মুক্তিযুদ্ধের ছিন্ন দলিলপত্র ৪০- একাত্তরের শান্তি কমিটির নরহত্যার পেছনে ছিল জামায়াত by মুনতাসীর মামুন

 ১৯৭১ সালে শান্তি কমিটি বাংলাদেশ হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী থেকে সারাদেশে কম অশান্তির সৃষ্টি করেনি। হানাদারদের মতো তারাও ঘরবাড়ি পুড়িয়েছে, খুন-জখম-লুট-ধর্ষণ করেছে।
শান্তি বাহিনীর উদ্যোক্তা ছিল তৎকালীন ডান ও চরম ডানপন্থী দলগুলো, যার নেতৃত্বে ছিল জামায়াতে ইসলাম। বাংলাদেশে সব খুন-খারাবি, নষ্ট রাজনীতির উৎস খুঁজলে দেখা যাবে তার পিছে আছে জামায়াতে ইসলাম। টিক্কা খান প্রথম গণহত্যা চালিয়ে শ্বাস ফেলতে না ফেলতেই পাকিসত্মান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রধান নুরম্নল আমীনের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি দল ৪ এপ্রিল দেখা করে টিক্কার সঙ্গে। দলে ছিলেন গোলাম আযম, 'মৌলভী' ফরিদ আহমদ, 'মওলানা' নুরম্নজ্জামান প্রমুখ। তারা "অবিলম্বে সমগ্র প্রদেশে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সামরিক আইন প্রশাসনকে সম্পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস এবং জনগণের মন থেকে ভিত্তিহনী ভয় দূর করার উদ্দেশ্যে ঢাকায় নাগরিক কমিটির গঠনের প্রসত্মাব দেয়।" (পূর্বদেশ)
টিক্কা খান সঙ্গে সঙ্গে দালালদের এই প্রসত্মাব গ্রহণ করেন। ৯ এপ্রিল ১৪০ সদস্যবিশিষ্ট ঢাকা নাগরিক শানত্মি কমিটি গঠিত হয়। নেতৃত্ব নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে বনাবনি না হওয়ায় ফরিদ আহমদ 'পূর্ব পাকিসত্মান শানত্মি ও কল্যাণ কাউন্সিল' গঠন করেন তার অনুসারীদের দিয়ে। এটি মূল শানত্মি কমিটির মতো সারাদেশে বিসত্মৃত ছিল না। কিন্তু কাজ একই ছিল।
গোলাম আযমদের নেতৃত্বে ১৩ এপ্রিল ঢাকায় শানত্মি কমিটি প্রথম সমাবেশ করে। সমাবেশ থেকে আজিমপুর, শানত্মিনগর প্রভৃতি স্থানে কিছু বাড়িঘর পোড়ায় ও কযেকজনকে হত্যা করে রাসত্মার পাশে লাশ ফেলে রাখে।
১৪ এপ্রিল নাগরিক শানত্মি কমিটির বৈঠকে কমিটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পূর্ব পাকিসত্মান কেন্দ্রীয় শানত্মি কমিটি। মুসলিম লীগের খাজা খয়ের উদ্দিন হন এর আহ্বায়ক। মগবাজারের ৫ এলিফ্যান্ট লেন হয় কেন্দ্রীয় অফিস।
শানত্মি কমিটি অতপর সারাদেশে থানা পর্যায় পর্যনত্ম কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয়। সারা বাংলাদেশে হানাদার বাহিনীর দখলকৃত প্রশাসনের সাহায্যে কমিটি গড়ে ওঠে। কমিটির সিদ্ধানত্ম গ্রহণ ও কার্যকরি করার জন্য ২১ সদস্যের একটি কার্যকরী কমিটি গঠন করা হয়। বিভিন্ন ডানপন্থী দলের ছিলেন কার্যকরী কমিটির সদস্য। তাঁরা ছিলেন, খাজা খয়েরদ্দিন, আহ্বায়ক, একিউএম শফিকুল ইসলাম, গোলাম আযম, মাহমুদ আলী, আবদুল জব্বার খদ্দর, মওলানা সিদ্দিক আহমদ, আবুল কাশেম, ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া), মওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ মাসুম, আবদুল মতিন, ব্যারিস্টার আখতার উদ্দিন, অধ্যাপক গোলাম সরওয়ার, এএসএম সোলায়মান, পীর মোহসেন উদ্দীন (দুদু মিয়া), এ কে রফিকুল হোসেন, নুরম্নল আমিন, আতাউল হক খান, তোহকিন হাবিব, মেজর আফসারম্নদ্দীন, দেওয়ান ওয়ারেসাত আলী ও হাকিম ইরতিগায়ুর রহমান আখুন দাদা।
