'এরইমধ্যে আমেরিকার বিরুদ্ধে ইরানের নৈতিক জয় হয়েছে'

'ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকার অর্থনৈতিক সন্ত্রাস দেশটিকে ভয়াবহ বিপদে ফেলবে। রেডিও তেহরানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে একথা বলেছেন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান
তিনি বলেন, আমেরিকা একের পর নানা অন্যায় ও ভুল পদক্ষেপ নিয়ে নিজেদেরকে নৈতিক দিক থেকে পরাজিত করছে। অপর দিকে ইরান নৈতিকভাবে জয়ী হচ্ছে- এতে কোনো সন্দেহ নেই।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান আরও বলেন, কথায় কথায় যে কোনো দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার আমেরিকার অনৈতিক অ্যাডভেঞ্চারিজমকে প্রশ্রয় দিলে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার জন্য একটা বড় রকমের অস্থিরতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে।
আমেরিকার অন্যায় আচরণ এবং ইসরাইলের অন্যান্য মারাত্মক পদক্ষেপ অত্যন্ত ভয়াবহ। গোলান মালভূমির উপর ইসরাইলি সার্বভৌমত্বে ট্রাম্পের স্বীকৃতির বিষয়টি যুদ্ধাপরাধের মতো।
আমেরিকার এসব মারাত্মক আচরণের কারণে শেষ পর্যন্ত মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির পরাজয় অনিবার্য বলে আমি মনে করি।
ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকার অর্থনৈতিক সন্ত্রাস আমেরিকাকে ভয়াবহ বিপদে ফেলবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
রেডিও তেহরান: জনাব, অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা কঠোর করার ঘোষণা দিয়েছে আমেরিকা। তারা কী এ ঘোষণা বাস্তবায়ন করতে পারবে বলে মনে হয়?
 
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
অধ্যাপক শাহীদুজ্জামান: দেখুন, আমেরিকা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করার যে ঘোষণা দিয়েছে তা তারা বাস্তবায়ন করতে পারবে কি না সে ব্যাপারে আমি অত্যন্ত সন্দেহ পোষণ করি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের নিষেধাজ্ঞাকে বেশি দূর টেনে নিয়ে যেতে পারবে কি না তাতে আমার সন্দেহ রয়েছে। যেসব দেশ তেল কিনছে আপাতদৃষ্টিতে হয়তো আমেরিকা এসব দেশের ওপর কিছুটা চাপ সৃষ্টি করবে। তারমধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারত রয়েছে। এসব দেশ ইরান থেকে সবসময় তেল ক্রয় করে। তাছাড়া ইরানের তেল ক্রয়ের দেশের তালিকায় চীন তো সবার ওপরে আছে। 
তবে আমার মনে হয় ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকার এই অবস্থানের ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী সোচ্চার ভূমিকা তৈরি হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোও মার্কিন চাপ সৃষ্টির প্রবণতাকে কাটিয়ে উঠছে। ইদানিং বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমেরিকার ট্রাম্প প্রশাসন  আচরণগত যে ব্যর্থতার প্রমাণ দিচ্ছে তাতে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ইমপিচ করার মতো ধারনা সামনে আসছে। যদিও হয়তো শেষ পর্যন্ত ইমপিচমেন্টের দিকে শেষ পর্যন্ত যাবে না। তবে এটা বোঝা যায় ট্রাম্পের অবস্থা অত্যন্ত বিতর্কিত।
ইরান বিষয়ে ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি বলতে গেলে সমালোচনার তালিকায় প্রথমেই রয়েছে। পরমাণু সমঝোতা হওয়ার পর তাদের এ ধরনের আচরণ একটা বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছু নয়। ইরানের প্রতি মার্কিন এসব আচরণ তাদের দেউলিয়াত্বের প্রমাণ বহন করে।
রেডিও তেহরান:  অনেক দেশ বলছে- এ নিষেধাজ্ঞা একতরফা ও অবৈধ। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সমাজ এর বিরুদ্ধে কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে?
 
