অনেক কথা যাও যে বলে কোনো কথা না বলি

২৯ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। সফরটি সময়ের দিক দিয়ে সংক্ষিপ্ত হলেও গুরুত্বের দিক দিয়ে ছোট ছিল না। এ সফরের মধ্য দিয়ে অনেক বিষয় সামনে চলে আসে। জন কেরি প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিএনপি নেত্রীর সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত বৈঠকে আলোচনা করেন। তার সফর নিয়ে যুগপৎ মিডিয়া ও নাগরিক সমাজে কৌতূহলের কমতি ছিল না। জন কেরি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের আগে ধানমণ্ডির বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন। পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করেন। এরপর তিনি বৈঠক করেন মাঠের বিরোধী দল বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে। পরে তিনি ধানমণ্ডির ইএমকে সেন্টারে নাগরিক সমাজ, যুবসমাজের প্রতিনিধি, শ্রমিক সংগঠনের নেতা ও সাংবাদিকদের উদ্দেশে বক্তৃতা করেন। এসব মতবিনিময় ও বক্তব্যে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশের সঙ্গে একত্রে কাজ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেও জন কেরি গণতন্ত্রকে সমুন্নত রেখে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দমনের কথা বলে এবং সুশাসনের ওপর গুরুত্বারোপ করে অনেক কিছু বোঝাতে সক্ষম হন। জন কেরি চলে যাওয়ার পর তার বক্তব্যকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে দু’ভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়। সরকারদলীয় ব্যাখ্যায় কেরির বক্তব্যের নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে প্রদত্ত অংশকে বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করা হয়।
অন্যদিকে বিএনপি নেতৃত্বের মধ্যে জন কেরির বক্তব্যের গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার ও নির্বাচনের ইস্যুটিকে ফোকাসে আনার চেষ্টা লক্ষণীয়। নিরাপত্তা যে উন্নয়নের পূর্বশর্ত সে বিষয়টি জন কেরির আলোচনায় গুরুত্ব পায়। তবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে যে গণতন্ত্রকে আহত করা যাবে না, সে বিষয়টিও তিনি তার বক্তব্যে গুরুত্বসহকারে তুলে ধরেন। ধানমণ্ডির ইএমকে সেন্টারে প্রদত্ত বক্তব্যে তিনি বলেন, সন্ত্রাস দমন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, পাশাপাশি গণতন্ত্রের মূল্যবোধ সমুন্নত রাখাটাও জরুরি। এ মূল্যবোধকে অবহেলা করা যাবে না। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ‘জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় গণতন্ত্র এখনও সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য প্লাটফর্ম।’ এ বক্তব্যে সরকারের সমালোচনা না থাকলেও সরকারি দলের ‘স্বল্প গণতন্ত্র ও অধিক উন্নয়ন’ নীতির প্রতি যে তার পূর্ণ সমর্থন নেই তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। জঙ্গি দমনের ইস্যুতে এতদিন সরকারের পক্ষ থেকে স্বদেশী জঙ্গি হামলাগুলোকে স্থানীয় জঙ্গিদের কর্মকাণ্ড বলে যে বক্তব্য প্রদান করা হচ্ছিল, জন কেরির বক্তব্য সে প্রচারণাকে অনেকটাই ম্লান করে দেয়। তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশী জঙ্গিদের সঙ্গে যে সিরিয়া ও ইরাকের সন্ত্রাসীদের এবং আইএসের যোগাযোগ আছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশে চালানো সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এসব হামলা চালানোর জন্য সিরিয়া কিংবা ইরাক থেকে জঙ্গিরা বাংলাদেশে আসেনি এটা সত্য। তবে আমাদের কাছে প্রমাণ আছে,
বাংলাদেশে স্থানীয় জঙ্গিদের সঙ্গে আইএসের কোনো না কোনোভাবে যোগাযোগ আছে।’ কেরির সফরে একটি জনপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রথম লাইন- ‘অনেক কথা যাও যে বলে কোনো কথা না বলি’- মনে পড়ল। তিনি অনেক বক্তব্য না রেখেও ইঙ্গিতধর্মী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তা বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। দক্ষ কূটনীতিকরাই এমনটি করতে পারেন। যেমন, জন কেরি তার বক্তব্যে সরকারের সমালোচনা করেননি। দশম সংসদ নির্বাচনের সমালোচনা করেননি। সংসদের সমালোচনা করেননি। সংসদের বিরোধী দলের সমালোচনা করেননি। সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রীর সমালোচনা করেননি। কিন্তু এসব ক্ষেত্রের স্বচ্ছতা নিয়ে যে তার প্রশ্ন আছে, তা তার একটি মাত্র কাজের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি সংসদের বাইরের বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করে তার মনোভাবটি বুঝিয়ে দিয়েছেন। মাঠের বিরোধী দলের নেত্রীর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে জন কেরি সন্ত্রাস ইস্যু ছাড়াও বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বিএনপি নেতাদের জানান, বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন সুষ্ঠু করতে যুক্তরাষ্ট্র উদ্যোগ নেবে। তিনি চান বিএনপি পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। শুধু তাই নয়, তিনি বিএনপি নেত্রীর কাছে জানতে চান, তিনি পরবর্তী নির্বাচনের সময় কেমন সরকার আশা করেন।
