চরাচর-ময়নামতীর পাহাড়ে by আনন্দ কুমার ভৌমিক

লালমাই-ময়নামতী পাহাড়ের বয়স প্রায় সাড়ে তিন কোটি বছর। খুব সম্ভব লাল মাটিতে গঠিত বলে এই পাহাড়শ্রেণীর নাম লালমাই। তবে দশম শতাব্দীর চন্দ্রবংশের চতুর্থ নৃপতি শ্রীচন্দ্রের তাম্রশাসনে এই পাহাড়ের নাম লালিম্ব বলা হয়েছে। কালক্রমে তা লালমাই নাম ধারণ করে।
ময়নামতী নামকরণের পেছনে উল্লেখযোগ্য কোনো ধারণা পাওয়া না গেলেও নাথ সাহিত্যের গোপীচন্দ্রের মাতা ময়নামতীর নাম স্মরণ করিয়ে দেয়। সব পাহাড়জুড়েই রয়েছে প্রাচীন কীর্তি। ১৮৭৫ সালে ময়নামতী পাহাড়ের মধ্য দিয়ে রাস্তা তৈরির সময় ইটনির্মিত একটি ছোট বৌদ্ধ বিহারের সন্ধান মেলে। সেটি প্রাচীন কীর্তির প্রথম সন্ধান।
তারপর প্রায় ৬৭ বছর গেছে নীরবতায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রহ্মদেশের রণাঙ্গনের জন্য ময়নামতী পাহাড়ে ব্রিটিশ সেনানিবাস তৈরি করা হয়েছিল। তখন কুমিল্লা বিমানবন্দর ও যুদ্ধের কাজের জন্য রাস্তা, বাড়িঘর তৈরি করতে জরুরিভাবে অনেক ইটের প্রয়োজন হয়। ঠিকাদাররা খবর পেল, লালমাই-ময়নামতী পাহাড়ে ইট রয়েছে। সব পাহাড়ি এলাকার যত কীর্তি ছিল, তারা সেগুলো থেকে ইট নিয়ে যায়। সেই ইটের সংখ্যা কত ছিল তা আজও কারো পক্ষে বলা সম্ভব হয়নি। ইটের সঙ্গে তারা আরো পেয়েছিল অসংখ্য প্রাচীন মুদ্রা, পাথর ও ব্রোঞ্জের মূর্তি, সিল, পোড়ামাটির চিত্রফলক, শিলালিপি, নকশা করা ইট ইত্যাদি প্রত্নসম্পদ। বিষয়টি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের দৃষ্টিতে আসে। তবে এর মধ্যে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। বেপরোয়াভাবে ইট খোলার কারণে কোনো কোনোটি সংরক্ষণ করেও লাভ হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ২০টিরও বেশি স্থান সংরক্ষণ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ময়নামতীর প্রাসাদ, আনন্দ বিহার, শালবন বিহার, ভোজ বিহার, রূপবান কন্যার বিহার, চণ্ডীমুড়া, চারপত্র মুড়া, বৈরাগী মুড়া, কোটিলা মুড়া, বলাগাজী মুড়া, বড় ইটাখোলা মুড়া, কোটবাড়ী মুড়া, পাক্কা মুড়া ইত্যাদি। এসব মুড়া বা টিলায় রয়েছে প্রাচীন স্থাপনা। শালবন বিহার একটি বিরাট কীর্তি, যা মূলত বৌদ্ধ বিহার। এতে ১১৫টি কক্ষ রয়েছে। লোকমুখে শোনা যায়, লালমাই-ময়নামতী পাহাড়ে ৯৯ জন রাজা রাজত্ব করে গেছেন। তাঁদের রাজত্বের ধ্বংসাবশেষ এই পাহাড়েই রয়েছে। তবে প্রত্নতত্ত্ব প্রমাণ থেকে কমপক্ষে আটটি রাজবংশের ৩০ জনের রাজত্বের অস্তিত্ব মেলে। ১৯৫৫-৫৬ সালে শালবন বিহার খননকালে প্রস্তর যুগের অস্ত্র পাওয়া যায়। প্রাপ্ত অস্ত্রগুলো যে এখানকার মানুষের, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। তা ছাড়া ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীর সুসভ্য বৌদ্ধ ভিক্ষুরা যে এসব অস্ত্র তৈরি ও ব্যবহার করতেন, তা কল্পনা করাই যায় না। এগুলো তাঁরাও সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেছিলেন। প্রাপ্ত মুদ্রাগুলোর মধ্যে ১৮টি স্বর্ণমুদ্রা, ৩৫০টির বেশি রৌপ্য ও তাম্রমুদ্রা রয়েছে। মুদ্রার পিঠে বিভিন্ন রাজার মূর্তি, ধর্মীয় মূর্তি, ষাঁড়, ত্রিরত্ন প্রভৃতি প্রতিকৃতি রয়েছে। রয়েছে বিভিন্ন শব্দ লেখা, যেমন- শ্রী, সুধন্য, পট্টিকেরা, ললিতাকর ধর্মবিজয়, আরিক্রিয়, হরিকেল ইত্যাদি। রূপবান কন্যার মুড়ায় একটি শিলালিপির ভগ্নাংশ পাওয়া যায়। পাওয়া যায় অসংখ্য নিবেদন স্তূপ। মাটির তৈরি এসব স্তূপের ভেতর ছিল বৌদ্ধধর্মীয় মন্ত্রযুক্ত সিল। ব্রোঞ্জের স্মারকাধার, ব্রোঞ্জের স্তূপ-প্রতিকৃতি ও ১৫০টির বেশি ব্রোঞ্জের মূর্তি পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে বুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব ও অন্য বৌদ্ধ দেব-দেবীর ছোট মূর্তির দেখা মেলে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ৩৬টি অতি মূল্যবান ব্রোঞ্জের মূর্তি হারিয়ে যায়। আবিষ্কৃত অতি মূল্যবান এই প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের এক গৌরবময় যুগের সন্ধান দিচ্ছে, যা মানবসভ্যতার এক বিস্ময়কর অগ্রগতির অধ্যায়।
আনন্দ কুমার ভৌমিক

No comments

Powered by Blogger.