জামায়াতের সাবেক নেতা আবুল কালাম আযাদের মৃত্যুদণ্ড- ইতিহাসের দায় মেটাল বাংলাদেশ by কুন্তল রায় ও মোছাব্বের হোসেন

ইতিহাসের সন্তান বাংলাদেশ আরেকটি ইতিহাসের জন্ম দিল। যুদ্ধজেতা জাতি স্বাধীনতার ৪২ বছর পর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের এক মাহেন্দ্রক্ষণ দেখল গতকাল সোমবার।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সদস্য (রুকন) আবুল কালাম আযাদকে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো। মানবতার ইতিহাসের এক রুদ্ধ দুয়ার খুলল এই ঐতিহাসিক রায়ে। ইতিহাসের দায়ও মেটাল বাংলাদেশ।
২১ জানুয়ারি, ২০১৩; সোমবার সকাল ১০টা ৪৪ মিনিট। দুই পক্ষের আইনজীবী, বিশিষ্টজন ও গণমাধ্যমের কর্মীতে ঠাসা আদালতকক্ষ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে আসন নেন বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারক মো. শাহিনুর ইসলাম। আসামি আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার পলাতক। তাঁর অনুপস্থিতিতে ১০টা ৪৭ মিনিটে রায় ঘোষণা শুরু হয়। ১১টা ৫০ মিনেটে শেষ হয় রায় পড়া।
রায়ে আবুল কালাম আযাদকে একই সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার জন্য দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এই দণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এটিই দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রথম রায়। একই সঙ্গে বাংলাদেশের বিচারিক ইতিহাসে এই প্রথম কাউকে একাত্তরের গণহত্যার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হলো।
ট্রাইব্যুনালের আইন অনুসারে, রায় ঘোষণার দিন থেকে ৩০ দিনের মধ্যে এর বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে। তবে পলাতক আবুল কালাম আযাদকে এই সুযোগ নিতে হলে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, আত্মসমর্পণ করে আপিলের সুযোগ নিলেও তা করতে হবে আজ (গতকাল) থেকে ৩০ দিনের মধ্যে। এর পরে আর আপিলের সুযোগ থাকবে না।
ফরিদপুর অঞ্চলে ‘বাচ্চু রাজাকার’ নামে পরিচিত আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে দেওয়া এই রায়ে মুক্তিযুদ্ধকালে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকাও উল্লেখ করা হয়েছে। রায়ে বলা হয়, সংগঠন হিসেবে জামায়াত মুক্তিযুদ্ধকালে প্যারা-মিলিশিয়া বা সহযোগী বাহিনী গঠন করে পাকিস্তান রক্ষার নামে নিরস্ত্র বাঙালি বেসামরিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছিল।
আইনজীবী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীসহ কমপক্ষে ৩০০ মানুষে পরিপূর্ণ এজলাসে সকাল ১০টা ৪৭ মিনিটে পিনপতন নীরবতার মধ্যে ২৪ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্ত রায় পড়া শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। তিনি বলেন, ‘আজ (গতকাল) রায়ের দিন। ট্রাইব্যুনাল-২-এর এজলাসে স্থানসংকুলান হবে না বলে ট্রাইব্যুনাল-১-এর এজলাসে রায় ঘোষণা করা হচ্ছে। রায়ের একটি করে সত্যায়িত অনুলিপি পাবেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি ও বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল। আসামি পলাতক থাকায় আইন অনুযায়ী আসামিপক্ষকে সত্যায়িত অনুলিপি দেওয়া হবে না।’
বিচারপতি আরও বলেন, ‘পূর্ণাঙ্গ রায় ১১২ পৃষ্ঠার, এতে ৩৩৪টি অনুচ্ছেদ আছে। এই মামলার কার্যক্রম যখন শুরু হয়, তখন এই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর, তিনি এখন ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান। এই রায়ের পেছনে তাঁরও শ্রম-ঘাম আছে।’
ট্রাইব্যুনাল বলেন, বাংলাদেশের বিচারিক ইতিহাস ও ট্রাইব্যুনাল-২-এর জন্য এ এক ঐতিহাসিক দিন, যেদিন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা প্রভৃতি আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার করে প্রথম রায় দেওয়া হচ্ছে। নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের ফসল এই বাংলাদেশ। ওই নয় মাসে এ দেশে ভয়াবহ ও লোমহর্ষক অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছেন, প্রায় চার লাখ নারী ধর্ষণ-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং এক কোটিরও বেশি মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এই অপরাধ সংঘটনকারীদের বিচার হয়নি, যা এই জাতি ও এ দেশের রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বে এক গভীর ক্ষত রেখে গেছে।