হোয়াইট হাউজ
অধ্যাপক শাহীদুজ্জামান: দেখুন, এ ধরনের একতরফা নিষেধাজ্ঞার সবচেয়ে বড় উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে আমেরিকাকে, ট্রাম্প প্রশাসনকে এক্সপোজ করে দিচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী সর্বাত্মক সহানুভূতি কিন্তু ইরানের পক্ষে রয়েছে। অন্যদিকে আমেরিকার একটি বড় সুবিধা হচ্ছে তার বিশাল অর্থনীতিতে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ বিনিয়োগ করতে চায়। দেশগুলো আমেরিকার অর্থনীতিতে তাদের বাজার বজায় রাখতে চায়। 
অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাগুলো এত বেশি নৈতিকতা বিবর্জিত অবস্থান নেয় যে অন্যান্য দেশগুলো সেই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে যেয়ে হিমশিম খায়। কেননা মার্কিন প্রশাসন এখন পাল্টা ওইসব দেশকেও নিষেধাজ্ঞার আওতায় নিয়ে আসছে। সেখানে আমেরিকার ইউরোপীয় মিত্রগুলোও বাদ যাচ্ছে না। সুতরাং এই কঠিন পরিস্থিতিতে অন্যান্য দেশগুলোর পাল্টা ব্যবস্থা নেয়া বেশ কঠিন। তাছাড়া ওইসব দেশের এ বিষয়ে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার মতো পূর্ব অভিজ্ঞতাও নেই।
তবে ইরানই হচ্ছে একমাত্র দেশ যে দেশটি প্রথম কার্যকর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে আমেরিকার বিরুদ্ধে। ইরানকে অবশ্যই এ ব্যাপারে কিছুটা ধৈর্যশীল অবস্থানে থাকতে হবে। আর অন্যান্য দেশগুলো যেমন, রাশিয়া, চীন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো শেষ পর্যন্ত হয়তো একত্রিত হবে এবং পাল্টা ব্যবস্থা নেবে। কেননা আমেরিকার এ ধরনের অনৈতিক অ্যাডভেঞ্চারিজমকে প্রশ্রয় দিলে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার জন্য একটা বড় রকমের অস্থিরতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে। অস্থিতিশীলতার মাত্রা অগ্রহণযোগ্য হয়ে যেতে পারে। তখন দেখা যাবে ট্রাম্প প্রশাসন শেষ পর্যন্ত নিজের কনট্রাডিকশনেই ধরা পড়ে যাবে। 
রেডিও তেহরান:  ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরান তার ইচ্ছা অনুযায়ী যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু জ্বালানি তেল রপ্তানি করবে। এ ঘোষণাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
 
