অন্তরালে দুই কিংবদন্তি- গ্রেটা গারবো থেকে সুচিত্রা সেন

গ্রেটা গারবো ও সুচিত্রা সেন। দু’জনেই অভিনেত্রী। একজন বাংলার মেয়ে। অন্যজন সুদূর সুইজারল্যান্ডের। তারপরও তাদের মধ্যে রয়েছে অদভুত মিল। তারা দু’জনেই চোখের চাহনিতে লিখে দিয়েছেন অমর কবিতা।
প্রেমের জয়গান তাতে ফুটে উঠেছে এক অকৃত্রিমতায়। সিনেমায় অভিনয় করতে গিয়ে দু’জনেই হারিয়ে গিয়েছিলেন প্রেমের এক গোপন ভুবনে। সেখান থেকে তাদের মুক্তি মেলে নি কোনদিন। নিজেরাই নিজেদের করেছেন লোকচক্ষুর আড়াল। সেভাবেই কেটে গেছে তাদের জীবনের বড় অংশ। বলা যায়, এ সময়টা তাদের জীবনের অন্ধকার সময়। নিজেরাই নিজেদের কষ্ট দিয়েছেন। ঘরের চার দেয়ালে বন্দি হয়েছেন স্বেচ্ছায়। তারপর আর কোনদিন পৃথিবীর কারও সামনে মুখ দেখান নি। শত চেষ্টা করেও তাদের একান্ত আপনজন বাদে কাউকে দেখান নি মুখ। এমন কি মৃত্যুর পরেও কাউকে দেখতে দেন নি ‘স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’কে। দেখতে দেন নি মৃত্যুর পরেও সেই অজস্র কবিতার চোখ এখনও উত্তম কুমারের জন্য পথ চেয়ে আছে কিনা। গ্রেটা গারবো কি জীবনের শেষ সময়টাতে তার প্রিয়তম জন গিলবার্টের ডাক শুনতে পেয়েছিলেন! ১৯০৫ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বরে সুইডেনের স্টকহোমে জন্ম গ্রেটা গারবোর। তিনি প্রথমে অভিনয়ে কাজ শুরু করেন ইউরোপে। এরপর ১৯ বসন্তের যুবতী গ্রেটা গারবো যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান এমজিএম-এর ব্যানারে কাজ করার জন্য। রমা দাস গুপ্তা যেমন কলকাতা গিয়ে সুচিত্রা সেন হয়ে ওঠেন, গ্রেটা গারবোর ক্ষেত্রে তেমন হয় নি। তিনি নাম পাল্টান নি। তার মতোই অসাধারণ, অবর্ণনীয় সৌন্দর্য্যের অধিকারী ছিলেন সুচিত্রা। শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তার আগে গ্রেটা গারবো কাজ করেন নির্বাক ও পরে সবাক চলচ্চিত্রে। তাকে বলা হয় হলিউডের সবচেয়ে খেয়ালি তারকা। তবে তার সঙ্গে সুচিত্রা সেনের রয়েছে কিছু পার্থক্য। গ্রেটা গারবো কখনও বিয়ে করেন নি। তার কোন সন্তান নেই। সারা জীবনই তিনি বেছে নেন নিঃসঙ্গ জীবন। কিন্তু সুচিত্রা সেন বিয়ে করার পরই এসেছেন চিত্রজগতে। তার কন্যা মুনমুন সেন, নাতনি রিয়া ও রাইমা সেন অভিনেত্রী। ১৮ বছর বয়সে কলকাতার বিশিষ্ট শিল্পপতি প্রিয়নাথ সেনের ছেলে দিবানাথ সেনের সঙ্গে বিয়ে হয় সুচিত্রার। গ্রেটা গারবো যাদের সঙ্গে চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ প্রেম গড়ে উঠেছিল জন গিলবার্টের সঙ্গে। ১৯২৬ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন সময়ে তিনি অবস্থান করেন গিলবার্টের সঙ্গে। তাদের মধ্যে এমন গাঢ় প্রেমকে পুুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে এমজিএম। এ সংস্থা তৈরি করে ‘ফ্লেশ অ্যান্ড দ্য ডেভিল’। নির্মিত হয় ‘লাভ’ এবং ‘এ ওম্যান অব অ্যাফেয়ার্স’। এগুলো ব্যবসাসফল হয়। বহুবার তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন গিলবার্ট। ১৯২৬ সালে একবার তাকে ইলেন বোর্ডম্যান ও কিং ভিদোরের সঙ্গে বিয়ের আয়োজন করা হয়। কিন্তু বিয়ের আসরে উপস্থিত হন নি গ্রেটা গারবো। ১৯৩৭ সালে লিওপোল্ড স্টকোস্কি নামে এক কনডাক্টরের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। তার সঙ্গে তিনি পরের বছরগুলো চুটিয়ে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। শুধু বন্ধুত্ব নয়, গাঢ় প্রেম। এই প্রেমের উন্মাতাল হাওয়ায় তারা মাঝে মাঝেই হারিয়ে যেতে থাকেন ইউরোপে। এছাড়াও গ্রেটা গারবোর প্রেম গড়ে উঠেছিল সিসিল বিটন, রাশিয়ার ধনকুবের দিলীপ কুমার, সঞ্জীব কুমার, ধর্মেন্দ্র, দেব আনন্দ, ভারত ভূষণ, শেখর, জর্জ শলির সঙ্গে। অন্যদিকে, সুচিত্রা সেন অভিনয় করেছেন উত্তম কুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বিকাশ রায়, বসন্ত চৌধুরী, কমল চিত্র, প্রশান্ত কুমার, রঞ্জিত মল্লিক প্রমুখের সঙ্গে। এর মধ্যে উত্তম-সুচিত্রা জুটি যেন জীবন্ত হয়ে কথা বলতো। তাদের অভিনয়কে কখনও মনে হয় নি অভিনয়। একান্তে, মনের গভীরে, চোখে চোখে তারা যে অভিনয় করে গেছেন তা তাদেরকে চিরজীবন দিয়েছে। তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল সত্যিকার প্রেম। তারই ধারাবাহিকতায় সুচিত্রা সেন চলচ্চিত্র থেকে অবসর নেয়ার পর ৩৫টি বছর ঘরের ভিতর নিজেকে বন্দি করে রেখেছিলেন। তিনি ছিলেন ভীষণ জেদি। ১৯৭৮ সালে তার ‘প্রণয় পাশা’ ভাল ব্যবসা করে নি। অভিমানে তিনি চলচ্চিত্র থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যান বাকিটা জীবন। ওদিকে গ্রেটা গারবোও চলচ্চিত্র থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। তিনিও নিজেকে লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। এ থেকেই বলাবলি আছে যে, তাকে দেখেই সুচিত্রা সেন লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যেতে উদ্বুদ্ধ হন। এ জন্যই সুচিত্রাকে কাব্য করে বলা হয় ‘বাংলার গ্রেটা গারবো’। তবে গ্রেটা গারবো বিয়ে না করলেও তার ছিল উদ্দাম, উন্মুক্ত প্রেমময় জীবন। তিনি একাধারে পুরুষ ও মেয়েদের সঙ্গে সমকামিতায় লিপ্ত হয়েছেন। ১৯২৭ সালে মঞ্চ ও চলচ্চিত্র অভিনেত্রী লিলিয়েন তাশমানের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। এরপরেই তারা প্রেমে পড়ে যান। এছাড়া সমকামিতা গড়ে ওঠে তার মারসিডিস ডি একোস্তার সঙ্গে। এ সময়ে তাদের মধ্যে বিনিময় হয় ১৮১টি প্রেমপত্র, কার্ড, টেলিগ্রাম। এর বেশির ভাগই এখন সংরক্ষিত আছে ফিলাডেলফিয়ার রোদেনবাক মিউজিয়াম অ্যান্ড লাইব্রেরিতে। শুরুর দিকে গ্রেটা গারবো চলচ্চিত্রের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলতেন। তিনি একা একা থাকতে ভালবাসতেন। কোন বন্ধুর সঙ্গে অযথা আড্ডা দেয়া পছন্দ করতেন না। তেমনি সুচিত্রা সেন প্রথম দিকে চলচ্চিত্রে আসতেই চান নি। তাকে বলা যায় অনেকটা জোর করে এ জগতে প্রবেশ ঘটিয়েছেন তার স্বামী। গ্রেটা গারবো কখনও অটোগ্রাফ দেননি। ভক্তদের চিঠির কোন জবাব দেন নি। সাক্ষাৎকার দিয়েছেন হাতেগোনা। কখনও তিনি অস্কার উৎসবে যোগ দেননি। তাকে অস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কারে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রচার বিমুখ গ্রেটা গারবো সেই পুরস্কার আনতে যান নি। লোকচক্ষুর অন্তরালে যখন তিনি নিজেকে নিয়ে যান তখন শত চেষ্টা করেও বাইরের কেউ তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেন নি। এ সময় ভীষণ বিষণ্নতা তাকে ঘিরে ধরে। এক পর্যায়ে তার স্তন ক্যান্সার ধরা পড়ে। ১৯৮৪ সালে এর জন্য তাকে সফল চিকিৎসা দেয়া হয়। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে শুধুমাত্র তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা জানতে পারেন সপ্তাহের তিন দিন- সোমবার, বুধবার ও শুক্রবার নিউ ইয়র্ক হাসপাতালের দ্য রোগোসিন ইনস্টিটিউটে ৬ ঘণ্টা করে তিনি ডায়ালাইসিস করান। ১৯৯০ সালের ১৫ই এপ্রিল ৮৪ বছর বয়সে ওই হাসপাতালেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। পরে শোনা যায় তিনি গ্যাস্ট্রিকেও আক্রান্ত হয়েছিলেন। তার মৃতদেহ সমাহিত করা হয়েছে মানহাটনে। অন্যদিকে সূচিত্রা সেন ফিরিয়ে দিয়েছেন রাজ কাপুরের অফার, গ্রহণ করেন নি দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার। স্বেচ্ছা অন্তরালে যাওয়ার আগে অভ্যস্ত ছিলেন তুমুল বৈভবের বিলাসী জীবনে। রঙ্গ-কৌতুকেও ছিলেন অভ্যস্ত। এক অনুষ্ঠানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের গেঞ্জি টেনে ছিঁড়ে দেখিয়েছিলেন কিভাবে এ দৃশ্যটি তিনি রূপায়িত করেছেন ‘সাত পাকে বাঁধা’ ছবিতে।

No comments

Powered by Blogger.