রায়ে ট্রাইব্যুনাল আবুল কালাম আযাদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, এই ট্রাইব্যুনালের বিচারিক পরিধি, মামলার ইতিহাস, সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধান, সাক্ষ্য গ্রহণ, অভিযোগ প্রমাণে রাষ্ট্রপক্ষের দায় এবং কয়েকটি বিষয়ে আইনি ব্যাখ্যা দেন। এরপর আযাদের বিরুদ্ধে গঠিত আটটি অভিযোগ আলাদা করে মীমাংসা করেন।
গণহত্যায় দায় প্রমাণিত: আযাদের বিরুদ্ধে গঠিত আটটি অভিযোগের মধ্যে সপ্তমটি ছিল গণহত্যার। এ অভিযোগ সম্পর্কে প্রথমে ও বিস্তৃতভাবে রায় দেন ট্রাইব্যুনাল। অভিযোগ ছিল, একাত্তরের ১৭ মে রাজাকার বাহিনীর সদস্য ও স্থানীয় আলবদর বাহিনীর নেতা আযাদ ৩০-৩৫ জন সশস্ত্র রাজাকারকে সঙ্গে নিয়ে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার হাসামদিয়া গ্রামের হিন্দুপাড়ায় হামলা চালান। হিন্দু জনগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিক ধ্বংসের উদ্দেশ্যে তাঁরা বাড়িঘর লুট ও অগ্নিসংযোগ করেন, নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শরৎচন্দ্র পোদ্দার, সুরেশ পোদ্দার, শ্যামাপদ পোদ্দার, যতীন্দ্র মোহন সাহা, নীল রতন সমাদ্দার, সুবল কয়াল ও মল্লিক চক্রবর্তীকে হত্যা করেন। হরিপদ সাহা ও প্রবীর কুমার সাহা ওরফে পুইট্যাকে হত্যা করা হয় ময়েনদিয়া বাজারের নদীর ঘাটে নিয়ে।
রায়ে বলা হয়, প্রাপ্ত সাক্ষ্যে হিন্দু জনবসতি লক্ষ্য করে চালানো ওই লোমহর্ষক ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনা প্রমাণিত হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের ১৯তম সাক্ষী (সত্য রঞ্জন সাহা) ওই ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী। তাঁর বাবা ওই ঘটনায় নিহত হন। সাক্ষ্যে উঠে এসেছে, কীভাবে আসামি তাঁর সহযোগীদের নিয়ে সরাসরি ধ্বংসাত্মক অপরাধে অংশ নিয়েছিলেন। ১৬তম (আবদুল মান্নান), ১৭তম (সুশীল কুমার) ও ২০তম সাক্ষীর (অসিত বরণ সাহা) সাক্ষ্যের মধ্য দিয়েও রাষ্ট্রপক্ষ এই অভিযোগে আসামির শাস্তি পাওয়ার যথার্থতা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে।
রায়ে আরও বলা হয়, বৃহৎ পরিসরে ওই হত্যাকাণ্ড ও বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ হিন্দু জনবসতিকে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করে। হত্যা, ধ্বংস, লুণ্ঠন, মানসিক আঘাত—সব ধরনের অপরাধ মিলিয়ে একটি অভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়, হামলাকারীরা ‘হিন্দু জনগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে’ আংশিকভাবে ধ্বংসের জন্য ওই হামলা চালায়। গণহত্যার উদ্দেশ্যে ওই হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়, যা গণহত্যার সমান অপরাধ।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর ৩(২)(সি) ধারায় গণহত্যা বা জেনোসাইডের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা, শারীরিক বা মানসিকভাবে আঘাত দেওয়া, জীবনযাপন পদ্ধতি বিনষ্ট করে তাদের আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসের চেষ্টা, বংশবিস্তার রোধ করে গোষ্ঠীকে ধ্বংস করার চেষ্টা এবং এক গোষ্ঠীর শিশুদের আরেক গোষ্ঠীতে রূপান্তরের চেষ্টা গণহত্যা বা জেনোসাইড হিসেবে গণ্য হবে।
মানবতাবিরোধী অপরাধ: আযাদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ ছিল, মুক্তিযুদ্ধকালে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে আযাদ ও তাঁর সহযোগীরা ফরিদপুর শহরের খাবাসপুরে হবি মাতব্বরের দোকানের কাছ থেকে রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে ধরে নির্যাতন করে ফরিদপুর সার্কিট হাউসে নিয়ে যান। সেখানে পাকিস্তানি মেজর আকরাম কোরাইশি ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের সঙ্গে আলোচনার পর রণজিৎকে অন্য একটি বাড়িতে আটকে রেখে নির্যাতন করেন আযাদ। পরে রণজিৎ সেখান থেকে পালিয়ে রক্ষা পান।
রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, পাকিস্তানি সেনাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী আযাদ শুধু রাষ্ট্রপক্ষের পঞ্চম সাক্ষীকে (রণজিৎ নাথ) আটকে রেখে নির্যাতন ও অমানবিক যন্ত্রণাদানে উৎসাহিতই করেননি, বরং নিজেও নির্যাতন করেছেন। কেন রণজিৎ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলেন? এর জবাব মেলে সাক্ষীর বর্ণনায়—ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হলে রণজিৎকে দেখে মুজাহিদ (আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, জামায়াতের বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল ও তৎকালীন ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি) বলেন, ‘সে একজন মুক্তিযোদ্ধা ও হিন্দু।’ এরপর রণজিৎকে আযাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ জন্য রণজিৎকে অপহরণ, আটক রাখা ও নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সরাসরি অংশগ্রহণের দায় আযাদের ওপর পড়ে।
দ্বিতীয় অভিযোগ থেকে খালাস: অভিযোগ ছিল, আযাদ একাত্তরের ২৬ জুলাই বেলা ১১টার দিকে আলফাডাঙ্গা থেকে আবু ইউসুফ পাখিকে ধরে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে নিয়ে আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন করেন। ইউসুফ সেখানে বিভিন্ন ঘরে চার-পাঁচ শ নারী ও পুরুষকে আটকে থাকা অবস্থায় দেখেন। এক মাস ১৩ দিন আটক থাকাকালে আবু ইউসুফ দেখেন, আযাদ ও তাঁর সহযোগীরা কিশোরীদের অপহরণ করে এনে নির্যাতন করছেন।
ট্রাইব্যুনাল এ অভিযোগ থেকে আযাদকে খালাস দেন। রায়ে বিচারপতি বলেন, ঘটনার শিকার ও রাষ্ট্রপক্ষের ১৮তম সাক্ষী আবু ইউসুফের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, আসামি সেনাদের ক্যাম্পে যেতেন এবং অন্য বন্দীদের যখন নির্যাতন করা হতো, তখন সেখানে তিনি উপস্থিত থাকতেন। তবে রাষ্ট্রপক্ষ এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই এই অভিযোগ থেকে আসামিকে খালাস দেওয়া হলো।
তৃতীয় অভিযোগ: একাত্তরের ১৪ মে আযাদ ১০-১২ জন সশস্ত্র রাজাকারসহ বোয়ালমারী থানার কলারন গ্রামের সুধাংশু মোহন রায়কে গুলি করে হত্যা করেন।
ট্রাইব্যুনাল বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষী (নেপাল চন্দ্র পাঠক) ও তৃতীয় সাক্ষীর (মোজাহের সিকদার) সাক্ষ্য পরস্পরকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। এতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়, অপরাধ সংঘটনের সময় আযাদ ১০-১২ জন সঙ্গীসহ সশস্ত্র অবস্থায় ছিলেন। আযাদ পাকিস্তানি সেনা ও তাঁদের সহযোগী রাজনৈতিক দলের (জামায়াত) কাছ থেকে রাইফেল চালনার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। এই দুই সাক্ষীই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।
চতুর্থ অভিযোগ: একাত্তরের ১৬ মে বেলা তিনটার দিকে আযাদ ১০-১২ জন রাজাকার নিয়ে সালথা থানার (সাবেক নগরকান্দা) পুরুরা নমপাড়া গ্রামের মাধব চন্দ্র বিশ্বাসকে গুলি করে হত্যা করেন।
ট্রাইব্যুনাল বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের ষষ্ঠ সাক্ষী (ভক্ত রঞ্জন বিশ্বাস), অষ্টম সাক্ষী (প্রফুল্ল কুমার মণ্ডল) ও দশম সাক্ষী (তুষ্ট কুমার মণ্ডল) ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। মাধবকে হত্যা করা হয় দশম সাক্ষীর বাড়ির পুকুরপাড়ে। এই অভিযোগও প্রমাণিত হওয়ায় আযাদকে দোষী সাব্যস্ত করা হলো।
পঞ্চম অভিযোগ: একাত্তরের ৮ জুন দুপুর ১২টার দিকে আযাদ চার-পাঁচজন সশস্ত্র রাজাকারকে সঙ্গে নিয়ে বোয়ালমারী থানার নতিবদিয়া গ্রামের এক হিন্দু বাড়িতে হামলা চালিয়ে দুই হিন্দু নারীকে গণধর্ষণ করেন।
ট্রাইব্যুনাল বলেন, ওই ঘটনার শিকার বেসামরিক ব্যক্তিদের পক্ষে আসামির নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র হামলাকারীদের প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল না। কারণ ওই সশস্ত্র ব্যক্তিরা পাকিস্তানি সেনা ও পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চান। ঘটনার ধরন ও বিবরণ থেকে জানা যায়, ওই হামলার লক্ষ্য ছিল হিন্দু জনগোষ্ঠী। ওই ঘটনায় আযাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
