নিজ ভূমে নির্যাতিত পরভূমে আশা-নিরাশার দোলাচলে রোহিঙ্গারা: প্রতিশ্রুতির আখ্যান by হান্নাহ বিছ

এন খু ইয়া, মিয়ানমার-প্রত্যাবাসন কেন্দ্রের মরচে পড়া কাঁটাতারের বেড়ার ওপাশটা শূন্য। কেউ নেই ওপাশে। প্রত্যাবাসীদের আগমন প্রতীক্ষায় তৃষিত নয়নে চেয়ে আছে ওটা।ইউনিফর্ম পরা অফিসাররা মুখে হাসি নিয়েই ট্রেলারের ওধারে অলস সময় কাটাচ্ছেন। মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা মুসলিমদের এখানে এসেই ছবি তোলার জন্য লাইনে দাঁড়াবার কথা, পরিচয়পত্র সংগ্রহ করার কথা। ওদের স্বাগত জানানোর জন্যই ডেস্কের পেছনে অফিসারদের প্রতীক্ষা।
নিরাপত্তারক্ষীরা হাতে দণ্ডের মতো কিছু একটা নিয়ে অপেক্ষা করছে। দেখে মনে হচ্ছে এই নির্জন সীমান্ত যেন কোনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। খাঁ-খাঁ করা প্রান্তরে অতিথির আগমনে মুখ গোমড়া করে থাকা কোনো মেজবানের হাতে কলম নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যের মিলটা ঠিক গোচরে আসে না।
এন খু ইয়া নামের এই প্রত্যাবাসন কেন্দ্রে একটি জিনিসের বড়ই অভাব প্রকট হচ্ছে। আর তা হচ্ছে স্বয়ং রোহিঙ্গারা।
দুই বছর আগের এমনই এক রোববারে মিয়ানমার থেকে ৭ লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসতে শুরু করে। জাতিগত গণহত্যার শিকার এই রোহিঙ্গাদের নিয়ে দুই দেশের সরকারই বলছেন যে সংখ্যালঘু হিসেবে তাদের মিয়ানমারে শিগগিরই প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করা হবে। সময়ের সঙ্গে বারবার এই প্রতিশ্রুতি কেবলই ভেঙেছে। লক্ষাধিক তো দূরের কথা, হাজারের হিসেবেও রোহিঙ্গারা ফেরত যায়নি।
২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথম কিস্তির ১,২০০ জন ফিরে যাবার কথা। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে কাজটা করা সম্ভব হয়নি। শতাব্দীর সবচেয়ে ঘৃণ্য জাতিগত হামলার শিকার রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে রীতিমতো শোরগোল পড়ে যায়।
২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে দুই দেশের মধ্যে সুরক্ষিত, স্বপ্রণোদিত প্রত্যাবাসন নিয়ে নানা প্রতিশ্রুতির কথাবার্তা চলে। নতুন নতুন তারিখ দেয়া হয়। একটির দেখাও মেলেনি।
গত ২২ আগস্ট বৃহস্পতিবার মিয়ানমার সরকার ৩,৪৫০ জন রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন নিয়ে কার্যক্রম শুরু করার কথা বলে। এরপরও সীমান্তের ওপারে কারোর টিকির দেখা মেলেনি।
প্রত্যাবাসনের এই গল্পকে টিকিয়ে রাখা দুই দেশের রাজনীতির জন্যই খুবই ফলপ্রসূ।
জাতিসংঘের প্রস্তাবমতে মিয়ানমারের ওপর গণহত্যার অভিযোগ আনা উচিত, যার সূচনা হয়েছিল ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে। তবে মিয়ানমার নিজেদের ওপর থেকে মানবাধিকার লঙ্ঘন করার দুর্নাম হটাতে বদ্ধপরিকর।
এমনিতেই বাংলাদেশ তার অধিক জনসংখ্যা ও দারিদ্র্য নিয়ে ধুকছে। দেশটি তার জনগণকে ক্রমাগত আশ্বাস দিচ্ছে যে উদ্বাস্তুদের দিকে অপর্যাপ্ত রসদ বণ্টন করে দেয়া হচ্ছে না।
তবে এন খু ইয়ার রোহিঙ্গাবিহীন দালানগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায় প্রত্যাবাসনের এই আশ্বাস কতটা ফাঁপা ছিল। জায়গাটা এমনই চুপচাপ যে একটি কুকুরও নির্বিঘ্নে চারপাশে হেঁটে গন্ধ শুঁকে যেতে পারে।
