বহু অভিযোগ নিয়েও দাপিয়ে বেড়াত ওরা by এম জসীম উদ্দীন ও মোহাম্মদ রফিক

বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যার ঘটনায় পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে। হত্যাকাণ্ডের ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোড়ন তোলার পর পুলিশ বলছে, হত্যার মূল অভিযোগ যাঁদের দিকে, সেই সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন (২৫) ও রিফাত ফরাজীর (২৫) বিরুদ্ধে আগেও বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। সাব্বিরের বিরুদ্ধে মাদকসহ অন্তত ১০টি মামলা রয়েছে। আর রিফাত ফরাজীর বিরুদ্ধে বিভিন্নজনকে কুপিয়ে আহত করা, ছিনতাই ও চাঁদাবাজির অভিযোগ অনেক পুরোনো। এমনকি এক পুলিশ কর্মকর্তার বাড়িতে ঢুকে চাপাতি দিয়ে তাণ্ডব চালানোর অভিযোগও ছিল তাঁর বিরুদ্ধে।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, রিফাত ও তাঁর ভাই রিশান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার ছেলে। প্রভাবশালীদের সঙ্গে আত্মীয়তার জোরে তাঁরা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিলেন। এ বিষয়ে দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘দুই বছর ধরে তাঁদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই। এসব বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’
নিহত রিফাত শরীফ বরগুনা সদরের বুড়িরচর ইউনিয়নের বড় লবণগোলা গ্রামের আবদুল হালিম ওরফে দুলাল শরিফের একমাত্র ছেলে। তাঁদের বাড়িতে কান্নার রোল। ঘরের মধ্যে স্বজন, প্রতিবেশীরা তাঁর মা ডেইজি আক্তারকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেরাই কাঁদছিলেন। মা বলেন, ‘আমার ছেলেটাকে কেন জানে মারল। পঙ্গু করে দিলেও তো আমার বুক আগলে থাকত!’
বরিশালে ময়নাতদন্ত শেষে বেলা তিনটার দিকে রিফাতের লাশ গ্রামে পৌঁছালে স্বজনদের কান্নার রোল পড়ে যায়। বিকেলে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। রিফাতের মাথা, বুক ও গলায় আটটি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এর মধ্যে তিনটি আঘাত গুরুতর।
প্রতিরোধ করেছিলেন একজনই
বুধবারের এই হামলার সময় বরগুনা জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম বাধা দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘শহরে যাওয়ার পথে দেখি রিফাত শরীফকে টানাটানি করছে চার-পাঁচজন। হাতে ধারালো অস্ত্র। একটা মেয়ে তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছে। আমিও সাহস করে এগিয়ে গেলাম, কিন্তু কিছুতেই ওদের থামানো গেল না। রক্তে ভিজে যাচ্ছিল রিফাত। কাউকে এগিয়ে আসতে না দেখে ভীষণ অসহায় লাগছিল।’
রিফাত শরীফকে হত্যার ঘটনায় গতকাল সকালে তাঁর বাবা আবদুল হালিম মামলা করেছেন। সাব্বির, রিফাত, রিশানসহ ১২ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৪-৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত পুলিশ এজাহারভুক্ত ৪ নম্বর আসামি চন্দন, ৯ নম্বর আসামি মো. হাসান ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে শনাক্ত করে আরেকজনকে আটক করার কথা জানিয়েছে। বরগুনার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন বলেন, ‘আমরা এ পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছি। এঁদের একজনের নাম তদন্তের স্বার্থে বলতে চাচ্ছি না। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে ব্যাপক অভিযান চলছে।’
আসামিদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অসংখ্য অভিযোগ।
প্রভাবশালীদের সঙ্গে আত্মীয়তার জোরে তাঁরা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন।

আসামিরা পুরোনো অপরাধী
আসামি রিফাত ও সাব্বিরের বিরুদ্ধে এলাকায় মাদক বিক্রি, সেবন ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। বরগুনা পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের দুলাল ফরাজীর বড় ছেলে রিফাত। বছর দুয়েক আগে রিফাত পুলিশের এসআই দেলোয়ার হোসেনের বাড়িতে ঢুকে ভাঙচুর করেন। এসআই দেলোয়ার বর্তমানে ঝালকাঠি সদর থানায়। তিনি বলেন, ‘এই রিফাত প্রায় দুই বছর আগে আমার বাসার সামনে বখাটেদের নিয়ে আড্ডা দিত। আমার স্ত্রী প্রতিবাদ করায় আমার বাসায় চাপাতি দিয়ে হামলা চালায় সে। তার সঙ্গে অনেক প্রভাবশালীর ছেলেরা থাকত এবং নেশা করত। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করলেও কিছুদিন পর ছাড়া পেয়ে যায়।’
২০১৭ সালের ১৫ জুলাই তরিকুল ইসলাম নামের এক প্রতিবেশীকে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করেন রিফাত ফরাজী। এ ছাড়া ধানসিঁড়ি রোড, কেজি স্কুল বাজার, ডিকেপি রোড এলাকায় লোকজনকে মারধর করে মুঠোফোন, অর্থ ‍ছিনিয়ে নেওয়া ছিল তাঁর নৈমিত্তিক ঘটনা। কয়েকবার গ্রেপ্তার হলেও ছাড়া পেয়ে আবার আগেরই মতোই অপরাধে জড়ান।
আরেক আসামি সাব্বিরের বিরুদ্ধে মাদক বিক্রি, সেবন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে বরগুনা থানায় অন্তত ১০টি মামলা রয়েছে। ২০১৭ সালের ৫ মার্চ রাতে নিজের বাড়ি থেকে ৩০০টি ইয়াবা, ১০০ গ্রাম হেরোইন, ১২ বোতল ফেনসিডিল, ২টি রামদাসহ ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন তিনি। এ ছাড়া বছর দুয়েক আগে ডিকেপি সড়কের রাজু নামের এক তরুণকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করেন নয়ন ও তাঁর সহযোগী রিফাত ফরাজী।

No comments

Powered by Blogger.