শান্তিপূর্ণভাবে উদযাপিত হোক ঈদুল আজহা

ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার মধ্যে দুটি মৌলিক পার্থক্য আছে। প্রথমটি হল, দীর্ঘ এক মাস সংযম পালন করার পর ঈদুল ফিতরের জন্য একটিমাত্র দিন ধার্য করা থাকে। অপরদিকে ঈদুল আজহা পালন করার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তিনটি দিন বরাদ্দ করে দিয়েছেন। দ্বিতীয় পার্থক্যটি হল, দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর একটি দিন আনন্দ উদযাপনের জন্য আসে ঈদুল ফিতর। আর ঈদুল আজহা আসে ত্যাগের মহিমা নিয়ে। ঈদুল আজহা আমাদের মনে করিয়ে দেয় নবী হজরত ইবরাহিম (আ.) এবং তাঁর পুত্র নবী হজরত ইসমাইল (আ.)-এর কথা। ইবরাহিমকে (আ.) মুসলিম জাতির পিতা এবং মুসলিম জাতিকে মিল্লাতি ইবরাহিম বলা হয়।
এই কলামের সংক্ষিপ্ত পরিসরে কোরবানির ইতিহাসের দীর্ঘ বর্ণনায় যাব না। আমাদের সবারই জানা আছে, মহান আল্লাহর হুকুম মানতে গিয়ে ইবরাহিম (আ.) তার প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে (আ.) কোরবানি দিতে প্রস্তুত ছিলেন; উদ্যত হয়েছিলেন। কিন্তু মহান আল্লাহ পাক ইসমাইল (আ.)-এর স্থানে একটি দুম্বাকে শায়িত করে দেন। ফলে ইসমাইল (আ.)-এর পরিবর্তে সেখানে একটি দুম্বা কোরবানি হয়ে যায়। আমরা ওই ঘটনাকে স্মরণ করেই মহান আল্লাহর হুকুমে কোরবানি দিয়ে থাকি। মহান আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রিয় বস্তুকে কোরবানি দিতে বা বিসর্জন দিতে কেউ যেন পিছপা না হই, এটাই ঈদুল আজহার প্রকৃত শিক্ষা। মানুষ যেহেতু কোরবানি হবে না, তাই সম্পদের কিছু অংশ দিয়ে পশু ক্রয় করে মহান আল্লাহপাকের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে আমরা কোরবানি দেই। আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘কোরবানির রক্ত বা মাংস আমার কাছে পৌঁছায় না। তোমাদের ইচ্ছা তথা নিয়তই শুধু আমার কাছে পৌঁছায়।’ তবে লোক দেখানোর জন্য কেউ যদি কোরবানি দেন, তাহলে তার নিয়তটি দূষিত হয়ে যায়।
আমি কোনো ধর্মীয় ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য এ কলাম লিখছি না। তবে এই অনুচ্ছেদের উপরের অংশ থেকে একটি উপসংহার টানতে চাই- ত্যাগ স্বীকার করার জন্য মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। পৃথিবীতে যারাই বড় বড় নেতা হয়েছেন, তারা ত্যাগ স্বীকার করেছেন। মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে তারা জাতির অন্তরে জায়গা করে নিতে পেরেছেন। ত্যাগ স্বীকার না করে এবং নিজের ব্যক্তিস্বার্থকে ছোট করে জাতির স্বার্থকে বড় করে যদি কেউ দেখতে না পারেন, তাহলে তিনি কোনো দিনও একজন আদর্শ নেতা হতে পারবেন না বা নেতা হয়ে উঠবেন না। এ রকম আদর্শ নেতা হিসেবে আমরা উল্লেখ করতে চাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কথা, মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর কথা, মাহাথির মোহাম্মদের কথা, উইনস্টন চার্চিলের কথা, মহাত্মা গান্ধীর কথা, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কথা; যারা ব্যক্তি ও পারিবারিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশ ও জাতির জন্য কাজ করেছেন। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম, তাদের মহান আত্মত্যাগ বাঙালি জতি কখনই ভুলতে পারবে না। এ মুহূর্তে আমাদের দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিতে এমন নেতার খুব বেশি প্রয়োজন। আজ পবিত্র ঈদুল আজহা সামনে রেখে প্রথমত আহ্বান জানাচ্ছি, আমরা যে যেই অবস্থানেই থাকি না কেন, আমাদের দেখতে হবে আমাদের হাতে এমন কোনো সম্পদ আছে কিনা যেটা আমরা জাতির স্বার্থে ত্যাগ করতে পারি। দ্বিতীয়ত, আমাদের চিন্তা করতে হবে,
এ সমাজটা আমার একার নয়, সবার। অতএব পারস্পরিকভাবে প্রত্যেকেই যদি ত্যাগ স্বীকার করি, তাহলে সবার ত্যাগে সমাজ মহিমান্বিত ও উজ্জীবিত হবে; সামনে এগিয়ে যাবে। প্রায় দু’মাস আগে রোজার ঈদের ছয়-সাতদিন আগে ঢাকা মহানগরীর গুলশান এলাকায় হলি আর্টিজান নামক রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলা হয়। এটি ছিল একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা, যা আমাদের ইতিহাসের একটি কলংকময় অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। জঙ্গি হামলার পর থেকে মানুষের মনে যে আতংকের সৃষ্টি হয়েছে, তা এখনও পুরোপুরি মুছে যায়নি। এখনও অনেকের মনেই আতংকের রেশ রয়ে গেছে। এ আতংক কাটতে হয়তো আরও কিছুটা সময় লাগবে। এরই মাঝে আমাদের সামনে আরও একটি ঈদ এসে গেছে। কয়েকদিন পরই সবাই মিলে একসঙ্গে ঈদুল আজহার নামাজ পড়ার আশা রাখছি। ঈদের এই আনন্দের মাধ্যমে সবার মন থেকে মুছে যাক জরা, উৎকণ্ঠা। তবে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে- সবাই যেন নিশঙ্কচিত্তে উদ্বেগহীনভাবে ঈদুল আজহার নামাজ পড়তে পারেন এবং অনুষ্ঠানাদি পরিচালনা করতে পারেন। এই উদ্বেগহীন অবস্থা সৃষ্টির জন্য সবাইকেই কাজ করতে হবে। শুধু সরকারই নয়, বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরকেও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবী সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে। সবার সম্মিলিত ঐক্যই পারে দেশ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে। সমাজ থেকে অবসান হোক জঙ্গিবাদের, দূর হোক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। সমাজ হয়ে উঠুক শান্তিময়- এ প্রত্যাশায় এ লেখা শেষ করছি। পাঠককে জানাই ঈদের আগাম শুভেচ্ছা।
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক : কলাম লেখক; চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি

No comments

Powered by Blogger.