ঘনিয়ে আসছে এনআরসি প্রকাশের দিন, নামে যখন সব কিছু এসে যায়

হোজাই শহরের বছর চল্লিশেকের ছোট ব্যবসায়ী মনোজ দাস মারমুখী। “এখন কি আমার বুড়ো মা-কে টানতে টানতে ফরেনার্স ট্রাইবুনালে নিয়ে যাব! নাকি ওঁকে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হবে! এর চেয়ে তো মা-কে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা ভাল।”

মনোজের মা কমলার বয়স সত্তর ছুঁইছুঁই। গত বছরের জুলাই মাসে এনআরসির চূড়ান্ত খসড়ায় ওঁর নাম নেই। ৩১ অগাস্টের তালিকার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি সশঙ্কচিত্তে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ওই দিনই প্রকাশ করতে হবে এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকা।

অনেক প্রশ্ন এখন আসামের আকাশে বাতাসে ঘুরছে, যা রাজনৈতিক। যথা- কে নাগরিক, কে নয়, বাসস্থান কী, বাহিরই বা কাকে বলে, কে বহিরাগত, কে ভূমিপুত্র- এমন সব। এনআরসি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে নাগরিকত্ব স্থির হচ্ছে আসামের, পুরনো সব দস্তাবেজ আর মৌখিকপ্রমাণাদির মাধ্যমে যা স্থিরীকৃত হচ্ছে বা হতে চলেছে, তা নাগরিকত্ব নিয়ে এই সমস্যার সমাধান করতে পারছে না।

হলুদ হয়ে যাওয়া, ধারগুলো ছিঁড়ে যাওয়া কিন্তু ল্যামিনেট করা একটা কাগজ মনোজ দাসের হাতে। মায়ের নাগরিকত্ব প্রমাণের একমাত্র নথি। সেটা একটা সার্টিফিকেট। কমলার বাবা বিশ্বেশ্বর দাসকে দেওয়া সে সার্টিফিকেটে লেখা রয়েছে, তিনি পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থী। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে এটা লিগ্যাসি ডকুমেন্ট হিসেবে যথেষ্ট নয়। ফলে নাম ওঠেনি কমলার। দাস পরিবারে তিনিই একমাত্র তালিকাছুট। মনোজ, মনোজের বাবা, তাঁর স্ত্রী ও সন্তান – সবার নাম রয়েছে এনআরসি-তে।

কমলা আসামের শিবসাগর জেলার একটা স্কুলে ক্লাস ওয়ান পর্যন্ত পড়েছিলেন বটে, কিন্তু মনোজ বলছেন, স্কুলের কাছে অত পুরনো নথি নেই। ফলে ২০১৮ সালের শুনানির সময়ে নতুন কোনও নথি, মায়ের নাগরিকত্বের প্রমাণস্বরূপ, তিনি দিতে পারেননি। এবার মায়ের নাম যদি না ওঠে! বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছেন মনোজ।

কমলার এক বোন এবং প্রয়াত এক ভাইয়ের ছেলের নাম কিন্তু খসড়া তালিকায় উঠেছে।

Assam, NRC ধুবড়ি শহরের আয়েশা বিবি এনআরসি তালিকাভুক্তির আবেদনই করেননি (ফোটো- টোরা আগরওয়ালা)

হোজাইয়েরই ডোবোকা শহরে ৩৩ বছরের আব্দুল মতিন চিন্তিত। তাঁর স্ত্রী ২৪ বছরের নাসিমা বেগমের নাম নেই এনআরসি-র চূড়ান্ত খসড়ায়। গ্রাম পঞ্চায়েতের দেওয়া সার্টিফিকেট প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এবার তাঁদের নিকাহনামা জমা দিয়েছেন মতিন। ৩১ অগাস্টের তালিকায় নাম থাকবে নিশ্চয়ই, আশা করছেন তাঁরা।

ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অসমিয়াভাষী এলাকার অংশ হোজাই, তবে এখানে বেশ বড়সংখ্যক বাংলাভাষীর বাস। এখানকার জনসংখ্যার ৪৫.৫ শতাংশ হিন্দু ও ৫৩.৬ শতাংশ মুসলিম। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে একানকার ৫২ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা, ৩৩ শতাংশের কিছু বেশি অসমিয়াভাষী। এখানকার জনবিন্যাস কিছুটা স্থির হয়েছে দেশভাগের ফলে, অনেকটা স্থির হয়েছে, দেশের ভিন রাজ্য থেকে এখানে এসে বসবাসকারীদের দ্বারা।