এমনকি ওয়াচ টাওয়ার থেকেও নজর রাখবার জন্য কোনো সৈনিক মোতায়েন করা নেই। দেখার কেউ নেই।
প্রত্যাবাসনের অঙ্গীকার। ব্যর্থতা। পুনঃব্যর্থতা।
বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গাদের নিজভূমে ফিরে যাবার এই ব্যর্থতা কিন্তু আগেরবারে সংঘটিত ঘটনাগুলোরই পুনঃদৃশ্যায়ন। প্রথমে মিয়ানমার প্রত্যাবাসন কর্মসূচি শুরু করার জন্য একটি তারিখ দেয়। তবে স্বল্পসংখ্যক অংশের বরাতেই তা জোটে, যারা প্রত্যাবাসী হবার উপযুক্ত। মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র বাংলাদেশও মিয়ানমারের এই পন্থাকে সমর্থন জানায়।
‘আমি বেশ ইতিবাচক,’ বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ.কে.আবদুল মোমেন। আগস্টের শুরুতে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের তিনি আরো জানান, ‘আশা করছি এই মাসেই প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবো।’
কিন্তু বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নেয়া লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে পরামর্শ করার বেশি সুযোগ-সময় পায়নি। পাঁচটি বাস এবং দুটো ট্রাক অপেক্ষা করছিল প্রত্যাবাসীদের জন্য। একজন রোহিঙ্গাকেও সেখানে দেখা যায়নি।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংঘগুলো এবার সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ নিলো। জানা গেল, যেসব রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় নয়, বরং এখনও ভীত হয়ে এদেশে অবস্থান করছে, তাদের নামও প্রত্যাবাসীদের তালিকায় রয়েছে।
রাধিকা কুমারাস্বামী বৃহস্পতিবার বলেন, রোহিঙ্গাদের এখন ফেরত যাবার মতো মনমানসিকতা নেই। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর হিংস্র আক্রমণ নিয়ে প্রমাণ সংগ্রহের মিশনে তিনি জাতিসংঘের একজন বিশেষজ্ঞ হয়ে কাজ করছেন।
‘উত্তর রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আমরা স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত কিছু ছবি দেখেছি। এখানেই গ্রামগুলো নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছিল। একটি গাছেরও দেখা নেই,’ নিউ ইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি একথা বলেন।
মিয়ানমারের কাছে এখন একটি চমৎকার ছুতো এসে গেল। তারা এই বলে বিস্ময় দাবি করতে পারে যে রোহিঙ্গারা নিজ থেকেই ফেরত আসছে না।
‘প্রত্যাবাসন কেন শুরু হচ্ছে না, তা বুঝতে পারছি না,’ বলেন রাখাইন রাজ্যের মুখপাত্র উ উইন মিন্ট। এই অঞ্চলটিকেই রোহিঙ্গারা নিজেদের ‘ঘর’ বলত। মিন্ট আরো বলেন, ‘আমাদের দিক থেকে সবকিছু তৈরিই আছে।’
এমন দৃশ্যের অবতারণা এর আগেও অনেকবার হয়েছে। ফলাফল শূন্য।
মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী উইন মিয়াত আয়ে নভেম্বর মাসে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেন যে, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হবে। প্রথম কিস্তিতে এন খু ইয়া প্রত্যাবাসন কেন্দ্র হয়ে ২,১৬৫ জন রোহিঙ্গা এবং পরবর্তী কিস্তিতে ৫,০০০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়া হবে।
‘নাগরিকত্বের জন্য তারা আবেদন করতে পারবে। যেখান থেকে তারা এসেছে, সেখানেই তারা বসবাস শুরু করতে পারবে। থাকার জন্য যদি বাড়িঘর না থাকে, তবে নিজেদের এলাকার চারপাশে তারা থাকতে পারবে।’