২১ জুন ওয়ার্কিং কমিটির তরফ থেকে শাখা কমিটিগুলোর কাছে একটি নির্দেশ পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সংগ্রহে এই দলিলটি আছে। দলিলটির প্রতিচিত্র তাদের ১০০টি আলোকচিত্র সংগ্রহে আছে। তবে ক্যাপশনে যে লেখা আছে '২১ জুন ১৯৭১ কেন্দ্রীয় শানত্মি কমিটি গঠনের দলিল' তা ভুল। নির্দেশটি ইংরেজীতে। এখানে সংৰেপে তার বাংলা অনুবাদ প্রদান করছি।
ওপরে 'ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের' নাম ছাপা হয়েছে_ প্রথম নামটি গোলাম আযমের। তারপর আছে মাহমুদ আলী, আবদুল জব্বার খদ্দর, 'মওলানা' সিদ্দিক, আবুল কাশেম, ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া), 'মওলানা সৈয়দ মহম্মদ মাসুম এবং অন্যান্য। তারিখ ২১.৬. ৭১। পাঠানো হয়েছে সমসত্ম আহ্বায়ক/সম্পাদক, জেলা ও মহকুমা শানত্মি কমিটির উদ্দেশে চিঠি।
মহোদয়,
নিম্নলিখিত বিষয়গুলির প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং দ্রম্নত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।
ক. জেলা. শহর এবং মহকুমা শানত্মি কমিটির সমসত্ম কার্যাবলীর বর্ণনা ও কমিটির সদস্যদের নামের তালিকার তিন কপি কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে পাঠাতে হবে, যা জানানোর জন্য এবং স্বীকৃতির জন্য সেনা কর্তৃপৰকে পাঠানো হবে। এই অফিসে জেলা কমিটির নামে একটি নথি খোলা হবে এবং প্রতিদিন স্থানীয় পত্রিকায় এ সম্পর্কিত রিপোর্ট সেখানে নথিবদ্ধ হবে।
খ. কেন্দ্রীয় কমিটি যেভাবে গঠিত হয়েছে তা অনুসারে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের লোকদের নিয়ে কমিটি গঠন করতে হবে।
গ. কমিটির নীতি বাসত্মবায়নে সাধারণ কমিটির সদস্যদের নিয়ে একটি কার্যকরী কমিটি গঠন করতে হবে।
ঘ. এ প্রক্রিয়ায় যে সব মহকুমা ও থানা কমিটি গঠিত হয়নি সেগুলোকে এ পদ্ধতি অনুসরণ করে কমিটি গঠন করতে হবে। ইউনিয়নের ব্যাপারেও তা প্রযোজ্য। কোন পর্যায়ের কমিটিতে যেন ্তুধহঃর-ংঃধঃব ধহফ ধহঃর-ংড়পরধষ বষবসবহঃ্থ অনত্মভর্ুক্ত না হয়। স্থানীয় সিভিল প্রশাসনের কোন কর্মচারী যদি অনত্মভর্ুক্তকরণের জন্য চাপ সৃষ্টি করে তবে সামরিক কর্তৃপৰকে জানাতে হবে।
ঙ. সামরিক কর্তৃপৰ থেকে স্থানীয় সামরিক কর্তৃপৰকে দেশপ্রেমীদের থেকে রাজাকার ও গ্রামরৰী নিযুক্ত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাদের রাইফেল ও প্রয়োজনীয় প্রশিৰণ দেয়া হবে। স্থানীয় শানত্মি কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী যেন প্রশিৰণ ও অস্ত্র সরবরাহ করা হয় তা জানানোর জন্য স্থানীয় সামরিক কর্তৃপৰের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। এ কারণে শানত্মি কমিটির অধীনে একটি প্রতিরৰা উপ-কমিটি গঠন করতে হবে যারা শুধু এ বিষয়টিই দেখবে।
চ. পরিত্যক্ত বাড়ি-ঘর সম্পত্তি সাময়িকভাবে বরাদ্দ দেয়ার জন্য ডিসিদের প্রতি পূর্ব পাকিসত্মান সরকারের চীফ সেক্রেটারি একটি নির্দেশ পাঠিয়েছেন। এ কমিটিতে স্থানীয় শানত্মি কমিটির প্রতিনিধি থাকবে যার প্রধান হবে সামরিক অফিসার।
এ ছাড়া আরও কয়েকটি নির্দেশ ছিল। যার মধ্যে বলা হয়েছিল সব শানত্মি কমিটির আহ্বায়ক বা সভাপতি পদাধিকার বলে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হবে। ২৫ জুলাই, ১৯৭১ সালে কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সভা আহ্বান করা হয়েছিল।
কেন্দ্রীয় শানত্মি কমিটির এই চিঠিটিতে স্বাৰর করেছিলেন খাজা খয়েরউদ্দিন।
সংগ্রহ : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

No comments

Powered by Blogger.