প্রিয় গান- ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ by আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

আমার জীবনে একটা বড় আক্ষেপ—আমি গান গাইতে পারি না। তবে গান সব সময় আমাকে প্রভাবিত করেছে। একসময় পাগলের মতো গান শুনেছি—বাংলা গান, অন্য ভাষার গান।
এই তো সেদিনও ফরিদা পারভীনের গলায় লালন সাঁইয়ের একটি গান শুনছিলাম—‘সময় গেলে সাধন হবে না,/দিন থাকিতে দিনের সাধন তুমি কেন জানলে না।’ আজ এই বয়সে এসে এই গানটি শুনলে কেন যেন আমার চোখে পানি এসে যায়। মনে হয়, জীবনের অনেক সময় অযথা অপচয় করে ফেলেছি। রবীন্দ্রনাথ তো ঠিক আমার মতোই একটা জীবন পেয়েছিলেন। অথচ আমার চেয়ে সাত গুণ কাজ করেছেন। আমি আমার জীবনের ছয় গুণই অবহেলা-অপচয়ে নষ্ট করলাম। অনেক কিছু করার কথা ছিল, দেওয়ারও কথা ছিল। কিছুই পারিনি—দিন থাকতে দিনের সাধন করিনি।
রবীন্দ্রনাথের তেমন কোনো বন্ধু ছিল না। এক জীবনে তাঁর যত দুঃখ-কষ্ট, সবই তিনি একা ধারণ করেছেন, প্রকাশ করেছেন শিল্পের মধ্য দিয়ে। তাই রবীন্দ্রনাথের গান শুনলে, বই পড়লে মনে হয়, আমাদের সব অনুভূতিই যেন লিখে গেছেন তিনি! আমি তো এসব কিছইু করতে পারিনি—এসব ভাবলেই চোখ পানিতে ভরে ওঠে।
গান মানুষের বোধ ও উপলব্ধিকে ঐশ্বর্য দেয়। উদ্দীপনার জায়গাতেও দান করে ঐশ্বর্য। ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ গানটি নানাভাবে নানা অর্থে আমার উপলব্ধিতে ঐশ্বর্য হয়ে ধরা পড়েছে। আমি যে সময়কে ঠিকমতো ব্যবহার করিনি, তাই ভেবে আজ কাঁদছি।
একটা মোমবাতির সার্থকতা কোথায়? জ্বলে জ্বলে আলো দিয়ে ছাই হয়ে যাওয়ার মধ্যে। আমি যে জ্বললামই না! অদগ্ধীভূত কাঠের মতো পৃথিবী থেকে চলে যাচ্ছি। এ জন্য মরতে কষ্ট হয়।
ফরিদা পারভীনের গলায় গানটি অনুপম হয়ে ওঠে। কারণ, তাঁর দরদি কণ্ঠ এবং গায়কিতে আছে এমন এক জাদু, যা লালনের সময় ও আমার সময়কে এক সুতোয় বাঁধতে পেরেছে। কিছুটা নাগরিক, কিছুটা গ্রামীণ—আজকের উপযোগী করে গান পরিবেশন করেন ফরিদা। পরিবেশনায় গানের শুদ্ধতাও থাকে অটুট। উচ্চারণে এর আঞ্চলিক রূপটির শুদ্ধতাও পাওয়া যায়। ফরিদা পারভীনের গলায় লালনের এই গান শুনলে মনে হয়, দীর্ঘায়িত শূন্যতার মধ্যে বেদনার একটা আকাশ কেঁদে কেঁদে ফিরছে। ‘সময় গেলে সাধন হবে না’—এ গানের মধ্যে বেদনার সেই অবয়বটি যেন পৃথিবীময় কেঁদে বেড়াচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.