প্রফেসর অ্যানেমারি শিমেল by মীযানুল করীম

আগামীকাল শনিবার প্রফেসর অ্যানেমারি শিমেলের দশম মৃত্যুবার্ষিকী। জার্মানির এই মহিলা মনীষী ইসলামের ওপর গবেষক এবং ইসলামি কবিতার অনুবাদক হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে বহুল পরিচিত ছিলেন।
ড. শিমেল (১৯২২-২০০৩) ছিলেন অসাধারণ শিক্ষক ও বহু ভাষাবিদ। তিনি কথিত ওরিয়েন্টালিস্ট, বা ‘প্রাচ্যবিদ’দের মতো খৃষ্টবাদ ও ইহুদিবাদ প্রভুবিত ছিলেন না কিংবা বিভ্রান্তিপূর্ণ দৃষ্টিতে ও বৈরী উদ্দেশ্যে ইসলামকে কিংবা মুসলমানদেরকে দেখেননি। অ্যানেমারি শিমেল এ ধরনের বিভিন্ন ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যে অনন্য।

কুখ্যাত লেখক সালমান রুশদি স্যাটানিক ভার্সেস (শয়তানিপূর্ণ কবিতা) নামের বই লেখার পর তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল মুসলিম বিশ্বে। কারণ এই লেখায় ইসলামের চরম অবমাননা ঘটেছিল। কিন্তু গণতন্ত্র ও উদারতার প্রবক্তা, পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবী সমাজ ও মিডিয়া মুসলমানদের এই স্বাভাবিক ক্ষোভকেও সহ্য করতে পারেনি। তখন বিশ্ব মুসলিমের অনুভূতির প্রতি অ্যানেমারি শিমেল শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন এই ন্যায়সঙ্গত ক্ষোভকে সমর্থনের মাধ্যমে।

অসাধারণ মেধাবী ছাত্রী হিসেবে শিমেল মাত্র ১৭ বছর বয়সেই স্কুল-কলেজ ডিঙ্গিয়ে বার্লিন ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছিলেন। সেখানে তিনি মওলানা জালালুদ্দীন রুমির ‘দিওয়ান’ অধ্যয়ন করে ইসলামি সাহিত্য, দর্শন ও কৃষ্টির প্রতি আকৃষ্ট হন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে প্রথম ডক্টরেট অর্জন করেন মধ্যযুগের মিসর সম্পর্কে গবেষণা করে। কিন্তু হিটলারের নাৎসি সরকার তাকে বাধ্য করে সম্পূর্ণ ভিন্ন পেশায় চাকরি করতে। বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে তিনি ও সহকর্মীরা মার্কিন বাহিনীর হাতে বন্দী হন এবং তাদের অন্তরীণ করে রাখা হয়েছিল। সে অবস্থায়ই শিমেল বন্দিশিবিরে একটি ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ চালু করেন। সেখানে তার প্রথম লেকচার ছিল ইসলামের ওপর। সে সময়েই সুফিদের ওপর গবেষণা করে দ্বিতীয়বার ডক্টরেট অর্জন করেন। তুর্কি ভাষায় এতটাই পারদর্শী ছিলেন যে, তিনি আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মতত্ত্ব অনুষদে বিভাগীয় চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়ে বিস্ময় সৃষ্টি করেন। ১৯৫৪ থেকে ’৫৯ পর্যন্ত তুরস্কে অধ্যাপনাকালেই শিমেল মহাকবি আল্লামা ইকবালের দর্শন ও সাহিত্যকর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ইকবাল সম্পর্কে অধ্যয়ন ও লেখালেখি ছাড়াও তিনি এই কবির ‘জাবিদনামা’ শীর্ষক আধ্যাত্মিক কাব্য অনুবাদ করেছিলেন।

বিশ্ববিখ্যাত ইসলাম গবেষক, আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের উপর্যুপরি অনুরোধে শিমেল এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন ১৯৬৭ সালে। তিনি সেখানে পড়াতেন ভারতীয় মুসলিম সংস্কৃতি বিষয়ে। মাত্র তিন বছরেই প্রফেসরের পদে উন্নীত হন বিশ্বের অন্যতম সেরা এই উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। শিক্ষক হিসেবে তিনি আদর্শস্থানীয় ছিলেন দায়িত্ববোধ, সময়ানুবর্তিতা, নিয়ম-নিষ্ঠা, প্রভৃতি কারণে। শিক্ষার্থীদের প্রিয় এই ব্যক্তিত্বের গভীর জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য তো ছিলই। একনাগাড়ে দীর্ঘ ২৫ বছর অধ্যাপনা করার পর ১৯৯২ সালে তিনি অবসর নিয়ে জার্মানির বন নগরীতে বাস করতে থাকেন। বার্ধক্য তার ভাষণ ও লেখালেখির গতি কমাতে পারেনি। তখন তিনি বন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনারারি প্রফেসর।

অ্যানেমারি শিমেল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় জগতের ভাষার ওপর কেমন দখল রাখতেন, তা বোঝা যায় তার এই বক্তব্যে, ‘নোট বা শিট না দেখেই জার্মান, ইংরেজি বা তুর্কি ভাষায় লেকচার দিতে পারি। আর নোটজাতীয় কিছু হাতে রেখে আমি লেকচার দিতে সক্ষম ফরাসি, আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষায়।’ শিমেল এমনকি পাকিস্তানের সিন্ধি ভাষাতেও দক্ষ ছিলেন। আরবি, উর্দু, ফারসি, তুর্কি ও সিন্ধি ভাষার বেশ কিছু ইসলামি কবিতা সরাসরি অনুবাদ করেছেন জার্মান ও ইংরেজিতে।

প্রফেসর শিমেলের বহু বই রয়েছে ইসলামি সাহিত্য-সংস্কৃতি, ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা বিষয়ে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো Muhammad is his Messenger, Islam An Introduction, Mystical Dimensions of Islam,  প্রভৃতি।

তিনি নানাভাবে সম্মানিত হয়েছেন দেশে বিদেশে। বহুবার পেয়েছেন অনারারি ডক্টরেট। অর্জন করেছেন অনেক পদক ও পুরস্কার। ১৯৯৫ সালে জার্মানির সম্মানজনক ‘শান্তি পুরস্কার’ অর্জন তার উজ্জ্বল কর্মময় জীবনের চূড়ান্ত স্বীকৃতিরূপে গণ্য। প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সমঝোতার ক্ষেত্রে অবদানের জন্য তাকে এই পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তখন স্বয়ং জার্মানির প্রেসিডেন্ট তার প্রশংসাবাণী পাঠ করেছিলেন। ১৯৫৮ সালে শিমেল পাকিস্তান সফর করেন। উর্দু ভাষা ও ইকবালের বিষয়ে তার অবদানের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ পাকিস্তান সরকার তাকে ভূষিত করেছে হিলাল-ই-ইমতিয়াজ (গৌরবের নতুন চাঁদ) খেতাবে।
       

No comments

Powered by Blogger.