ বলছেন, সরকারের চুক্তি করার অধিকার আছে। সেটি অবশ্যই আছে। তবে এ ধরনের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংসদে আলোচনা হওয়া জরুরি।
প্রশ্ন হচ্ছে, স্থলভাগে সম্পাদিত চুক্তিগুলোর ক্ষতিকর দিকগুলো যখন বহুল আলোচিত, তখন একই বিধি অনুযায়ী সমুদ্রের গভীরে গ্যাস উত্তোলনের চুক্তি করা কি যৌক্তিক? তথ্য পাওয়ার অধিকারের কথা যখন সরকার জোরেশোরে বলছে, তখন কনকো-ফিলিপসের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তির কিছু অংশ গোপন রাখা হয়েছে কেন? আমরা জানি না, এতে কী আছে। এ ধরনের গোপনীয়তা গণতান্ত্রিক রীতির মধ্যে পড়ে না।
কনকো-ফিলিপসের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে ৫৫% কস্ট রিকভারি ধরা হয়েছে। কস্ট রিকভারির পরে অবশিষ্ট গ্যাসের প্রকারভেদে ৫৫% থেকে ৮০% পাবে বাংলাদেশ। এর মানে ৫৫%-এর পরে ৪৫% থাকবে। এর বাংলাদেশের হিস্যা ৫৫% হলে তা হবে মোট গ্যাসের ২৪.৭৫% এবং ৮০% হলে মোট গ্যাসের ৩৬%। আর কস্ট রিকভারি যত বাড়তে থাকবে বাংলাদেশের হিস্যা তত কমতে থাকবে। অবশেষে আমাদের অবস্থা দাঁড়াতে পারে, নাকের বদলে নরুণ পেলাম, টাকডুমাডুম ডুম। বলাবাহুল্য, বহুজাতিক কোম্পানির খুঁটি শক্ত, কনকো-ফিলিপসের খুঁটি আরও শক্ত। কোম্পানিটি মার্কিন। উইকিলিকসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সে সময় মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ এফ মরিয়ার্টি তাদের কাজ পাইয়ে দিয়েছেন, অতএব তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করা কত কঠিন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা মধুর নয়। কস্ট রিকভারির নামে সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রের সব গ্যাস নিয়ে গেছে কেয়ার্ন। অগভীর সমুদ্রে সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রে বিডিংয়ে অনুসন্ধান ও উত্তোলন বাবদ খরচ ১০.৮১ মিলিয়ন ডলার থাকলেও একের পর এক সংশোধন করে শেষ পর্যন্ত তা দাঁড়িয়েছে ৬৬০ মিলিয়ন ডলারে। মাগুরছড়ায় অক্সিডেন্টাল তিনটি কূপ অনুসন্ধান ও খননের জন্য এক কোটি ৮৮ লাখ ডলারের হিসাব থাকলেও তা এখন পর্যন্ত চারবার সংশোধন করে চার কোটি ৯১ লাখ ৪০ হাজার ডলার হয়েছে। এভাবে কস্ট রিকভারির গোলকধাঁধায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ।
চুক্তি অনুসারে প্রাপ্ত গ্যাস গভীর সমুদ্র থেকে পাইপযোগে আনতে হবে বাংলাদেশকেই। সেই খরচ জুগিয়ে লাভ কিছু কি থাকবে? বলাবাহুল্য, যেখানে কুতুবদিয়ায় অগভীর সমুদ্র থেকে পাইপ দিয়ে তেল আনার বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য সাশ্রয়ী বিবেচিত হয়নি, তখন গভীর সমুদ্র থেকে গ্যাস আনার জন্য ১৭৫ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ করা কতখানি লাভজনক হবে সেটি ভেবে দেখা দরকার।
কনকো-ফিলিপসকে বলা হয় দুর্ঘটনার রাজা। এর আগে কোম্পানিটি আলাস্কায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। কনকো ও ফিলিপস যখন আলাদা ছিল, তখন উভয় কোম্পানি নানা অদক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছে।
উল্লেখ্য, অক্সিডেন্টাল ও নাইকোর হাতে মাগুরছড়া-টেংরাটিলায় ৫০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ধ্বংস হয়ে গেছে, যার বর্তমান আন্তর্জাতিক মূল্য ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর জন্য দায়ী মার্কিন ও কানাডীয় কোম্পানি দুটি। আমরা এর ক্ষতিপূরণ এখনও আদায় করতে পারিনি। কনকো-ফিলিপসের হাতে দুর্ঘটনা ঘটলে তার ক্ষতিপূরণ আদায় করা কি সম্ভব হবে?
