নয়ন বন্ড ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত

নয়ন বন্ড
বরগুনায় রিফাত শরীফকে (২৫) কুপিয়ে হত্যা মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে ‘বন্ধুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। মঙ্গলবার (২ জুলাই) ভোর সোয়া চারটার দিকে বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের পুরাকাটা ফেরিঘাট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। বরগুনার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মারুফ হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মঙ্গলবার ভোর সোয়া চারটার দিকে রিফাত হত্যা মামলার প্রধান আসামি সাব্বির হোসেন নয়ন ওরফে নয়ন বন্ডকে গ্রেফতারে বরগুনা সদর উপজেলার বুড়ির চর ইউনিয়নের পুরাকাটা এলাকায় অভিযান চালায়। এ সময় পুলিশের ওপর গুলি চালায় নয়ন বন্ড ও তার সহযোগীরা। পুলিশও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালায়।
গোলাগুলির পর ঘটনাস্থলে তল্লাশি করে নয়ন বন্ডের গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনাস্থল থেকে একটি পিস্তল, এক রাউন্ড গুলি, দুটি শর্টগানের গুলির খোসা এবং তিনটি দেশীয় ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় চার পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। আহতরা হলেন- অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সদর সার্কেল শাজাহান হোসেন, এসআই  মনিরুজ্জামান, এসআই হাবিবুর রহমান ও কনস্টেবল হাবিব। আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
বরগুনার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুরাকাটা এলাকায় পুলিশ অভিযান পরিচালনা করলে মজিদ মিয়ার বাড়ি নামক স্থান থেকে নয়ন বন্ড ও তার সদস্যরা পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে গুলি চালায় । এসময় পুলিশও পাল্টা গুলি চালালে ঘটনাস্থলে নয়ন বন্ড নিহত হয়। তার সঙ্গীরা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। তাদেরকে ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে।’
রিফাত শরীফকে কোপানো হচ্ছে
নয়ন বন্ডের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আপরাধে থানায় আটটি মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
প্রসঙ্গত, গত ২৬ জুন (বুধবার) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে রাম দা দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে রিফাত শরীফকে। তার স্ত্রী আয়শা আক্তার মিন্নি হামলাকারীদের বাধা দিয়েও স্বামীকে রক্ষা করতে পারেননি। রিফাতকে কুপিয়ে অস্ত্র উঁচিয়ে এলাকা ত্যাগ করে হামলাকারীরা। তারা চেহারা লুকানোরও কোনও চেষ্টা করেনি। গুরুতর আহত রিফাতকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ওই দিন বিকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।।
কে এই নয়ন বন্ড
বরগুনা পৌর শহরের ডিকেপি রোড এলাকার মৃত সিদ্দিকুর রহমানের ছেলে সাব্বির আহমেদ নয়ন (নয়ন বন্ড)। শহরের কলেজ রোড, ডিকেপি সড়ক, কেজি স্কুল ও ধানসিঁড়ি সড়কে মূলত নয়নের বিচরণ ছিল। ছিনতাই, ছাত্রদের মুঠোফোন জিম্মি করে টাকা আদায়, ছোটখাটো মারধর থেকে তার অপরাধ প্রবণতা শুরু হলেও ২০১৭ সালে পুলিশি অভিযানে নয়নের কলেজ রোডের বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্যসহ তাকে আটক করে পুলিশ। এরপরই নয়ন নামটি লাইমলাইটে চলে আসে। ওই মামলায় জামিনে আসার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠে নয়ন। এরপর সে নিয়মিত মাদকব্যবসায় জড়িয়ে যায় এবং রিফাত ফরাজীকে সঙ্গে নিয়ে একটি গ্রুপ তৈরি করে। ওই গ্রুপে নয়নের সহযোগী হিসেবে বরগুনা পৌরসভার ৪নম্বর ওয়ার্ডের ধানসিঁড়ি সড়কের দুলাল ফরাজীর দুই ছেলে রিফাত ফরাজী ও তার ছোটভাই রিশান ফরাজী কাজ করতো।
নিহত রিফাত শরীফ
মূল নাম সাব্বির আহমেদ নয়ন  হলেও কর্মকাণ্ডের জন্য  রহস্য উপন্যাসের চরিত্র জেমস বন্ডের নাম নিজের নামে জুড়ে দেয় নয়ন। ফলে সহযোগীরা তাকে ডাকা শুরু করে ‘নয়ন বন্ড’ নামে। রিফাত ফরাজী ও অন্যদের সহযোগিতায় ধানসিঁড়ি সড়ক থেকে শুরু করে শহরজুড়ে অপরাধের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল নয়ন। বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হলেও আইনের ফাঁক গলে বের হয়ে ফের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে সে। চুরি ছিনতাই লুটপাট, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে নয়নের বিরুদ্ধে বরগুনা থানায় ৮টি মামলা রয়েছে।
নিহত রিফাতের আত্মীয় ও কয়েকজন বন্ধু জানান, এক বছর আগে বাকিতে সদাই বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় বিকেবি সড়কের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নয়া মিয়ার পা ভেঙে দেয় নয়ন। এর কিছুদিন পর বাসা থেকে প্রায় ১৫ লাখ টাকার ইয়াবা ও দেশীয় ধারালো অস্ত্রসহ নয়নকে গ্রেফতার করে বরগুনা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ।  এই মামলায় কিছুদিন কারাগারে থাকার পর জামিনে মুক্তি পেয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে নয়ন। কোনও রাজনৈতিক পদ-পদবি না থাকলেও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি ও সাবেক এমপি এবং বর্তমান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার ছেলে ছাত্রলীগ নামধারী রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীদের সঙ্গে চলাফেরা করায় কাউকেই পরোয়া করছিল না নয়ন।
১২ জনকে আসামি করে মামলা
রিফাত হত্যার পরদিন ২৭ জুন ১২ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন রিফাতের বাবা মো. আ. হালিম দুলাল শরীফ। আসামিরা হলো— সাব্বির আহমেদ নয়ন (নয়ন বন্ড) (২৫), মো. রিফাত ফরাজী (২৩), মো. রিশান ফরাজী (২০), চন্দন (২১), মো. মুসা, মো. রাব্বি আকন (১৯), মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), রায়হান (১৯), মো. হাসান (১৯), রিফাত (২০), অলি (২২) ও টিকটক হৃদয় (২১)। বাকি পাঁচ থেকে ছয় জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়।
এ মামলায় সোমবার (১ জুলাই) পর্যন্ত  ছয় জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এদের মধ্যে এজাহারভুক্ত দুই আসামি হলো—চন্দন ও মো. হাসান। এছাড়া, সন্দেহভাজন আরও চার জনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলো— তানভীর, মো. সাগর, কামরুল হাসান সাইমুন ও মো. নাজমুল হাসান।
দুই আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি
রিফাত হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে সোমবার (১ জুলাই) আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে মামলার এজাহারভুক্ত আসামি অলি ও জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার তানভীর। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার আরও তিন আসামির পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
সোমবার (১ জুলাই) বিকাল তিনটার দিকে রিফাত হত্যা মামলার পাঁচ আসামিকে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর বিকাল ৫টার দিকে মামলার এজাহারভুক্ত আসামি অলি ও জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার তানভীর আদালতে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দেয়।
বিচারক মোহাম্মাদ সিরাজুল ইসলাম গাজী আসামিদের জবানবন্দি শেষে জেল হাজতে পাঠান।
হাতকড়া পরা অবস্থায় পুলিশ হেফাজতে নয়ন বন্ড (কালো টি শার্ট, আগের ছবি)

No comments

Powered by Blogger.