জন্মদিনের প্রত্যাশা-ক্যান্সার জয় করে ফিরবেন হুমায়ূন

নাড়ি ছেঁড়া ধন সন্তানকে দূরে রেখে মায়ের মোটেও ভালো লাগার কথা নয়। তার মন কাঁদছে। সুদূর নিউইয়র্কে তার প্রিয় সন্তানটি মরণব্যাধি ক্যান্সার থেকে মুক্তির অপেক্ষা করছে। তাই এবার হলো না, আগামী বছরের জন্মদিনটা পালনের ইচ্ছে মায়ের। এ আশায় বুক বেঁধেছেন বাংলা সাহিত্যের জীবন্ত কিংবদন্তি লেখক-নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের রত্নাগর্ভা জননী আয়েশা ফয়েজ। সন্তানকে কিছুতেই হারাতে চান না।


সবার কাছে দোয়া চাইলেন তারসন্তান যেন সুস্থ হয়ে ফিরে আসে। গতকাল রোববার ছিল হুমায়ূন আহমেদের ৬৩তম জন্মদিন। এই উপলক্ষে সাত দিনের একক বইমেলার আয়োজন করেছেন হুমায়ূন আহমেদের গ্রন্থের প্রকাশকরা। এ আয়োজন আগের বছরও হয়েছে। সেই আয়োজনের মধ্যমণি ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। কিন্তু কাল ছিলেন না। সামনের বছর তাকে নিয়ে জন্মদিনের উৎসব করতে চান তার মা। আয়েশা ফয়েজ একা নন, দেশজুড়ে হুমায়ূনের ভক্তরা শুভ কামনা করেছেন। নিউইয়র্কেও ঘরোয়া পরিবেশে জন্মদিন পালিত হয়েছে।
জন্মদিনে হুমায়ূন আহমেদ নিউইয়র্ক থেকে বার্তায় জানান, 'সিগারেটের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছেদ করেছেন তিনি। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় চট্টগ্রামে প্রথম সিগারেটের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব। সেই বন্ধুত্ব তিনি ছিন্ন করেছেন। আর সিগারেট নয়।' সবার কাছে দোয়া কামনা করেছেন তিনি।
ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিকে 'রঙ পেন্সিল' নামে আত্মজৈবনিকমূলক লেখা শুরু করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। কাল জন্মদিনের আয়োজনে তা বই আকারে প্রকাশ করা হলো। আয়েশা ফয়েজ সেই বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন। পরম মমতায় সন্তানকে মা যেভাবে বুকে জড়িয়ে ধরেন, ঠিক সেভাবেই সদ্যপ্রকাশিত বইটি বুকে আগলে রেখেছিলেন তিনি। বললেন, 'প্রতি বছরই জন্মদিন সাড়ম্বরে পালিত হলেও এবার সে আমাদের মাঝে নেই। দূর পরবাসে চিকিৎসার জন্য অবস্থান করছে। তার অনুপস্থিতিতেও সবার এই শ্রদ্ধা-ভালোবাসা দেখে মনটা ভরে গেছে। আগামী জন্মদিনটা তাকে নিয়ে উদযাপন করতে চাই।' মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অন্যপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী মাজহারুল ইসলাম, সিরাজুল কবীর চৌধুরীসহ হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের প্রকাশকরা।
এর আগে হেমন্তের কুয়াশাচ্ছন্ন বিকেলে ৬৩টি বেলুন উড়িয়ে সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারের খোলা চত্বরে 'হুমায়ূন আহমেদ একক বইমেলা'র উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের আগে হুমায়ূন আহমেদকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা ও আরোগ্য কামনা করে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্টজনরা।
সূচনাতেই বক্তব্য রাখেন সময় প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী ফরিদ আহমেদ। তিনি বলেন, হুমায়ূন আহমেদ প্রাণশক্তিতে পরিপূর্ণ এক মানুষ। মরণব্যাধি ক্যান্সার জয় করে তিনি আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন তার এ প্রাণশক্তির মধ্য দিয়ে। আগামী বইমেলা আবারও মুখরিত হয়ে উঠবে তার পদচারণায়।
চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কথাশিল্পী ফরিদুর রেজা সাগর বলেন, হুমায়ূন শুধু সাহিত্যকর্মের মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ করে রাখেননি। শিল্প ও সাহিত্যকে যুগলবন্দি করে বর্ণাঢ্যময় জীবনের দিকে এগিয়ে চলেছেন। বিরল প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন টেলিভিশনের পর্দায়ও। চলচ্চিত্র শিল্পেও রেখেছেন অনন্য ভূমিকা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, 'হুমায়ূন ভাইকে আমরা আবারও ফিরে পেতে চাই। অবশ্যই সুস্থভাবে। তিনি ফিরে আসবেন আমাদের মাঝে এই প্রত্যাশা।'
