এখন সময় রাহুলের by সুমন কায়সার

বছর কয়েক ধরে এই মুহূর্তের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন অগণিত কংগ্রেস-সমর্থক। ভারতের সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দলটির দুঃসময়ে রাহুল গান্ধীকেই ভরসা হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন দলের জ্যেষ্ঠ নেতারাও। কংগ্রেসের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মানুষ মা সোনিয়া গান্ধী নেপথ্যেই থাকতে চান।
একসময়ের সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতা মনমোহন সিং স্পষ্টতই ক্লান্ত। কোটি সমর্থকের সবার আস্থা আছে, এমন একজন নেতাও হাতের কাছে নেই—এমন অবস্থায় তারুণ্যের পছন্দ রাহুল গান্ধীর হাতে আজকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার বিকল্প ছিল না হয়তো। মা সোনিয়া গান্ধীসহ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব তারই আনুষ্ঠানিকতা সারলেন, বংশানুক্রমিক রাজনীতি দীর্ঘায়িত করার দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার অনিবার্যতা জেনেও।
প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর ছেলে রাহুল অনেক দিন ধরেই বিশাল দল জাতীয় কংগ্রেসের বেশ কয়েকজন সাধারণ সম্পাদকের একজন। ১৮-১৯ জানুয়ারি রাজস্থানের রাজধানী জয়পুরে দলের ‘চিন্তন শিবিরের’ পাশাপাশি অনুষ্ঠিত কার্যকরী কমিটির বৈঠকে সহসভাপতি পদে উন্নীত করা হয়েছে তাঁকে। সংক্ষেপে বলতে গেলে এর তাৎপর্য হচ্ছে, কংগ্রেসের আগামী নির্বাচনের প্রচারণায় নেতৃত্ব দেওয়া এবং নির্বাচনে দল জিতলে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকতার বাধা থাকবে না।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, কংগ্রেস দল ব্যাপক ভাবনাচিন্তার পরই অবশেষে ৪২ বছর বয়সী রাহুলকে দেশের আগামী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি নিয়েছে। সরকারে একের পর এক বিব্রতকর কেলেঙ্কারি ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাতে বিপর্যস্ত কংগ্রেসের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য রাহুলের ওপর চাপ বাড়ছিল। তবে তিনি নিজে এত দিন আগ্রহ না দেখিয়ে নেপথ্যে থেকে দলের কাজ করে গেছেন। হয়তো নিজেকে তৈরি করছিলেন শিখরে ওঠার জন্য। সহসভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর সোনিয়াতনয় সাংবাদিকদের বলেন, দলের দ্বিতীয় শীর্ষ পদের যে চ্যালেঞ্জ, তা গ্রহণের জন্য তিনি তৈরি।
রাহুল গান্ধীকে কংগ্রেসের দ্বিতীয় শীর্ষ পদে বসানোর প্রতিক্রিয়া হয়েছে মিশ্র। কেউ যেমন বলছেন, রাহুল দলকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবেন; তেমনি কেউ আবার মনে করেন, তাঁকে সহসভাপতি করা বংশকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির চক্র থেকে বের হতে কংগ্রেসের ব্যর্থতারই প্রমাণ।
যে যা-ই বলুন, বাস্তবতা হচ্ছে, রাহুল গান্ধী প্রায় নিশ্চিতভাবেই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে হাঁটছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা হচ্ছে প্রধান বিরোধীদল বিজেপির বিতর্কিত নেতা গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। শহরকেন্দ্রিক তরুণ ভোটারদের মধ্যে জনপ্রিয়তায় মোদীর তুলনায় রাহুল এগিয়ে। আর এই শ্রেণীর ভোটাররা এখন ভারতের বর্তমান নির্বাচকণ্ডলীর একটি উল্লেখযোগ্য ও ক্রমবর্ধমান অংশ। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ভারতের জনমিতির এই পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে কৌশল সাজাচ্ছে কংগ্রেস; গান্ধী-ম্যাজিকের ওপরে ভরসা তো আছেই।
স্বাভাবিকভাবেই রাহুলের ওপর কংগ্রেস-সমর্থকসহ ভারতীয়দের প্রত্যাশার মাত্রা বেড়ে যাবে অনেক। রাহুল জানেন এ প্রত্যাশা পূরণ কতটা কঠিন। এ জন্য চাই বড় ধরনের পরিবর্তন। সহসভাপতির দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রথম ভাষণে রাহুল বলেছেন, বর্তমানের ‘জবাবদিহিবিহীন, কেন্দ্রীভূত’ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। অনেকের মনে ভারতের মতো দেশের নেতৃত্ব দিতে রাহুল আসলেই কতটা প্রস্তুত, এমনকি যোগ্য, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। একটা সময় মনে করা হতো, রাহুলের চেয়ে তাঁর বোন প্রিয়াংকারই রাজনীতিতে সম্ভাবনা বেশি। রাহুলকে মনে করা হতো রাজনীতিবিমুখ। দলিতদের সঙ্গে অবলীলায় মিশে বা সাধারণের মতো পাতালরেলে ভ্রমণ করে বিভিন্ন সময় নিজের গণমুখী দিকটি তুলে ধরলেও প্রকাশ্যে বক্তব্য দিতে অনীহা দেখিয়ে এসেছেন। অর্থনৈতিক সংস্কার ও ‘চিরন্তন’ সমস্যা পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে রাহুলের দৃষ্টিভঙ্গি বা ভাবনা জনগণের কাছে খুব স্পষ্ট নয়। তবে এসব কিছু মাথায় রেখেও তাঁর উত্থানকে নতুন যুগের সূচনা বলেই মনে করা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.