বিশ্বজিৎ হত্যাঃ ভিডিও ফুটেজের সাথে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের সামঞ্জস্যতা নেই

পুরান ঢাকায় ছাত্রলীগের হামলায় নিহত বিশ্বজিৎ দাসের হত্যকাণ্ডের পর তৈরি করা সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন হাইকোর্ট।
আদালত ওই দু’টি প্রতিবেদন তৈরিকারীদের বলেছেন, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজের সাথে আপনাদের প্রতিবেদনের সামঞ্জস্য নেই। কাউকে বাঁচানোর জন্যই এ ধরনের প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে কি-না সে প্রশ্ন তোলেন আদালত। বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি মাহমুদুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল বৃহস্পতিবার এ মন্তব্য করেন।

আদালতের নির্দেশে গতকাল সকালে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী চিকিৎসক ডা: মাকসুদুর রহমান ও সুরতহাল প্রস্তুতকারী পুলিশের এসআই জাহিদুল হক আদালতে হাজির হওয়ার পর শুনানিতে আদালত এ মন্তব্য করেন।

আদালত ময়নাতদন্ত ও সুরতহাল প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে বলেন, প্রতিবেদনে বিশ্বজিতের পিঠে, কোমরের ওপর ও পায়ে হালকা জখম দেখা যায় বলা হয়েছে। ডান হাতের পাখনার নিচে তিন ইঞ্চি কাটা জখম, বাম পায়ের হাঁটুর নিছে ছেঁড়া জখম। এ সময় আদালতের জিজ্ঞাসার জবাবে সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী সূত্রাপুর থানার এসআই মো: জাহিদুল হক বলেন, পৌনে ১২টায় আমি লাশের সুরতহাল করেছি। সকাল ৯টার দিকে এ ঘটনা ঘটেছে। লাশের সুরতহাল করার সময় ডান হাতের পাখনার নিচে জখম দেখতে পেয়েছি। তা থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। এ কারণেই সে মারা গেছে। এ সময় ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ডা: মাকসুদুর রহমান আদালতকে বলেন, পাখনার নিচে ধমনীটা (আর্টারি) কেটে যাওয়ার কারণেই বিশ্বজিৎ মারা যায়।

এ পর্যায়ে আদালত পুলিশের কাছে জানতে চান, বিশ্বজিৎকে কে হাসপাতালে নিয়ে যায়? জবাবে পুলিশ বলেন, কোনো পুলিশ সদস্য তাকে হাসপাতালে নেয়নি। একজন রিকশাচালক তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ওই রিকশাচালক আমাকে বলেছে, ‘তাকে প্রথমে ন্যাশনাল হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখানকার চিকিৎসকেরা বলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে।’ এ পর্যায়ে আদালত বলেন, একজন রিকশাওয়ালা হাসপাতালে নিয়ে গেছে। পুলিশ নিয়ে যেতে পারল না, এটা জাতির জন্য বড়ই দর্ভাগ্যজনক। রিকশাওয়ালা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। তাকে পুরস্কৃত করা উচিত।

এরপর আদালত সংশ্লিষ্ট ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদারের কাছে জানতে চান, ঢাকা মেডিক্যালের জরুরি বিভাগে বিশ্বজিৎকে যথাযথ চিকিৎসা দিয়েছিল কি না? জবাবে অমিত তালুকদার বলেন, এ ব্যাপারে আমার কাছে সঠিক কোনো তথ্য নেই। তবে তিনি বলেন, সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে নেয়া হয়। এর ২৫ মিনিট পর ৯টা ৫০ মিনিটে মারা যায়। আদালত বলেন, জরুরি বিভাগে রোগী ফেলে রাখা নিয়মে পরিণত হয়েছে। জরুরি বিভাগের প্রথম কাজই হলো রোগীর জীবন বাঁচানো। তারপর রসিদ বা টাকা-পয়সার প্রসঙ্গ আসতে পারে।

এরপর এ ঘটনায় ধারণকৃত এটিএন নিউজের ভিডিও ফুটেজটি আদালতে প্রদর্শন করা হয়। এটা দেখার পর আদালত ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসককে বলেন, ভিডিও ফুটেজের সাথে আপনার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন কি সামঞ্জস্যপূর্ণ? জবাবে চিকিৎসক বলেন, ডান পাখনার নিচে একই জায়গায় একাধিক কোপ পড়েছে। শরীরে বড় আঘাত একটিই পেয়েছি। এ সময় আদালতে উপস্থিত আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক সাবেক আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু বলেন, এক জায়গায় একাধিক কোপ পড়তে পারে না। ভিডিও ফুটেজ সে সাক্ষ্য দেয় না। এরপর আদালত বলেন, ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, ভিকটিম কখনই এক জায়গায় স্থির ছিল না।  বেশির ভাগ সময়ই সে দৌড়াচ্ছিল।

আদালত চিকিৎসকের কাছে জানতে চান, কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছেন? জবাবে চিকিৎসক না বলেন। তিনি বলেন, আমি পৌনে ২টায় লাশ পরীক্ষা করেছি। শরীরে আঘাতের চিহ্ন যা পেয়েছি তাই লিখেছি। আদালত বলেন, আপনি কি কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন? জবাবে চিকিৎসক বলেন,  না। এ পর্যায়ে আদালত বলেন, ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ভিকটিমের বাম পাশে চাপাতি দিয়ে কোপ দেয়া হচ্ছে। এটা তো আপনার প্রতিবেদনে নেই। আদালত বলেন, ভিডিও ফুটেজের সাথে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তখন চিকিৎসক বলেন, শরীরে যা দেখেছি তাই লিখেছি। এ সময় আদালত আরো বলেন, সে মারা গেছে। তাই মামলাটি বিচারের জন্য এক কোপ আর দশ কোপ বড় বিষয় নয়। প্রশ্ন হচ্ছে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের ভূমিকা যথাযথ ছিল কি না?

এ পর্যায়ে আদালত সুরতহাল প্রস্তুতকারী পুলিশকে উদ্দেশ করে বলেন, চার্জশিট দিতে দেরি করছেন কেন? জবাবে বলা হয়, মামলাটি তদন্তের জন্য ডিবিতে ন্যস্ত করা হয়েছে। এ সময় আদালত এ মামলায় কতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তা জানতে চান। জবাবে পুলিশ সদস্য বলেন, সাতজনকে আটক করা হয়েছে বলে শুনেছি। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি তো জানি ৯ জন। এ পর্যায়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, মামলাটি মুলতবি থাকুক। পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল করতে দেরি হলে আদালত হস্তক্ষেপ করতে পারবে।

No comments

Powered by Blogger.