হুমায়ূন আহমেদের বন্ধু ও সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী বলেন, 'আমি চাই না কোনো প্রকার বিষাদের মধ্য দিয়ে হুমায়ূনের জন্মদিন পালন করা হোক। প্রত্যাশা নয়, বিশ্বাস করি আবারও আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন তিনি। অসুস্থতা সত্ত্বেও বিরামহীনভাবে তিনি লিখে চলেছেন। ভবিষ্যতেও লিখবেন। অসুস্থ হলেও তিনি নিজেকে, দেশকে ও তার পাঠক-ভক্তদের নিজের লেখনির মধ্য দিয়ে বিনোদিত করছেন। এ কর্মশক্তিই তাকে আবারও ফিরে আনবে আমাদের মাঝে।' পরে তিনি হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনের উপহার হিসেবে ব্যাঙ্গালোর থেকে আনা চন্দন কাঠের মালা তুলে দেন মাজহারুল ইসলামের হাতে।
হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই আহসান হাবীব বলেন, 'প্রত্যেক জন্মদিনে ভাই থাকেন, এই জন্মদিনে নেই। এ জন্য মনটা খারাপ। তবে সবার এই আগমনে মন খারাপ লাগাটা কমে এসেছে।'
অনুষ্ঠানে হুমায়ূন আহমেদকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন এটিএন বাংলার প্রধান উপদেষ্টা ও তার লেখা প্রথম নাটকের প্রযোজক নওয়াজেশ আলী খান, হাসান হাফিজ, সুরকার মকসুদ জামিল মিন্টু, কাজী আরিফ, আসমা আব্বাসী, এস আই টুটুলসহ আরও অনেকে।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ছিল পথনাটকও। স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কবি রফিক আজাদ, মুহম্মদ নুরুল হুদা, শাহাবুদ্দীন নাগরী এবং আরিফ মহিউদ্দীন। স্বরচিত ছড়া পাঠ করেন আলম তালুকদার ও ওবায়দুল গনি চন্দন। অণুগল্প পাঠ করেন জাহিদুল হক, ঝর্ণা রহমান ও হামিদ কায়সার। কবিতা আবৃত্তি করেন ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ও দিমা নেফারতিতি। চন্দ্রকলা থিয়েটার মঞ্চস্থ করে পথনাটক 'আজব বাক্স'।
সাত দিনের একক বইমেলায় অংশ নিচ্ছে ১৬টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো_ অন্যপ্রকাশ, অনুপম প্রকাশনী, অন্বেষা প্রকাশন, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, আফসার ব্রাদার্স, কাকলী প্রকাশনী, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, পার্ল পাবলিকেসন্স, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, বাংলাপ্রকাশ, মাওলা ব্রাদার্স, শিখা প্রকাশনী, সময় প্রকাশন, সাগর পাবলিশার্স ও সুবর্ণ।
বইমেলা আগামী ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। প্রতি সন্ধ্যায় মেলা মঞ্চে থাকছে অণুগল্প পাঠ, স্বরচিত কবিতা পাঠ, আবৃত্তি ও পথনাটক। আজ পথনাটক মঞ্চস্থ করবে ভিশন থিয়েটার।
নিউইয়র্কে জন্মদিনের কেক কাটলেন হুমায়ূন আহমেদ :যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে কেক কেটে ৬৩তম জন্মদিন পালন করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। পারিবারিক আয়োজনে স্থানীয় সময় রাত ১২টা ১ মিনিটে কেক কাটেন তিনি। এ সময় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন, দুই সন্তান নিষাদ হুমায়ূন ও নিনিত হুমায়ূন, হুমায়ূন আহমেদের শাশুড়ি তহুরা আলী এমপি, অন্যপ্রকাশের অন্যতম প্রকাশক মাসুম রহমানসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন হাসিখুশি। স্ত্রী ও দুই সন্তানের মুখে তুলে দেন কেক।
পরে তিনি তার লেখা আত্মজৈবনিকমূলক বই 'রঙ পেন্সিল'-এর মোড়ক উন্মোচন করেন। কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ চিকিৎসার জন্য নিউইয়র্ক অবস্থান করছেন।
দখিনা হাওয়ায় জন্মদিন পালন : হুমায়ূন আহমেদের বাসভবন ধানমণ্ডির দখিনা হাওয়াতে রাত ১২টা ১ মিনিটে ৬৩টি মোমবাতি জ্বালিয়ে জন্মদিন উদযাপিত করেছে তার পরিবারের ঘনিষ্ঠজনরা। ছেলের জন্মদিনের কেক কাটেন মা আয়েশা ফয়েজ। এ সময় হুমায়ূন আহমেদের বোন সুফিয়া হায়দার শেফু, হুমায়ূন আহমেদের ছেলে নূহাশ হুমায়ূন, শ্বশুর ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আলী, জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, অন্যপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী মাজহারুল ইসলামসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন। প্রযুক্তির কল্যাণে নিউইয়র্কে বসে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অংশ নেন হুমায়ূন আহমেদ। পরিবারের সঙ্গে জন্মদিনের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন এই কনফারেন্সের মধ্য দিয়ে। তিনি সবার কাছে দোয়া কামনা করেন।

No comments

Powered by Blogger.