৭২-এ নায়ক রাজ রাজ্জাক- কেমন কাটলো এবারের জন্মদিন?

প্রতিবছরেই এই দিনটি আমাকে নতুন করে বাঁচার প্রেরণা যোগায়। কারণ আমাকে এতো মানুষ ভালবাসে এই দিনটি আসলেই যেন তার বহির্প্রকাশটা বেশি ঘটে।
গতকাল সকালেই প্রিয় প্রিয় মানুষদের ফোন পেয়ে ঘুম ভাঙ্গে। আমার স্ত্রী লক্ষ্মীর রান্না করা প্রিয় নাস্তা খেয়ে অনেকের সাথেই ফোনে কথা বলেছি। শুভেচ্ছা বিনিময় করেছি। সন্ধ্যার পর চলচ্চিত্রের আমার বেশ কিছু প্রিয় প্রিয় মানুষ এসেছিলেন। তাদের সাথে আড্ডা দিয়েছি। পরিবারের সদস্যদের সাথে সময় কাটিয়েছি। একেবারেই অন্যরকম একটি দিন কাটল। এর আগে জাকজমকভাবে দিনটি পালন করা হলেও এবার একটু পারিবারিক ব্যস্ততা এবং শুটিং নিয়ে ব্যস্ততা থাকার কারণে কোন বিশেষ অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করিনি আমি।
আপনার জন্ম তো কলকাতায়...
১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি কলকাতার টালিগঞ্জের নাকতলা মহল্লায় আমার জন্ম। এলাকাটি সেন্ট্রাল কলকাতার দশ মাইলের মধ্যে। মুসলিম রক্ষণশীল পরিবারের সন্তান আমি। জমিদার ছিলাম না আমরা ঠিকই কিন্তু জমিদারদের মতো বিষয় সম্পদ ছিল আমাদের।
আপনাদের পারিবারিক কোন ব্যবসা ছিল?
আমার বাবা আকবর হোসেন আর মা নেসারুন্নেসা। ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরই ছিল আমাদের পারিবারিক ব্যবসা।
খেলোয়াড় থেকে অভিনেতা হবার গল্পটা জানতে চাই
তখন কলকাতায় ফুটবলের দারুণ উন্মাদনা। ফুটবলাররা উত্তম কুমারের মতো জনপ্রিয়। আমার ধ্যানজ্ঞান ছিল ফুটবলকে ঘিরে। তখন গোলরক্ষক হিসেবে দেশের মধ্যে আমি খুব সম্ভাবনাময় বলে পরিচিতি পেয়েছি। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় আমার অভিনয় জীবনের মাহেন্দ্রক্ষণ আসে। আমি কলকাতার খানপুর হাইস্কুলে পড়তাম। প্রতি বছর স্বরস্বতী পূজার সময় নাটক মঞ্চন্থ হতো। স্কুলের নিজস্ব মঞ্চ ছিল। গেমটিচার রবীন্দ্র নাথ চক্রবর্তী আমাকে বেছে নেন নায়ক অর্থাৎ কেন্দ্রীয় চরিত্রে। শিশু কিশোরদের নিয়ে লেখা নাটক বিদ্রোহী। আমার চরিত্র ছিল নানারকম সামাজিক কর্মকা-ে শিশু-কিশোরদের নেতৃত্ব দেয়া গ্রামীণ কিশোর। এই নাটকে আমার অভিনয় প্রশংসিত হবার পর ঝোঁক আসে অভিনয়ের প্রতি।
এরপর কি হলো?
বিদ্রোহী নাটকে কাজ করার পর আমার নাট্যগুরু পীযুষ তার শিশু রঙ্গসভায় আমাকে সদস্য করে নেন। তারপর শুরু হয় তার একের পর এক অভিনয় করে চলা।
পারিবারিকভাবে কোন বাধার সম্মুখীন হননি?
যেহেতু মুসলমান রক্ষণশীল পরিবারের সন্তান ছিলাম সেহেতু কিছুটা পারিবারিক বাধা তো ছিলই। তবে আমার মেজদা আব্দুর গফুর আমাকে খুব সমর্থন করতেন। তিনি আমাকে বলতেন “যদি ভাল করতে পারো তবে কোনো অসুবিধা নেই।” মূলত তার অনুপ্রেরণাতেই আজ অভিনেতা, নায়ক রাজ হতে পেরেছি।
চলচ্চিত্রের সাথে আপনার সম্পৃক্ততা কিভাবে?
