বিশ্বব্যবস্থা: যুক্তরাষ্ট্র সরে গেলে বাকি পশ্চিমাদের এগিয়ে আসতে হবে by চিন-হুয়াত ওং ও উইং থাই উ

যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে ভূরাজনৈতিক পশ্চিম বা নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা যাবে—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কয়েক দশক ধরে এমনটা কল্পনা করাই কঠিন ছিল। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ফেরার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বনেতৃত্ব টিকে থাকবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন এ বাস্তবতাকে আরও স্পষ্ট করেছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমা অংশীদারদের এখন নিজেদের নতুন বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। তাদের যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। নিজেদের মধ্যে সমন্বয় জোরদার করতে হবে। এখন আর সন্দেহ নেই, ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ভরসা করা যাবে না, করা উচিতও হবে না। ট্রাম্প খোলাখুলি যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের অবজ্ঞা করেন; আবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মতো স্বৈরশাসকদের প্রশংসা করেন।

আদতে ট্রাম্প কেবল একটি লক্ষণ মাত্র। আসল সমস্যাটা যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে কয়েক দশক ধরেই তৈরি হয়েছে। ১৯৮০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মাথাপিছু জিডিপি দ্বিগুণ হয়েছে, অথচ বাস্তবে গড় পরিবারের আয় বেড়েছে এক-চতুর্থাংশের কম। এটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। রোনাল্ড রিগ্যান থেকে শুরু করে ট্রাম্প পর্যন্ত রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টরা ধনীদের কর কমিয়েছেন। তাঁরা দাবি করেছেন, সুবিধা নাকি সবার কাছে ‘ট্রিকল ডাউন’ হয়ে পৌঁছাবে। অথচ একই সময়ে প্রযুক্তিগত স্বয়ংক্রিয়তা ও উৎপাদন খাত বিদেশে সরিয়ে নেওয়ার কারণে লাখো কর্মীর আর্থিক নিরাপত্তা ধ্বংস হয়েছে।

ধরা যাক, ট্রাম্প মার্কিন সংবিধান মেনে ২০২৯ সালের জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউস ছেড়ে দেবেন। তবু তাঁর প্রস্থান এসব সমস্যার সমাধান করবে না। এমনকি ডেমোক্র্যাটরা যদি আগামী মধ্যবর্তী নির্বাচনে কংগ্রেসে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পান এবং ২০২৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন, তবু যে জনপ্রিয়তাবাদী শক্তি ট্রাম্পের উত্থান ঘটিয়েছিল, তা মার্কিন রাজনীতিকে চালিয়ে যেতে থাকবে।

যুক্তরাষ্ট্র অনেক সময় ভুল পরিকল্পনা বা অপরিণত নীতি গ্রহণ করছে। উদাহরণ হিসেবে চীনকে ঠেকানো বা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তারা প্রচুর অর্থ ও সম্পদ ব্যয় করছে। কিন্তু একই সম্পদ যদি দেশের ভেতরে জরুরি ক্ষেত্রগুলোতে, বিশেষ করে নষ্ট হয়ে যাওয়া অবকাঠামো (রাস্তা, সেতু, রেলপথ, বিদ্যুৎ–ব্যবস্থা ইত্যাদি) পুনর্গঠনে ব্যবহার করা হতো, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে সমাজ আরও শক্তিশালী হতো, অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাড়ত আর বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতা করার ক্ষমতাও বেড়ে যেত। কিন্তু যেহেতু সেই সম্পদ ভুল জায়গায় যাচ্ছে, সেহেতু যুক্তরাষ্ট্র নিজের ভেতরকার সমস্যা সমাধান করতে পারছে না, তাই আন্তর্জাতিক নেতৃত্বে তার অবস্থান দুর্বল হয়ে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে তা আরও ক্ষয়িষ্ণু হবে।

এ প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির ভিত্তি ধরে রাখার জন্য পশ্চিমাদের বাকি দেশগুলোকেই এগিয়ে আসতে হবে। তারা চাইলে তা পারবে। কারণ, এখানে অনেক সমৃদ্ধ ও প্রভাবশালী ‘মধ্যশক্তি’ রয়েছে। এখানে আছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭ সদস্য, যুক্তরাজ্য, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও কানাডা। ২০২৪ সালে এসব দেশের মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৭০ কোটি (যা যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিগুণ) এবং তাদের সম্মিলিত জিডিপি ছিল ২৯ ট্রিলিয়ন ডলার, যা যুক্তরাষ্ট্রের সমান।

যদি এই দেশগুলো বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষায় একসঙ্গে কাজ করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষিতে তারা নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে পারবে। ট্রাম্প আসলে একটাই জিনিস বোঝেন, তা হলো ক্ষমতার প্রদর্শন। এ কারণে এসব দেশের কর্মসূচি কেবল ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ভালো চুক্তি আদায়েই সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না; বরং তাঁর খামখেয়ালি একতরফা নীতি ও চীনবিরোধী বিষাক্ত প্রচারণার বৈশ্বিক প্রভাবকেও প্রতিরোধ করতে হবে।

এ জন্য অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রয়োজন। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র যখন ট্রাম্পের শুল্কপ্রাচীর তৈরি করছে, তখন এই নতুন বহুপক্ষীয় ব্লককে বৈশ্বিক গণসম্পদ সরবরাহ করতে হবে। এ লক্ষ্যে বিশ্ববাণিজ্য–ব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক আইনকে শক্তিশালী করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন করে ভাবতে হবে। হ্যাঁ, চীন পশ্চিমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং যত দিন সে ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধকে সমর্থন করবে, ইউরোপের জন্য ভূরাজনৈতিক হুমকি হয়ে থাকবে। কিন্তু পশ্চিমাদের মধ্যশক্তিগুলো চীনের সঙ্গে কোনো ‘থুসিডিডিস ফাঁদে’ আটকা পড়েনি। তাই সংঘাত অনিবার্য নয়। এ কারণে জলবায়ু কার্যক্রম ও মহামারি প্রস্তুতির মতো পারস্পরিক স্বার্থে ব্যবহারিক চুক্তি করার পথ খুঁজতে হবে।

তৃতীয়ত, পশ্চিমাদের মধ্যশক্তিগুলোকে, বিশেষ করে গাজায় গণতান্ত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধের পক্ষে দাঁড়াতে হবে। ট্রাম্প যেখানে স্পষ্টভাবে ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসন ও বেসামরিক হত্যাযজ্ঞকে সমর্থন করছেন, সেখানে ফ্রান্স, স্পেন, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শুরু করেছে।

এভাবে পশ্চিমা দেশগুলো একসঙ্গে কাজ করে দ্রুত পরিবর্তনশীল ও ক্রমে বহুমেরু হয়ে ওঠা বিশ্বব্যবস্থায় নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে পারে।

* চিন-হুয়াত ওং, মালয়েশিয়ার সানওয়ে ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক
* উইং থাই উ, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া-ডেভিসের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ইমেরিটাস
- স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত

ভ্লাদিমির পুতিনের মতো স্বৈরশাসকদের প্রশংসা করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প
ভ্লাদিমির পুতিনের মতো স্বৈরশাসকদের প্রশংসা করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

No comments

Powered by Blogger.