ষষ্ঠ অভিযোগ: একাত্তরের ৩ জুন আযাদ ও ১০-১২ জন সশস্ত্র রাজাকার সালথা থানার ফুলবাড়িয়া গ্রামে লুটপাটের পর চিত্তরঞ্জন দাসকে বাড়ি থেকে বের করে গুলি করে হত্যা করেন।
রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের দ্বিতীয় (জ্যোৎস্না রানী দাস), চতুর্থ (ধলা মাতব্বর) ও নবম (নগেন চন্দ্র মণ্ডল) সাক্ষীর সাক্ষ্যে এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে ওই নির্দিষ্ট দিনে আযাদের নেতৃত্বে রাজাকাররা ফুলবাড়িয়া গ্রামে হামলা চালায়। ওই হামলার কারণে সাক্ষী জ্যোৎস্নাসহ লুণ্ঠন ও অপরাধের শিকার অনেকে গ্রাম ছেড়ে ভারতে চলে যান। রাজাকার বাহিনীর নেতা হিসেবে আযাদ সরাসরি এই অপরাধ করেছেন। ঘটনাটি ছিল লোমহর্ষক এবং তা মানবতাবাদী আইন ও জেনেভা কনভেনশনেরও লঙ্ঘন।
অষ্টম অভিযোগ: একাত্তরের ১৮ মে সকাল ১০টার দিকে আযাদ সাত-আটজন সশস্ত্র রাজাকারকে সঙ্গে নিয়ে সালথা থানার উজিরপুর বাজারপাড়া গ্রামের গুরুদাসের ১৮ বছর বয়সী মেয়েকে অপহরণ করে খাড়দিয়া গ্রামের চান কাজীর বাড়িতে (আযাদের শ্বশুর) আটকে রেখে নির্যাতন করেন।
রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের একাদশ সাক্ষী (দেব কুমার দাস) ও দ্বাদশ সাক্ষীর (রওশন আলী বিশ্বাস) সাক্ষ্য থেকে এটা প্রমাণিত হয়, আযাদ তাঁর সহযোগীদের নিয়ে নির্যাতিতার বাড়িতে হামলা চালিয়ে জোর করে তুলে নিয়ে যান। এই অপহরণে আযাদ সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। সাত-আট দিন ধরে ওই নারীর ওপর যৌন নির্যাতন চালানোর বিষয়টি দ্বাদশ সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকে (এক নারী) স্পষ্ট হয়েছে। তাই অপহরণ ও নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে আযাদকে দোষী সাব্যস্ত করা হলো।
ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, একাধিক সাক্ষ্য থেকে এটা প্রমাণিত, আযাদ সশস্ত্র অবস্থায় অপরাধ করেছেন। তাঁকে নিছক ‘অনুপস্থিত অভিযুক্ত’ হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। তিনি একজন পলাতক আসামি। বিচারের মুখোমুখি না হওয়া তাঁর শাস্তি পাওয়ার যুক্তিকে সুদৃঢ় করে। তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ নেননি। এতে বোঝা যায় যে তিনি শাস্তি পাওয়ারই যোগ্য।
দোষী সাব্যস্তকরণ ও শাস্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত: সংক্ষিপ্ত রায় অনুসারে, আযাদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযোগ ছাড়া বাকি সাতটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তৃতীয়, চতুর্থ ও ষষ্ঠ অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে হত্যায় অংশ নেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। প্রথম ও অষ্টম অভিযোগে তিনি অপহরণ, আটক রাখা ও নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হন। সপ্তম অভিযোগে গণহত্যা এবং পঞ্চম অভিযোগে ধর্ষণের মতো অপরাধে আযাদকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
শাস্তির বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, গণহত্যা ও হত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ মানবতাবোধের জন্য এক প্রচণ্ড আঘাত। অপরাধের গভীরতা বিবেচনা করে ট্রাইব্যুনাল একমত যে, একমাত্র মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে এই গর্হিত অপরাধের ন্যায়বিচার হবে। তাই তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ ও সপ্তম অভিযোগে তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো। প্রথম, পঞ্চম ও অষ্টম অভিযোগের গুরুত্ব বিবেচনায় আযাদ কারাদণ্ড পাওয়ার যোগ্য।