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী
অধ্যাপক শাহীদুজ্জামান: ইসলামি ইরানের সর্বোচ্চ নেতার এই বক্তব্য অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক ও আনন্দের খবর। আর আমরা এটাই শুনতে চাই ও দেখতে চাই। বিশ্বব্যাপী সবাই চায় ইরান যেভাবেই হোক কাটিয়ে উঠুক। ইরান একটি বিশাল দেশ। ইরানের বিশাল সম্পদ রয়েছে। আমেরিকা যদি আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে ইসরাইলের প্ররোচনায় নির্বুদ্ধিতার মতো এই কাজ না করত  তাহলে ইরান খুব স্বাভাবিকভাবেই মধ্যপ্রাচ্যে অনেক বড় একটি দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হতো।
আমরা প্রথম দিকে দেখেছিলাম ওবামা প্রশাসনের সময় থেকে পরমাণু সমঝোতা সই হওয়ার পর ইরানকে সবাই বুঝতে পারছিল যে তারা মধ্যপ্রাচ্যের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করবে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন তা ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। এ অবস্থায় ইরানের সর্বোচ্চ নেতা যে কথা বলেছেন, যে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরান তার ইচ্ছা অনুযায়ী যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু জ্বালানি তেল রপ্তানি করবে এটি খুবই আশার বিষয়। আমেরিকার অন্যায় আচরণ এবং ইসরাইলের অন্যান্য মারাত্মক পদক্ষেপ অত্যন্ত ভয়াবহ। গোলান মালভূমির উপর ইসরাইলি সার্বভৌমত্বে ট্রাম্পের স্বীকৃতির বিষয়টি যুদ্ধাপরাধের মতো। তাছাড়া জেরুজালেমের একত্রীকরণের প্রক্রিয়াকে আমেরিকার  সমর্থন জানানো অত্যন্ত ভয়াবহ আচরণ। এসব বিষয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বশর্ত হিসেবে তৈরি হতে পারে। এসব আচরণ ও কাজ কখনও টিকে থাকতে পারে না। আমেরিকার এসব মারাত্মক আচরণের কারণে শেষ পর্যন্ত মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির পরাজয় অনিবার্য বলে আমি মনে করি।
রেডিও তেহরান: বিভিন্ন দেশের ওপর আমেরিকা কথায় কথায় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। ইরান একে অর্থনৈতিক সন্ত্রাসবাদ বলছে। আপনার মতামত কী?
অধ্যাপক শাহীদুজ্জামান: নিশ্চয়ই আমেরিকা কথায় কথায় অন্য দেশের উপর বিশেষ করে ইরানের ওপর যে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সেটি অর্থনৈতিক সন্ত্রাসবাদ। ইরান যথার্থই বলেছে। এরচেয়ে উপযুক্ত ভাষা আর কোনো কিছু হতেই পারে না। নিশ্চয়ই এটি আমেরিকার অর্থনৈতিক সন্ত্রাসবাদ। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মাদ জাওয়াদ জারিফ
আর এ বিষয়টি শুধু ইরান বলছে এমনটিই নয়; ইরানের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোসহ ইউরোপের দেশগুলো যেমন জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালিসহ অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো বেশ ভালোভাবেই বোঝে এবং জানে তাদের সন্ত্রাসবাদের বিষয়টি। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ, উচ্চ শিক্ষিত, জ্ঞানী এবং খুবই সম্মানিত ব্যক্তি। দীর্ঘ দিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আছেন। তিনি বিশ্বব্যাপী কার্যকরভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন যে অর্থনৈতিক সন্ত্রাস বলতে কি বোঝায়! 
আমেরিকা একের পর নানা অন্যায় ও ভুল পদক্ষেপ নিয়ে নিজেদেরকে নৈতিক দিক থেকে পরাজিত করছে। অপর দিকে ইরান নৈতিকভাবে জয়ী হচ্ছে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমেরিকার এ ধরনের আচরণ কোনোসময় স্থায়ীত্ব পেতে পারে না। 
ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকার অর্থনৈতিক সন্ত্রাস আমেরিকাকে ভয়াবহ বিপদে ফেলবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এরইমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রভাব অনেক কমে গেছে আগের তুলনায়। মধ্যপ্রাচ্যে অনাকাঙ্খিত শক্তি আমেরিকা বর্তমানে সিরিয়া, ইরাক, লেবাননে যুদ্ধে ব্যস্ত রয়েছে। এসব জায়গায় তাদের আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমান অবস্থান অনেক দুর্বল। বিশ্বব্যাপী ট্রাম্প প্রশাসন এবং তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা ঘৃণিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে আমরা দেখতে পাই উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত আমেরিকাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাশিয়ার সাথে নতুন সংযোগ স্থাপন করেছে। বিশ্বব্যাপী আমেরিকাকে প্রত্যাখ্যান করাই হচ্ছে তাদের অপকর্মের উপযুক্ত জবাব।

No comments

Powered by Blogger.