টালিগঞ্জের ফিল্ম পাড়া আর আমাদরে বাড়ি একই জায়গায়। ছোট বেলা থেকেই কানন দেবী, বসন্ত চৌধুরী, ছবি বিশ্বাসদের দেখে দেখে বড় হয়েছি আমি। তাদের জনপ্রিয়তায় মুগ্ধ হয়ে আমিও মনে মনে ভাবতাম “একদিন আমি তাদের মত বড় অভিনেতা হবো।” টালিগঞ্জের বড় বড় স্টুডিও ছিল আমাদেরই এলাকায়। সেখানে নিয়মিত যাতায়াত ছিল আমার। সেখানে আড্ডাও দিতাম আমি। নাট্যগুরু পীযুষ বোস পরে চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে বিখ্যাত হন। তার সাথে আড্ডা দিতে টালিগঞ্জ স্টুডিওতে যেতাম। এভাবে যেতে যেতে ছবিতে ছোটখাট কিছু চরিত্রে অভিনয়ও করে ফেললাম। বড় বড় অভিনেতাদের ভিড়ে তখন অভিনয়ে তেমন সুযোগ পাওয়া যেত না। কিন্তু মনে মনে আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, অভিনেতা আমাকে হতেই হবে। বোম্বে যাবো, এমন কিছু ভাবছিলেন তখন। এদিকে আমার গুরুও না করলেন ছোটখাটো কোনো চরিত্র অভিনয় করতে।
ঢাকায় আসার পর তো আপনি অনেক নাটকে
অভিনয় করেছেন?
ঢাকায় আসার পরও অসংখ্য নাটকে অভিনয় করেছি আমি। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে তিনি ৫০টিরও বেশি নাটকে অভিনয় করেছি। আমারই বন্ধু জহিরুল হক, খান জয়নুল, খসরু, নোমান, আলী ইমাম, আলতাফ হোসেনের পরিচালনায় নাটকে অভিনয় করেছি। মজিবুর রহমান মজনু নামের আরেক বন্ধু ছিল আমার। তিনিও নাটক পরিচালনা করতেন। পরে অবশ্য আমার অনুরোধে ছবি প্রযোজনায় আসেন। মানিকগঞ্জের আজহার নাটক পরিচালক হিসেবে বেশ মেধাবী ছিল।
নায়ক হিসেবে চলচ্চিত্রে আপনার অভিষেক হলো ‘বেহুলা’ ছবির মাধ্যমে?
জহির রায়হান তার দেয়া আশ্বাস অনুযায়ী তিনি আমাকে ‘বেহুলা’ ছবিতে সুচন্দার বিপরীতে নায়ক হিসেবে কাস্ট করেন। ছবির কাজ শেষ হলো। মুক্তিও পেল। ব্যবসা সফল হলো সে ছবি।
চলচ্চিত্র ব্যবসা ফিরিয়ে আনার জন্য সবচেয়ে জরুরী পদক্ষেপ কোনটা হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
চলচ্চিত্রের ব্যবসাকে চাঙ্গা করতে হলে ভিডিও পাইরেসিটা বন্ধ করা অত্যন্ত জরুরী। আর তা করতে পারেন সরকার। অবাক হয়ে যাই যখন দেখি সরকারী কর্মকর্তাদের চোখের সামনে পাইরেসি হচ্ছে অবাধে। যদি সরকারই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে না দেন তাহলে তো এ শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই যত দ্রুত সম্ভব এর একটা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আর এর যথাযথ ব্যবস্থাপনা করা না পর্যন্ত এমন অনেকেই আছেন যারা ছবি প্রযোজনায় আর আসবেন না।
কিন্তু শুধু পাইরেসি বন্ধ হলে কি চলবে? এফডিসির আধুনিকায়ন তো জরুরী?
সেটা তো অবশ্যই উচিত। এফডিসিকে তো আধুনিকায়ন তো করতেই হবে। যেখোনে সারা বিশ্ব ছবি নির্মাণে এগিয়ে গেছে সেখানে আমরা পিছিয়েই পড়ছি । কিন্তু এভাবে আর কত দিন। সরকার কিন্তু ঠিকই রাজস্ব পাচ্ছেন চলচ্চিত্রাঙ্গন থেকে। কিন্তু এদিকে তেমন কোন নজর দিচ্ছেন না। শিল্প ঘোষণা করা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু শিল্পকে সঠিক শিল্পে পরিণত করার জন্য তেমন কোন উদ্যোগ তো নেয়া হচ্ছে না। আমি বুঝি না কেন এই মাধ্যমের প্রতি সরকারের এতো অবহেলা।

No comments

Powered by Blogger.