দুর্গন্ধমুক্ত স্বচ্ছ পানির জন্যে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে হাতিরঝিলের পানি by ফিরোজ মান্না

কেন্দ্র। ঝিলের পানি আরও নির্মল ও স্বচ্ছ করে ক্ষণিকের অতিথিদের প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ করে দেয়া হবে। পরিবার পরিজন নিয়ে কিছু সময় কিংবা একটা ছুটির দিন ভালভাবে কাটানোর সুযোগ করে দেয়ার জন্যই নেয়া হচ্ছে এসব উদ্যোগ।
ইতোমধ্যেই হাতিরঝিল রাজধানীর সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে সমন্বয়কারী আবদুল মান্নান খান জনকণ্ঠকে বলেন, প্রকল্পের কাজ অনেক বাকি। এখনই এটি বিশ্বের অন্যতম সুন্দর একটি দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। বিনোদনকেন্দ্র ছাড়াও গোটা প্রকল্পটিকে সাজানো হবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে। থাকবে সবুজের সমারোহ, গাছপালা, পশুপাখির কলরব। কাজ শেষ হলে শুধু দেশর মানুষই নয়, বিশ্ববাসী অবাক বিষয়ে দেখবে এবং বলবে ‘বাংলাদেশও কিছু করতে পারে’। তিনি বলেন, প্রকল্পের কাজ চালাতে অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঠিক দৃঢ় দিকনির্দেশনা এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আমরা কাজটি করতে পেরেছি। এজন্য তিনি প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানান।
বৃহস্পতিবার প্রকল্প ঘুরে দেখা গেছে, অসমাপ্ত কাজগুলো এগিয়ে চলেছে দ্রুততার সঙ্গে। আরও কিছু অবকাঠানো তৈরির লক্ষ্যে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে ঝিলের পানি। প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু সাঈদ এম মাসুদ জানান, বিভিন্ন ধরনের বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য কাজ চলছে। এছাড়া চলছে পানি নিষ্কাশন ও পরিশোধন ব্যবস্থার কাজ। একারণে গোটা ঝিলের পানি সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। ঝিলের পানিতে এখনও কিছুটা দুর্গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আগামী বর্ষা মৌসুমে গন্ধহীন নির্মল স্বচ্ছ পানি পাওয়া যাবে বলে আমরা আশা করি। নির্মাণাধীন প্রকল্প পরিদর্শনে এখন প্রতিদিন হাজার হাজার ভিড় জমাচ্ছেন। নির্মল বাতাস আর মনোরম পরিবেশ দেখে সবাই মুগ্ধ। মানুষ প্রাণ খুলে নিঃশ্বান নিচ্ছেন। দৃষ্টিনন্দন এ ঝিলের পানি এখনও কিছুটা অস্বচ্ছ। তবে ময়লা আবর্জনার দেখা মিলবে না। এ একটা ঝিলের কারণে ঢাকা মহানগরী সৌন্দর্যে ও পরিবেশের দিকে থেকে পৃথিবীর শহরগুলোর তালিকার ওপরে উঠে এসেছে। হাতিরঝিলটি এখন নগরবাসীর বিনোদনকেন্দ্র। ঝিলের অনেক জায়গায় গড়ে তোলা হবে বিনোদনের জন্য নানা অবকাঠামো। আগামী জুনের আগেই ফিনিশিং কাজগুলো শেষ হবে।
হাতিরঝিলের ওয়ার্কওয়ের দুই ধার ঘেঁষে ফুলে ফুলে সাজানো বাগান আর নানা রং বেরঙের পতাকায় সজ্জিত হাতিরঝিল উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত দুই জানুয়ারি। রাজধানীর কার্বন আর সিসাযুক্ত বাতাসের মধ্যে এ এলাকাটি মুক্ত হিসেবে মানুষের মধ্যে দারুণ উৎসাহের সৃষ্টি করে। সকাল-বিকালে হাজার হাজার নর-নারী প্রকল্প এলাকায় ঘুরে বেড়ান। তাদের বক্তব্য ঢাকার বুকে এমন একটি জায়গা পেয়ে তারা ভীষণ আনন্দিত। প্রকল্প পরিচালক মাসুদ বলেন, প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের আগমন দেখে মনে হয় হাতিরঝিলটি যদি আরও সুন্দর করা যেত। মানুষের কাছে স্থানটি আরও আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা যেত। আমরা সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছি। পানি সরিয়ে যখন নানারকম বিনোদন অবকাঠামো তৈরি করব তখন এটি মানুষের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হবে। এখন যে পরিমাণ মানুষ হাতিরঝিল দেখতে আসেন তখন আরও বেশি মানুষ এখানে বেড়াতে আসবেন। মোট ১ হাজার ৯৭১ কোটি টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়নকালে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদসহ নানা প্রতিকূলতা ছিল। সরকারের সদিচ্ছায় সবকিছু কাটিয়ে উঠা গেছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে এটাই প্রতীয়মান হয়েছে যে, সম্মিলিতভাবে আমরা যে কোন কঠিন কাজ করতে সক্ষম। এখনও কিছু অবৈধ দখলদার ঝিলে রয়েছে। যাদের উচ্ছেদের জন্য রাজউক ও জেলা প্রশাসন কাজ করবে।