হোজাইয়ের রাজনৈতিক গুরুত্বও কম নয়। এআইইউডিএফ নেতা বদরুদ্দিন আজমল একানকার সাংসদ, অন্যদিকে ফায়ারব্র্যান্ড বাঙালি বিজেপি নেতা শিলাদিত্য দেব হোজাইয়ের বিধায়ক। আসাম আরএসএসের অন্যতম কেন্দ্র হজাইয়েই অবস্থিত তাদের গীতা আশ্রম। এখানে নিয়মিত ক্যাম্প তো হয়ই, হয় প্রশিক্ষণ শিবিরও।

হোজাইয়ের নিজস্ব চরিত্রের কারণেই কোনও সম্প্রদায়ই তালিকাছুটের হাত থেকে বাগ পড়ছে না। বিজেপি নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে চূড়ান্ত তালিকা থেকে যদি বাঙালি হিন্দুরা বাদ পড়ে, তাহলে সমস্যায় পড়বে তারা। এরাই আসামে বিজেপির মূল ভোট ব্যাঙ্ক।

হোজাইয়ের বিজেপি বিধায়ক শিলাদিত্য দেব মদন মল্লিকের বাড়ি থেকে সদ্য ফিরেছেন। ১৯৮০-র দশকে ৬ বছর আসাম আন্দোলনে যে ৮৫৫ জন শহিদ হয়েছিলেন, তাঁদের অন্যতম মদন মল্লিক। মদন মল্লিকের স্ত্রী ফরেনার্স ট্রাইবুনালের নোটিস পেয়েছেন। তাঁর ও তাঁর ছেলের নাম সম্ভবত এনআরসি-তে উঠছে না।

“এই যদি এক শহিদের দশা হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের কপালে কী আছে বোঝাই যাচ্ছে।” বলছিলেন শিলাদিত্য। “দেশ ধর্মের ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। ফলে একটা পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত যাতে হিন্দুদের নাম এনআরসি তালিকা থেকে বাদ না পড়ে। সবকিছু আইন দিয়ে হয় না। যারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তাদের সে জ্ঞান থাকা উচিত।”

আসামের বিজেপি নেতাদের আশা নাগরিকত্ব বিল এনআরসি তালিকাছুট অ-মুসলিমদের রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়াবে।

যমুনামুখেপ বিধায় তথা বদরুদ্দিন আজমলের ছেলে আব্দুর রহিম আজমল বললেন, তাঁর আশঙ্কা সত্যিকারের ভারতীয়রা তালিকায় স্থান পাবে না।

ধুবড়ি- খসড়া এনআরসি তালিকায় নেই ৮.২৬ শতাংশ

ধুবড়ি জেলার চালাকুরা চর, আরও অনেকগুলো বালির চরের মতই। এই চরে জন্মেছিলেন আরমান সিকদারের প্রপিতামহ। ৬১ বছরের আরমান শিকদার সে মানুষটাকে মনে করতে পারেন না বটে, কিন্তু এই সময়ে, এনআরসি তালিকা প্রকাশের কয়েকিদন আগে, ঠাকুর্দার বাবার সে আবছা স্মৃতিই তাঁর ভয় দুর করতে সাহায্য করছে। গত জুলাই মাসে তিনটি চরে ছড়িয়ে থাকা আরমান শিকদারের পরিবারের মানুষজন দেখেন তাঁরা সবাই তালিকাছুট।

গত কয়েক বছর ধরে এই কৃষক পরিবার এতগুলি শুনানির মুখে পড়েছেন, যে তিনি এখন নিজেকে শুনানি বিশেষজ্ঞ হিসেবে দাবি করেন। ৩১ অগাস্টের তালিকায় যদি নাম না থাকে তাহলে আর ভয় পাবেন না তিনি। আরও শুনানিতে যাবেন তিনি, নথিপত্র সঙ্গে নিয়ে।

নমনি আসামের ধুবড়ি জেলায় শয়ে শয়ে চর। বাংলাদেশ সীমান্ত কয়েক মিটার মাত্র দূরে। এ চরগুলো বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের স্বর্গ বলে পরিচিত। আরমান শিকদারের চর আরেকটু দূরে, সীমান্ত এখান থেকে ২০ কিলোমিটার। তবু এক চর থেকে অন্য চরে যেতে হলে বিএসএফ তাঁদের আটকায়, অজস্র বার আইডি চায়, মাঝে মাঝে কারণ ছাড়াই মারধরও করে, বললেন তিনি।

বছরের পর বছর ধরে এটাই রুটিন। রাজনৈতিক নেতা বা বৃহত্তর অসমিয়া সমাজ এসবে গা করে না।