সরকারপক্ষ থেকে আসা এসব কথা এখন কেবলই ফাঁকা বুলি হয়ে বাতাসে ভাসছে।
মিয়ানমারের অভিবাসন কর্তৃপক্ষের দেয়া হিসাবমতে জানা যায়, ২০১৮ সালের মে মাস থেকে ২০১৯ সালের মে মাস পর্যন্ত কেবল ১৮৫জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে ফেরত এসেছে। এমনকি ছোট্ট এই সংখ্যাটিরও কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র নেই। এদের মধ্যে ৯২ জনকে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নৌকায় করে পালাবার সময় ধরে ফেলেছে। বাকি ৬২ জন মিয়ানমার জেল থেকে মাত্র ছাড়া পেয়েছে।
সরকারের মতে, প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে মাত্র ৩১ জন “নিজেরাই সাধ করে” মিয়ানমারে ফেরত গেছে।
সংখ্যা এত কম কেন, প্রশ্ন উঠলে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ যুদ্ধরত রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশের উদ্বাস্তু ক্যাম্পে বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে আসা ত্রাণের প্রতি দোষারোপ করে। এসব কিছুর জন্যই নাকি রোহিঙ্গারা আর দেশে ফিরতে চাচ্ছে না।
‘ক্যাম্পে অবস্থানরত মুসলমান আতঙ্কবাদীরা বোঝাচ্ছে যে এখন ফেরত যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ না। মানুষ তাই সাহসও পাচ্ছে না,’ বলেন উ সোয়ে অউং। রাখাইন রাজ্যের মংদোতে অবস্থিত একটি সাধারণ প্রশাসনিক দপ্তরের প্রধান তিনি। অউং আরো বলেন, ‘এখন ফিরে আসাটা পুরোপুরি নিরাপদ।’
দেশের জন্য মন কাঁদে, কিন্তু মনে জেঁকে আছে ভয়
রোহিঙ্গাদের স্বাগত জানাবার জন্য লাল গালিচা নিয়ে অপেক্ষা করার কথাটি এসেছে স্বয়ং অং সান সু চির মুখ থেকে।
‘তিনি এখন রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত, যারা কিছু কারণে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন,’ বলেছেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী। উইন মিয়াত আয়ে আরো বলেন, ‘ফিরে না আসার কোনো কারণ নেই।’
দেশে ফিরলে কী অপেক্ষা করছে, তা ভাবতে থাকা সন্ত্রস্ত রোহিঙ্গাদের জন্য স্বাভাবিক। যে কারণে তাদের দেশ ছাড়তে হয়েছে এবং ছাড়ার আগে-পরে কী কী ঘটেছে, তা নিয়ে শঙ্কাও রয়েছে।
২০১৭ সালের ২৫শে আগস্ট একদল রোহিঙ্গা বিদ্রোহী পুলিশ ফাঁড়ি ও সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ করে বসে। এর কিছু সময় পরই সংখ্যালঘু মুসলমানদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়তে শুরু করল। গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিকাণ্ডের ফলে বেসামাল হয়ে গেল রোহিঙ্গারা। বৌদ্ধ মতাবলম্বীরাও রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে এই শোণিত উপাখ্যানে যোগ দিলো।
ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস (যেসব ডাক্তার দেশ, কাল, পাত্র, সীমানা ভুলে মানবেতর সেবায় এগিয়ে যান) তাদের একটি কথনে বলেন যে হত্যাকাণ্ড শুরু হবার একমাসে অন্তত ৬,৭০০ রোহিঙ্গাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।
মিয়ানমার সরকার তাদের এই যজ্ঞকে ‘নির্মূল অভিযান’ আখ্যায়িত করে বলেছে যে শুধু বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করতেই এই আক্রমণ করা হয়েছে। আক্রমণের কয়েক সপ্তাহ আগে সেনাবাহিনীর বিরাট বহর মোতায়েন করা হয়েছে এবং এরপরের দিন থেকে কপ্টার থেকে গ্রামবাসীর ওপর রকেট নিক্ষেপ করা হয়। জাতিগত হামলার এই পরিকল্পনা দেখে বোঝা যায় যে অনেক আগে থেকেই এই পরিকল্পনা করা হচ্ছিল। বিদ্রোহীদের আক্রমণ শুধু প্রভাবক হিসেবেই কাজ করেছে।
বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় উদ্বাস্তু শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মানবপাচার রয়েছে, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। মেয়েদের ধরে ধরে পতিতালয়ে পাঠানো কিংবা ছেলেদের দাস বানানো হয় এই অঞ্চলগুলোতে। ক্যাম্পে গরমের মৌসুম এলে মল ও কাদামাটি মিলে নানা রোগজীবাণু ছড়াতে শুরু করে। ভূমিধস একটি নৈমিত্তিক ঘটনা। উন্মত্ত হাতির কবলে পড়েও প্রাণ হারিয়েছে অনেক রোহিঙ্গা। এখানে মাটি কামড়ে পড়ে থাকার কারণ সামান্যই।
তবুও অনেকের কাছে মিয়ানমারের অবস্থা এর চেয়েও খারাপ। তাদের ওপর এতবড় হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে, এটা দেশের সরকার অকপটে অস্বীকার করে যাচ্ছে। সে দেশে ফেরত যাবার মতো কোনো ভরসা তাদের নেই।
‘যারা আমাদের পরিবার-পরিজনদের এভাবে মেরে ফেলেছে, তাদের কী করে বিশ্বাস করি?’ তুলাতলী গ্রামের একটি পরিবারের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানো হবার পর কেবল একমাত্র জীবিত আছেন রমজান আলী। তার মুখেই কথাগুলো শোনা গেল।
উত্তর রাখাইনের ওপর এই হত্যাযজ্ঞ চলবার পর কিছু রোহিঙ্গা সেখানে বন্দি হয়ে আছে। তাদের চাকরি, শিক্ষা, সাধারণ সুযোগ-সুবিধা, সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। জুন মাস থেকেই এই অঞ্চলের মোবাইল ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন।
রোহিঙ্গা পুরুষদের মাঝে কারাবাসের হারটা একটু বেশিই। এদের মাঝে আবার অনেকেই সন্ত্রাসবাদীদের তালিকাভুক্ত। তাদের মধ্য থেকেই জেল থেকে মুক্তি পাওয়া কিছু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসীর ভূমিকায় অভিনয় করে, যদিও এরা আদৌ মিয়ানমার ত্যাগই করেনি।
‘ঘরের কথা খুব মনে পড়ে। কিন্তু পরিবার খুন হয়ে যেতে পারে, এমন একটা জায়গায় আমি আর যেতে চাই না,’ বলেন বাংলাদেশের একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা সাইফুল ইসলাম।
ছাইভস্মের ওপর গড়ে তোলা হয়েছে সেনাবাহিনীর ঘাঁটি
মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া যেকোনো রোহিঙ্গাই এখন আমূল বদলে যাওয়া একটি চিত্র দেখতে পাবে।
উত্তর রাখাইনের নোনতা জলাভূমি ধরে এগিয়ে গেলেই নীরবতা টের পাওয়া যাবে। একটা সময় এখানে দশ লাখের মতো রোহিঙ্গা বসবাস করত। অধিকাংশই এখন আর নেই। পুড়ে যাওয়া মসজিদ কিংবা বৃদ্ধের লাঠির মতো ন্যুব্জ হয়ে থাকা খুঁটির অংশ এখন সেটারই সাক্ষ্য দিচ্ছে। একটা সময় এখানে মানুষ থাকত।
রাখাইনকে বদলে দেবার জন্য সরকার এখন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালছে। গড়ে উঠছে নতুন নতুন শক্তিকেন্দ্র, সরকারি দালানকোঠা। বিশেষভাবে বলতে গেলে, সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষীদের ঘাঁটিও গড়ে উঠছে এখানে।
তবে নতুন নতুন স্থাপনাগুলো গড়ে উঠছে জাতিগত নির্মূলের শিকার হওয়া রোহিঙ্গা বসবাসের ছাইভস্মের ওপরেই।
অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইন্সটিটিউট তাদের আন্তর্জাতিক সাইবার পলিসি সেন্টার থেকে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কিছু ছবি প্রাপ্ত হয়েছে। সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে ২০১৭ সালের হত্যাযজ্ঞের পর অন্তত ৬০টি রোহিঙ্গা লোকালয় ভূপাতিত করা হয়েছে। গবেষণায় আরো দেখা যায়, রোহিঙ্গা গ্রাম নির্মূলকরণ প্রক্রিয়া এই বছরও বলবৎ রয়েছে।
মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ কখনো খোলাসা করে বলেনি ফেরত আসা এই রোহিঙ্গারা কোথায় থাকবে। যদিও তাদের বুলিতে প্রত্যাবাসী রোহিঙ্গা পরিবারের জন্য বসতি স্থাপনের কথা বলা হচ্ছে।
মধ্য রাখাইন প্রদেশের অন্তত ১২০,০০০ রোহিঙ্গাকে শনাক্ত করে ২০১২ সালের কোন্দল থেকেই অন্তরীণ করে রাখা হয়েছে। মিয়ানমারের বৌদ্ধ মতাবলম্বীরা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ছিনিয়ে নিয়েছে এবং তাদের ঘরও ধ্বংস করে ফেলেছে।
পরিবর্তিত এই রাখাইন রাজ্যের দিকে তাকালে দেখা যায় মুসলমানদের ধর্মীয় স্থাপনাগুলো ধ্বংস করে সেখানে প্যাগোডা নির্মাণ করা হচ্ছে। এই কাজগুলো পাচ্ছে সেনাবাহিনীর মদত পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোই। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনো সেনাবাহিনীর ক্ষমতাই প্রকটভাবে দৃশ্যমান।
আগস্টের ৫ তারিখে জাতিসংঘ থেকে পাওয়া প্রমাণাদি থেকে বলা হয়, সেনাবাহিনীর মদত পাওয়া এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে আর্থিকভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে বা তাদের অনুমোদন প্রাপ্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তারা এমনভাবে রাখাইনকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করছে যেন এখানে কখনো রোহিঙ্গা ছিলই না।
খারাপ কিছু দেখব না
জাতিসংঘ বলছে যেখানে সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নেই, সেখানে কোনো উদ্বাস্তু ফেরত যাবার প্রশ্নই আসে না। যদি জোর করে তাদের পাঠাবার ব্যবস্থা করা হয়, সেটা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি।
তবে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাবার জন্য রাখাইনের দৃশ্যপট আসলেই পরিবর্তন হয়েছে, সেটা প্রমাণ ও নিশ্চিত করবার চেষ্টা মিয়ানমার সরকার করছে না বললেই চলে।
রোহিঙ্গাদের জবানবন্দি ও মানবাধিকার সংঘগুলোর তদন্তের সূত্রানুযায়ী একথা বিদিত যে দেশটির রক্ষীবাহিনী নির্বিচারে ধর্ষণ ও পলায়নরত শিশুদের দিকেও গুলিবর্ষণ করেছে। দেশটির সরকার এই কথাটি মেনে নিতে নারাজ। তাদের মতে, রক্ষীবাহিনী কোনো অন্যায় কাজ করেনি।
‘একজন নিরীহ মুসলমানকেও হত্যা করা হয়নি,’ বলেন সু অং। তিনি মংদো পৌরসভার একজন কর্মকর্তা। হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ত থাকার কথা অং সান সু চি সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন। অপরদিকে, জাতিসংঘের নিয়োগকৃত তদন্ত অফিসাররা বলছেন মানবতার বিরুদ্ধে ঘৃণ্য এই অপরাধ সংগঠনের জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কমান্ডারদের বিচারের আওতায় আনা উচিত।
মিয়ানমার তাদের ঘর হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে অবস্থানরত এই রোহিঙ্গাদের অবৈধ অভিবাসীর আখ্যা দেয়া হয়েছে।
প্রত্যাবাসনের জন্য এগিয়ে আসাদের প্রমাণ করতে হবে যে তারা আসলেই মিয়ানমার থেকে এসেছে। পেছনে জ্বলন্ত বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।