খালেদা জিয়া এ জিজ্ঞাসার কূটনৈতিক উত্তর দেন। তিনি সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারের কথা না বলে জন কেরিকে বলেন, তিনি চান নির্বাচনকালে নির্বাচন কমিশন এবং সরকার যেন সব দলের সঙ্গে সমান আচরণ করে। জন কেরি খালেদা জিয়ার সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, তারাও তা-ই চান এবং যুক্তরাষ্ট্র সেজন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র প্রেসার গ্র“প হিসেবে কাজ করবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ দেশে নির্বাচনকালে দলীয় সরকার সব দলের প্রতি যে সমান আচরণ করে না এ সত্যটি বারবার প্রমাণিত হয়েছে। এমনকি দশম সংসদ নির্বাচনে এবং ওই নির্বাচনের পর অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় সরকার সব দলের প্রার্থীর প্রতি সমান আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি। খালেদা জিয়ার কাক্সিক্ষত ধরনের সরকারের অধীনে একাদশ সংসদ নির্বাচন করতে হলে যে সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি দলনিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হবে সে বিষয়টি বুঝতে অসুবিধা হয় না। কাজেই সরকারের পক্ষে দেশের জনগণ, রাজনৈতিক দল ও বহির্বিশ্বকে এ কথা বোঝানো কঠিন হবে যে, তারা নিজদলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন স্বচ্ছভাবে অনুষ্ঠান করতে সক্ষম হবেন। কারণ যে সরকার নিজ তত্ত্বাবধানে চার রকম স্থানীয় সরকার নির্বাচনের একটিতেও স্বচ্ছতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি, সেই একই সরকার কীভাবে সংসদ নির্বাচনে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করবে?
জন কেরির আলোচনায় নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার প্রশ্নও উত্থাপিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সব পক্ষই নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী ও স্বাধীন দেখতে চায়। এর অর্থ বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড যে ভালো হচ্ছে না, সে সত্যটি পরোক্ষভাবে স্বীকার করা। জন কেরির আলোচনায় এ বিষয়টি আনার অর্থ হল, আর কয়েক মাস পর নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনকালে বর্তমান কমিশনের মতো নতজানু ও দুর্বল নির্বাচন কমিশন গঠন না করার বিষয়ে সতর্ক করা। উল্লেখ্য, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে ক্ষমতাসীন দলীয় নেতাকর্মীরা ব্যাপক দুর্নীতি করলেও কমিশন ওই দুর্নীতিকারীদের শাস্তি দিতে পারেনি। সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন হলেও কমিশন জনগণের মধ্যে তার নিরপেক্ষ ও স্বাধীন ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। আর নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারলে তো স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব হবে না। কাজেই পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠনকালে কীভাবে একটি শক্তিশালী, স্বাধীন এবং সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন করা যায়, সে বিষয়ে সরকার এখনই সব দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করলে ভালো হয়। নির্বাচন কমিশন নিয়ে জন কেরির আলোচনা এসব বিষয়কে গুরুত্বের সঙ্গে সামনে আনে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র থাকবে,
নাকি গণতন্ত্রের লেবাসে দুর্বল নির্বাচন কমিশন ও নতজানু ‘জি হুজুর’ ধরনের বিরোধী দল সৃষ্টি করে দেশটি পরোক্ষভাবে একদলীয় শাসনের দিকে ধাবিত হবে, সে বিষয়টি নির্ভর করবে আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচনের ওপর। ওই নির্বাচনটি যদি ইনক্লুসিভ হয়, যদি দেশে ও বহির্বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা পায়, তাহলে দেশ গণতন্ত্র চর্চায় এগিয়ে যাবে। সংসদ কার্যকর হবে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠবে। আর যদি একাদশ সংসদ নির্বাচন আবারও সব দলের কাছে এবং দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা না পায়, তাহলে দেশে গণতন্ত্র পিছিয়ে যাবে। উন্নয়নের জোয়ার বইলেও শান্তি আসবে না। অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। শক্তি প্রয়োগ করেও উগ্রবাদ কমানো যাবে না। বিদেশী বিনিয়োগ আসবে না। সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হবে না। কাজেই সব দিক বিবেচনা করে বলা যায়, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিচিতি ও এ দেশের উন্নয়নের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে একাদশ সংসদ নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতার ওপর। রাজনৈতিক অঙ্গনে ওই নির্বাচনটি নির্ধারিত সময়ের আগে অনুষ্ঠানের গুঞ্জন যখন চাউর, সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির বাংলাদেশ সফর বাড়তি গুরুত্ব নিয়ে এসেছে। এ সফরকালে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কূটনৈতিক ভঙ্গিমায় অনেক কিছু না বলেও তার আলোচনা ও কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নাগরিক সমাজকে জঙ্গিবাদ, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ এবং আসন্ন সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে মার্কিন মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি উপলব্ধি করাতে সক্ষম হন।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
akhtermy@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.