ফলে গত জুলাই মাসে যখন চূড়ান্ত এনআরসি খসড়ায় জেলার অধিকাংশের নাম ওঠার পর সেখানকার বাসিন্দারা স্বস্তির শ্বাস ফেলেছেন। ৪৯ বছরের আইনুল হক, চালাকুরার বাসিন্দা। “আমরা ওদের দেখিয়ে দিয়েছি।”

তবে এ উল্লাস দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। গত ১ অগাস্ট আসাম সরকার জেলাওয়ারি তালিকাছুটদের গোপন তালিকা প্রকাশ করেছে। তারা প্রশ্ন তুলেছে ধুবড়ির মত সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জেলায় তালিকাছুটের সংখ্যা এত কম কেন। ধুবড়ির তালিকাছুটের হার ৮.২৬ শতাংশ, রাজ্যের তালিকাছুটের হার ১২. ৫ শতাংশ।

বিজেপির হিমন্ত বিশ্বশর্মা সানডে এক্সপ্রেসকে বলেছেন “সীমান্তের জেলাগুলোতে, যেখান জনসংখ্যার বৃদ্ধি হঠাৎ ঘটে সেখানে তালিকাছুটের হার রাজ্যের তালিকাছুটের চেয়ে কম কী করে হয়!”

এধরনের খবর যখন ধুবড়িতে পৌঁছয় তখন লেখানকার বাসিন্দার ক্রুদ্ধ হন। “মাঝে মাঝে এসব দেখলে মনে হয় টিভিটাই ভেঙে দিই। এক নেতা বলেছেন, তিনি যখন ধুবড়িতে আসেন, তখন তাঁদের দুঃখ হয় চারপাশে শুধু বাংলাদেশি দেখে।” বলছিলেন আইনুল হক। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তিনি বিএসএফে কর্মরত ছিলেন। “গত বছর জুলাই মাসে আমি ভাবলাম এনআরসি এসব সংশয় দূর করে দেবে। কিন্তু কিছুই হল না। এনআরসি হোক আর না হোক, আমরা নিরাপদ নই। আমার মনে হয় আমাদের দেখতে বাংলাদেশিদের মত।”

ধুবড়ির চরগুলো ডুবে যায়, ফের ভেসে ওঠে। ব্রহ্মপুত্রের মর্জিমাফিক। চালকুরাও তার ব্যতিক্রম নয়। আরমান শিকদারের প্রপিতামহ যখন চালকুরায় থাকতেন, তখন সে চর এত বড় ছিল যে তাকে উত্তর ও দক্ষিণ- দুভাগে ভাগ করতে হত। কিন্তু ৩০ বছর আগে ব্রহ্মপুত্র তার বড় অংশ গিলে নেয়।

এনআরসি- শুরু থেকে এখন

১৯৫১:

আসামে প্রথম এনআরসি হল, ভিত্তি ছিল জনগণনা।

২০০৫:

১৯৫১ সালের এনআরসি আপডেট করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এক ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে। বৈঠকে ছিল কেন্দ্র, আসাম সরকার ও আসু (অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন)

২০১০:

এনআরসি আপডেটের পাইলট প্রজেক্টের জন্য নোটিফিকেশন জারি করা হয় বরপেটা ও কামরূপ জেলায়। কিন্তু এক বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে চারজনের মৃত্যু ও বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার পর এ প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হয়।

২০১৫:

সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে আসামে শুরু হয় এনআরসি আপডেট প্রক্রিয়া।

৩১ অগাস্ট, ২০১৫

এনআরসি-তে অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদনের শেষ তারিখ। মোট ৩.২৯ কোটি মানুষ আবেদন করেন।

৩১ ডিসেম্বর ২০১৭:

আংশিক এনআরসি খসড়া প্রকাশিত, ৩.২৯ কোটির মধ্যে নাম ওঠে মাত্র ১.৯ কোটির।

৩০ জুলাই, ২০১৮:

চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশিত, ৪০ লক্ষ আবেদনকারীর নাম বাদ। ৩৬ লক্ষ মানুষ ফের আবেদন করেন। যে ২.৮৯ কোটির নাম তালিকাভুক্ত হয়, তাঁদের মধ্যে ২ লক্ষের বিরুদ্ধে আপত্তি ওঠে।

২৬ জুন, ২০১৯:

অতিরিক্ত তালকাছুটের তালিকা প্রকাশিত হয়, আরও এক লক্ষ মানুষের নাম বাদ পড়ে।

৩১ অগাস্ট: চূড়ান্ত এনআরসি প্রকাশিত হবে।

No comments

Powered by Blogger.