রাজনীতিবিদ খান এ সবুর by এস এইচ খান আসাদ

খান এ সবুর ১৯১১ সালে বাগেরহাট জেলার ফকিরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষাজীবনের সূচনা হয় মাদরাসায়।
পরে প্রাইমারি শিক্ষা শেষ করে ১৯২৮ সালে খুলনা জিলা স্কুল থেকে গণিত ও ইংরেজিসহ চারটি বিষয়ে লেটার নিয়ে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাস করেন। ভর্তি হন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে আইএসসি ও বিএ পাস করে ভর্তি হন লর্ড রিপন ল কলেজে। আইন পড়া শেষ না করেই জড়িয়ে পড়েন মুসলিম লীগের রাজনীতিতে। তীè মেধা, দূরদর্শিতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় যুবক বয়সেই জনপ্রিয় নেতা হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৩৮ সালে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে খান-এ-সবুর সর্বপ্রথম খুলনায় স্বাধিকার আন্দোলনে মুসলমানদের মিছিলে নেতৃত্ব দেন। তিন দিন পর মিউনিসিপ্যাল পার্কে খুলনাঞ্চলের মুসলমানদের সর্বপ্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। পৃথক রাষ্ট্রের জন্য যে খুলনার মানুষের খুন ঝরেছে, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট সেখানে উড়েছিল ভারতের পতাকা। তখন জমিদার শৈলেন ঘোষ, জমিদার মহেন্দ্র ঘোষসহ হিন্দু নেতাদের দাপটে খুলনা অঞ্চলে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। খান-এ-সবুরের নামে হুলিয়া জারি করেন খুলনার ডিএম শ্রী বসাক। হুলিয়া মাথায় নিয়ে মা সবুরুন্নেসার কাছে কলকাতা যাওয়ার আগ মুহূর্তে তিনি বললেন, ‘যদি খুলনাকে (খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট) পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে পারি, তবেই তোমার কোলে ফিরব’। কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে রাজনৈতিক সংগ্রামের পাশাপাশি বাউন্ডারি কমিশনে আপিল করে ভারত থেকে খুলনাকে ফিরিয়ে আনেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট তৎকালীন পাকিস্তানের সমগ্র অঞ্চলে স্বাধীনতা দিবস পালন হলেও খুলনায় পালিত হয় ২৩, ২৪ ও ২৫ আগস্ট। তখন খান-এ-সবুর বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী ষড়যন্ত্রে ১৪ আগস্ট খুলনা যে হিন্দুস্তানে ছিল, তা হয়তো আগামী দিনে মানুষের মনে থাকবে না। আমাদের এ স্বাধীনতা পাওয়ার পেছনে রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস যা আপনাদের জন্য রেখে যাচ্ছি।’ খুলনা স্বাধীন হওয়ার আগে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অনেক মুসলমান শহীদ হলেও পাকিস্তান আমলে খুলনায় খান-এ-সবুরের কঠোর নেতৃত্বের কারণে কোথাও কোনো সঙ্ঘাত হয়নি। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তিনি বিপুল অবদান রাখেন। ১৯৬২ সালে এমএনএ হয়ে তদানীন্তন পার্লামেন্টে সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হন (লিডার অব দি হাউজ) যা ছিল প্রধানমন্ত্রীর পদের সমতুল্য। একই সাথে যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব, বিপুল মংলা বন্দর প্রকল্প, খালিশপুরের শিল্পাঞ্চল, দেশের একমাত্র জাহাজ নির্মাণ শিপইয়ার্ডসহ সমগ্র প্রদেশে বিপুল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিশ্চিত করেন।

বিস্ময়কর হলেও সত্য, লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম, সিএসপি অফিসার খান শামসুর রহমান, আহমদ ফজলুর রহমান প্রমুখ ষাটের দশকে স্বৈরশাসককে উৎখাত করে বাংলদেশকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা করলে সবুর তাদের উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন, তারা শুধু বাংলাদেশকে শোষণ করছে না, বরং তারা বাঙালিদের ঘৃণাও করে। তাদের আচার-আচরণ অসহনীয়। তাদের কাছ থেকে আমরা সর্বক্ষণ আলাদা হওয়ার স্বপ্ন দেখে আসছি। গণতন্ত্র অব্যাহত থাকলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারতাম। তোমরা সুন্দর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছ, আমি তোমাদের সাফল্য কামনা করি।”

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করে খান এ সবুর ব্যক্তিগতভাবে তাকে সমর্থন প্রদান করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি গ্রেফতার হলে বঙ্গবন্ধুই তার ‘সবুর ভাই’র মুক্তির ব্যবস্থা করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি মুসলিম লীগকে পুনর্গঠন করেন। ১৯৭৯ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তার দূরদর্শিতা ভোলার কথা নয়। ১৯৭৯ সালে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে তিনি খুলনায় একাই তিনটি আসনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এ নির্বাচনে মুসলিম লীগ ১৮টি আসনে বিজয়ী হয়। জনপ্রিয় জননেতা খান-এ-সবুর মৃত্যুর আগে তার সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করে যান। খুলনা জেলা প্রশাসককে চেয়ারম্যান করে জনহিতকর কাজের জন্য ‘খান-সবুর ট্রাস্ট’ গঠন করে গেছেন। ১৯৮২ সালের ২৫ জানুয়ারি মৃত্যুর পর তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জাতীয় সংসদ চত্বরের জাতীয় গোরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। নতুন প্রজন্মের পক্ষ থেকে ৩০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

No comments

Powered by Blogger.