চূড়ান্ত আদেশে ট্রাইব্যুনাল বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর ২০(২) ধারা অনুসারে, আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু গণহত্যা (অভিযোগ-৭) ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে (অভিযোগ-৩, ৪, ৫) দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেওয়া হলো। মৃত্যুদণ্ড দেওয়ায় বাকি প্রথম, পঞ্চম ও অষ্টম অভিযোগে তাঁকে আলাদা করে কারাদণ্ড দেওয়া হলো না। প্রমাণিত না হওয়ায় দ্বিতীয় অভিযোগ থেকে তাঁকে খালাস দেওয়া হলো।
রায়ের সব শেষে ট্রাইব্যুনাল বলেন, যেহেতু আসামি পলাতক রয়েছেন, তাই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলে বা তিনি আত্মসমর্পণ করলে এই শাস্তি কার্যকর হবে। আসামির বিরুদ্ধে শাস্তির পরোয়ানা জারির আদেশ দিয়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, এই রায়ের একটি অনুলিপি শাস্তির পরোয়ানার সঙ্গে সংযুক্ত করে পুলিশের মহাপরিদর্শকের কাছে পাঠাতে হবে। সেই সঙ্গে রায়ের অনুলিপি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানোর নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
সংক্ষিপ্ত রায় পড়া শেষে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান দুই পক্ষের আইনজীবীসহ উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ জানান। রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা একে অপরকে আনন্দে জড়িয়ে ধরেন। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ টিপুসহ অন্য কৌঁসুলিরা ট্রাইব্যুনালের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
প্রতিক্রিয়া: রায়ের পর সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়ায় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘এ রায় সারা দেশের মানুষের প্রাণের রায়। কোটি কোটি মানুষের প্রাণের দাবি আজ বাস্তবায়িত হয়েছে। এ রায় আমাদের সার্বভৌমত্বের রায়। এ রায় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে রায়।’
রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ টিপু বলেন, ‘এই রায় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে কেবল রাষ্ট্রপক্ষের একার সফলতা নয়, এই সফলতা সারা দেশের মানুষের।’
তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান বলেন, ‘শুরুতে এই বিচারের তদন্ত ছিল অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। শেষ পর্যন্ত অনেক বাধা অতিক্রম করে একটি রায়ের মাধ্যমে তদন্ত সফল হয়েছে।’
তদন্ত কর্মকর্তা নূর হোসেন বলেন, ‘আমি আযাদের বিরুদ্ধে তদন্তে যেসব অভিযোগ পেয়েছি, তা এই রায়ের মাধ্যমে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। একজন তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে আমার কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করতে পেরেছি, এতেই আনন্দ।’
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সাহিদুর রহমান বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও প্রমাণাদির মাধ্যমে আযাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছে। তার প্রতিফলনই রায়ে প্রতিফলিত হয়েছে। এই রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’
মামলায় আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আবদুস শুকুর খান প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আযাদের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে সহায়তা পেলে তাঁকে নির্দোষ প্রমাণ করতে যে চেষ্টা করেছি, তা আরও ভালোভাবে করতে পারতাম। তবে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি।’
ট্রাইব্যুনাল ঘিরে নিরাপত্তা: পুরাতন হাইকোর্ট ভবন এলাকায় স্থাপিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ঘিরে গতকাল ছিল বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা। ট্রাইব্যুনালের পশ্চিম দিকের গেট (মাজারসংলগ্ন) সকাল নয়টা পর্যন্ত আটকানো ছিল। পূর্ব দিকের গেটটি (শিশু একাডেমি-সংলগ্ন) ছিল বন্ধ। দুই দিকে বিপুলসংখ্যক দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ছিল পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিটও।

No comments

Powered by Blogger.