এ প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক, বাপেক্স অত্যন্ত সুনিপুণ হাতে কম খরচে গ্যাস উত্তোলন করে প্রশংসিত হয়েছে। মাত্র ২৫ টাকায় এক হাজার ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে, অথচ বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ২১০ থেকে ২৫০ টাকায় এক হাজার ঘনফুট গ্যাস কিনতে হচ্ছে। এটি করতে গিয়ে বাংলাদেশকে বছরে আড়াই হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা এভাবে চুক্তি করে ভর্তুকি দিয়ে যাব, না স্বনির্ভর হবো?
বাপেক্স প্রমাণ করেছে, আমরাও পারি। তারপরও তাদের মূল্যায়ন না করা দুঃখজনক। এ ক্ষেত্রে তিনটি প্রসঙ্গ আসতে পারে_ পুঁজি, প্রযুক্তি এবং সমুদ্র থেকে গ্যাস উত্তোলনের অভিজ্ঞতা। কনকো-ফিলিপসের পাঁচ বছরের বিনিয়োগ ধরা হয়েছে এক হাজার ২শ' কোটি টাকা। বাংলাদেশের যখন বার্ষিক বাজেট এক লাখ কোটি টাকার ওপরে, সেখানে এই টাকা নস্যি। তাছাড়া পেট্রোবাংলার তহবিলেও সমপরিমাণ টাকা পড়ে আছে।
প্রযুক্তিও আজ কোনো কোম্পানির একক কর্তৃত্বের ব্যাপার নয়। বহু দেশেই এ প্রযুক্তি রয়েছে। ভাড়াও পাওয়া যায়। সাব-কন্ট্রাক্ট দেওয়া যায়। সব কোম্পানিই প্রয়োজনীয় সাব-কন্ট্রাক্ট দিয়ে কাজ করে থাকে। বাপেক্সের স্থলভাগে অভিজ্ঞতা থাকলেও সমুদ্রের গভীরে উত্তোলনের অভিজ্ঞতা নেই, সেটি ঠিক। তবে এটি বড় বাধা নয়। যেখানে অভিজ্ঞতার ঘাটতি আছে, সেখানে বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া যায়। সব কোম্পানিতেই দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেবে_ তাতে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু বাধা হচ্ছে, নীতিনির্ধারকদের পরনির্ভর সংস্কৃতি। আমরা নিজেদের শক্তির মূল্যায়ন করতে পারি না, আত্মবলে বলীয়ান হই না। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয়ী জাতির এ ধরনের পরনির্ভর মানসিকতা খুবই পীড়াদায়ক।
স্বাধীনতার পর বলা হতো, বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গম সাহায্য ছাড়া বাঁচবে না। কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলার কৃষক প্রমাণ করে দিল, বাংলাদেশ নিজের খাবার নিজেরাই উৎপন্ন করতে পারে। তারপর বলা হলো যে, আমেরিকার সাহায্য ছাড়া উন্নয়ন হবে না, বাজেটে অনুদান লাগবে। অনেক প্রতিকূলতার মুখেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাজেটের সিংহভাগ বাংলাদেশের রাজস্বেই হয়। আবার বলা হলো, বিদেশি কোম্পানি ছাড়া তেল উঠবে না। বাপেক্স বারবার প্রমাণ দিচ্ছে, সম্ভব। বাপেক্সের বিশেষজ্ঞরা সর্বশেষ রসিদপুরে আন্তর্জাতিক মানের থ্রি ডি সিসমিক সার্ভের মাধ্যমে গ্যাস আবিষ্কার করে আবারও নীতিনির্ধারকদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আমরা পিছিয়ে নেই। দেশপ্রেমের পরীক্ষায়ও তারা উত্তীর্ণ। বিদেশি কোম্পানিতে বেশি বেতনে চাকরির প্রলোভন উপেক্ষা করে অনেকেই দেশসেবায় নিবেদিত।
এ ধরনের নিবেদিত এক দল বিশেষজ্ঞ থাকার পরও আমরা পরনির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে পারছি না। আমরা ভাবতে চাইছি না, এ ধরনের বিদেশি কোম্পানির কাছে আমাদের এই মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ তুলে দেওয়ার পরিণাম কী হতে পারে? চোখের সামনে রয়েছে নাইজেরিয়ার উদাহরণ। ওপেকের সদস্য এই দেশটি কোটি কোটি ব্যারেল তেল রফতানির পরও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারেনি। সব লাভ গেছে বিদেশি কোম্পানির পকেটে। ছিটেফোঁটা পেয়েছে সরকারের অভ্যন্তরে বিদেশি কোম্পানির দালালরা। নাইজেরিয়ার দুঃখ অনেক দেশকেই সচেতন করেছে। কিন্তু আমরা মুখ ঘুরিয়ে রেখেছি সে সত্য থেকে।

আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com

No comments

Powered by Blogger.