উল্লেখ্য, রাজধানীর পূর্ব থেকে পশ্চিমের যোগাযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়, যা বাস্তবায়নে ৯৩ শতাংশ অর্থের যোগান দেয় সরকার। ২০০৭ সালের ৮ অক্টোবর একনেকে এক হাজার ৪৭৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকার এই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। পরে ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয়সহ সংশোধিত প্রকল্প ব্যয় দাঁড়ায় এক হাজার ৯৭১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। সমন্বিত এ প্রকল্পের প্রাণ হাতিরঝিল ও বেগুনবাড়ী খাল, যার দুই পাশ দিয়ে যানবাহন চলাচলের জন্য তৈরি করা হয়েছে ১৬ কিলোমিটার সড়ক, চারটি সেতু, আরও চারটি ক্ষুদ্র সেতু (ভায়াডাক্ট) এবং চলাচলের জন্য চারটি ওভারপাস। বিনোদনের জন্য খালে থাকছে নৌকা চালানোর ব্যবস্থা, ছোট পরিসরে পিকনিক স্পটসহ কিছু সুবিধা। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সেনাবাহিনীর ১৬ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন, ঢাকা ওয়াসা এবং এলজিইডি যৌথভাবে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। প্রকল্পে পরামর্শকের দায়িত্বে ছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকল্প এলাকায় চরটি ব্রিজ এবং চারটি ওভারপাসের নির্মাণ করা হয়েছে। বেশিরভাগ অবকাঠামোর নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ। এখন চলছে ফিনিশিং টাচ কিছুটা বাকি আছে। এসব ওভারপাস ও ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে দিব্যি সাধারণ মানুষের চলাচলের জন্য বুধবার থেকে খুলে দেয়া হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় চারটি ব্রিজ, চারটি ওভারপাস, ৮ দশমিক ৮ কিলোমিটার সার্ভিস রোড, ৮ কিলোমিটার এক্সপ্রেস রোড, ২৬০ মিটার ভায়োড্যাক্ট, প্রায় ১২ কিলোমিটার ওয়াকওয়েসহ ঢাকা ওয়াসার তত্ত্বাবধানে ডাইভারশন স্যুয়ারেস এবং স্পেশাল ডাইভারশন স্ট্রাকচার নির্মাণ। প্রকল্পের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে গুলশান সংযোগকারী একটি ব্রিজ এবং রামপুরা ব্রিজের দু’পাশে দু’টি ইউলুপ নির্মাণ। এ দু’টি ইউলুপ নির্মাণের কারণে হাতিরঝিল থেকে আসা সড়কটি রামপুরা প্রগতি সরণীতে এসে মিলেছে। এ জন্য কোন ইন্টারসেকশনের প্রয়োজন হবে না। ফলে বাড়তি যানজটের সৃষ্টি থেকে মুক্ত থাকবে। রামপুরা ব্রিজ এলাকায় বিদ্যমান যানজট কমে যাবে। টঙ্গী ডাইভারশন রোড অংশে ইউলুপ নির্মাণ করা হচ্ছে না। সাতরাস্তা থেকে মৌচাক পর্যন্ত প্রস্তাবিত ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে। এখানে ইউলুপ নির্মাণ করা হলে এ ফ্লাইওভারে গতিপথ বাধাগ্রস্ত হবে। তবে ফ্লাইওভারের একটি র‌্যাম হাতিরঝিলের একটি সড়কের সঙ্গে মিশে যাবে।
নগরবিদরা মনে করেন, মানুষের অসচেতনার কারণে ঝিলটির সৌন্দর্য অল্পদিনের মধ্যে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রকল্পের কাজ হয়েছে। এখন সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানেই প্রকল্পটি দেখা শোনার জন্য আলাদা একটি কর্তৃপক্ষ তৈরি করা প্রয়োজন। একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর তত্ত্বাবধানে থাকলে এর দেখভাল যেমন যথাযথ হবে তেমনি সাধারন দর্শনার্থীরা একটা শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে চলবে। এছাড়া প্রকল্পে যানবাহন চলাচল এবং দর্শনার্থীদের প্রবেশে সামান্য হলেও ফি নির্ধারণ করে দেয়া হলে পরিচালনা ব্যয় উঠে আসার পাশাপাশি দর্শনার্থীদের সচেতন করা যাবে বলেও অনেকে মনে করেন।

No comments

Powered by Blogger.