এ ছাড়াও বিতর্কিতভাবে আরো একটি বিষয় উঠে এসেছে। যারা ফেরত আসতে চায়, তাদের পরিচয়পত্র গ্রহণ করতে হবে। এই পরিচয়পত্রে তাদের ভূমিহীনতার কথাটি যে অনুমোদিত হয়ে যাবে, সেটা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
মিয়ানমার সরকার এমনকি ‘রোহিঙ্গা’ নামটিও মেনে নিতে নারাজ। বদলে, যারা ফিরে আসছে, তাদেরকে বাঙালি বলে পরিচিতি প্রদান করা হবে। বলা হবে যে, এরা বাংলাদেশ থেকে আসা বিদেশি অনধিকার প্রবেশকারী। রাখাইন থেকে আগত কোনো জাতিগত গোষ্ঠী নয়।
‘আমরা রোহিঙ্গা,’ ফিসফিসিয়ে বলেন অশীতিপর বৃদ্ধ আবদুল কাদির। উত্তর রাখাইনের একটি গ্রাম্য মসজিদের ইমাম তিনি। হত্যাযজ্ঞ শুরু হবার সময় পালাতে পারেননি। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে আরো বলেন, ‘মিয়ানমারে আর কেউ এখন রোহিঙ্গাদের কথা বলে না। কেউ না।’
‘রোহিঙ্গা বলতে কিছু নেই,’ বলেন এন খু ইয়া প্রত্যাবর্তন কেন্দ্রের অভিবাসন কার্যালয়ের ডেপুটি হেড কিয়াও কিয়াও খাইন। ‘বিদেশিরা কেন এই কথাটা বলে?’
সীমান্তের ওপারে
মিয়ানমার সরকারের ভাষ্যমতে ঘটনাটি পাওয়া যায় এভাবে: রোহিঙ্গারা নিজেদের বাড়িঘর নিজেরাই পুড়িয়ে ফেলেছে আন্তর্জাতিক সমবেদনা ও আনুকূল্য লাভ করার জন্য। বাংলাদেশে মুসলমান দেশগুলো থেকে পাঠানো রসদের ওপর হামলে পড়ার জন্য তারা এই নাটক সাজিয়েছে।
মিয়ানমার সরকার এমনকি বাংলাদেশের ওপরও অভিযোগ এনেছে। তাদের অভিযোগ, বাংলাদেশের আদৌ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ইচ্ছা আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা দরকার।
‘হয়ত তারা চায় রোহিঙ্গারা ওখানেই থাকুক,’ বলেন উ কিয়াও সেইন, এন খু ইয়া ক্যাম্পের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা।
সত্যটা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আতিথেয়তা প্রদর্শনে বাংলাদেশ কোনো কমতি রাখেনি। গত কয়েক যুগে কেউ এভাবে সীমান্তের ওপারের একটি দেশ থেকে পালিয়ে আসা মানুষের ঢল দেখেনি। তবে এবার বাংলাদেশেরও ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে।
বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের বঙ্গোপসাগরের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ঘূর্ণিঝড় কবলিত একটি বেলাভূমির দিকে পাঠানোর হুমকি দিচ্ছে। বাংলাদেশ বিরাট এই রোহিঙ্গাদের উদ্বাস্তু হিসেবে মানতে চাইছে না। এই কথাটি জুড়ে দিলে ওদের চিরকাল নির্বাসনে থাকার অধিকারকে সীমাবদ্ধ করে।
ফলে, ক্যাম্পের বাইরে পড়াশোনা কিংবা কাজ করবার কোনো আইনত অধিকার রোহিঙ্গাদের নেই। মুসলমান আতঙ্কবাদীরা ক্যাম্প মসজিদের চারপাশে টহল দেয়। বিদ্রোহের মাঝেই মুক্তি মিলবে, এই আশ্বাস দেয়।
এখানে একটা জিনিসেরই কোনো অভাব নেই। তা হচ্ছে নিরাশা।
‘আমার বাচ্চারা চিরকাল কি এখানেই পড়ে থাকবে? এরকম একটা জীবনই কি ওদেরকে দেব আমি?’ প্রশ্ন করেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক দলনেতা জনাব ইসলাম।

পাদটীকা: রোহিঙ্গাদের কেউই চায় না, এমনকি তাদের মাতৃভূমিও নয়।
মিয়ানমারের এন খু ইয়া থেকে স নাং এবং জাতিসংঘের প্রতিনিধি মাইকেল শেউইর্টয মিলে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন।
[লেখাটি নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে নেয়া]

No comments

Powered by Blogger.