‘পুলিশের ডিসি হারুনকে পুরস্কৃত করার ঘটনা মানবাধিকার লঙ্ঘনকে উৎসাহিত করবে’

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের লালবাগ জোনের ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) হারুন অর রশিদকে পুরস্কার দিয়ে সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘনকে উৎসাহিত করেছে বলে মন্তব্য করেছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকেরা।
তারা বলেন, বিরোধীদলীয় চিফ হুইপকে মারধর করে সাবেক এডিসি হারুন মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন। আর সেই মারধরকে যদি সাহসিকতা ধরে রাষ্ট্রীয় পদক দেয়া হয়, তা হলে সেটা হবে মানবাধিকার লঙ্ঘনকে পুরস্কার দেয়া। এতে করে অন্য পুলিশ সদস্যরাও মানবাধিকার লঙ্ঘনে উৎসাহিত হবেন। তারা আরো বলেন, সরকারের এ পদক্ষেপই প্রমাণ করে যে, তারা রাজনৈতিক স্বার্থে পুরো প্রশাসনকে ব্যবহার করছে।

বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে পেটানোর ঘটনায় বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ কী করে রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (সেবা) পেলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দীন খান আলমগীর বলেছেন, ‘তাকে পদক দেয়ার েেত্র এ ঘটনাও বিবেচনায় আনা হয়েছে।’ গত মঙ্গলবার রাজারবাগ পুলিশ মিলনায়তনের অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আপনারা ল্য করবেন, তিনি (হারুন) তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন।’ ২০১১ সালের ঘটনায় কেন এ বছর পদক দিলেনÑ এই প্রশ্ন করা হলে মন্ত্রী বলেন, ‘১৯৭১ সালের অবদানের কারণে পুলিশকে তো ২০১১ সালে স্বাধীনতা পদক দেয়া হলো।’

ডিসি হারুনকে পদক দেয়া এবং তার পক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাফাই বক্তব্য সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর মনিরুজ্জামান মিয়া বলেছেন, পুলিশ পদক নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে দেশের ১৬ কোটি মানুষ লজ্জিত। তিনি বলেন, গণমাধ্যমের বদৌলতে গোটা বিশ্ব যে ডিসি হারুনের নগ্নরূপ দেখল তাকেই পুলিশের সর্বোচ্চ পদক দিলেন প্রধানমন্ত্রী। ডিসি হারুনের পদকপ্রাপ্তি নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তা পুলিশের নৈতিকতা হরণে ভয়ঙ্কর প্রভাব সৃষ্টি করবে।

এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক নয়া দিগন্তকে বলেন, একজন উচ্চশিক্ষিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে এ ধরনের উক্তি আশা করি না। এটা দুঃখজনক যে, একজন রাজনীতিবিদকে পেটালে উপহার পাওয়া যায়। এটি অচিন্তনীয়। পুলিশ পদকটা ভালো কাজের জন্য। কিন্তু এ ধরনের কাজের জন্য পদক দেয়া হলে পদকের মর্যাদা ুণœ হয়। তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই উক্তির মাধ্যমে এটি প্রতিফলিত হলো যে, পুলিশকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

এ ব্যাপারে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সমন্বয়ক তরিকুল ইসলাম। গতকাল রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় প্রমাণিত হয়েছে সরকার পুলিশকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। তিনি বলেন, সরকার পুলিশ বাহিনীকে দলীয় সংগঠনে পরিণত করেছে। অথচ প্রধানমন্ত্রী বলছেন, আমরা পুলিশকে কখনো রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাই না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের সাবেক এক আইজি নয়া দিগন্তকে বলেন, সাধারণভাবে কেউ বলছেন কাজটি ঠিক হয়নি, (পদক দেয়ার ক্ষেত্রে) আরো বিবেচনা করা উচিত ছিল। কেউ বলছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী না বুঝে বলেছেন। নাগরিক হিসেবে আমি মনে করি, পদক দেয়ার ক্ষেত্রে আরো সচেতন হলে ভালো হতো। ৬৭ জনকে পদক দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র দু’জনের জন্য পুরো পরিবারের মর্যাদা ুণœ হোক এটা কেউ আশা করে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জনগণ বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান। তারা বুঝতে পারছেন, কেবল পুলিশ নয়, পুরো প্রশাসনকে কিভাবে নিজেদের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা করা হচ্ছে।

পুলিশের সাবেক আরেক আইজি আবদুল কাইয়ূম বলেছেন, ডিসি হারুন অর রশিদকে পুরস্কার দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর যে বক্তব্য দিয়েছেন তা চরম ন্যক্কারজনক ও গর্হিতকর। এ ধরনের বক্তব্য বাংলাদেশের জন্য কলঙ্কজনক। তিনি বলেন, বিরোধীদলীয় চিফ হুইপকে মারধর করে সাবেক এডিসি হারুন আর রশিদ রীতিমতো মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছিলেন। আর সেই মারধরকে যদি সাহসিকতা ধরে রাষ্ট্রীয় পদক দেয়া হয়, তা হলে সেটা হবে মানবাধিকার লঙ্ঘনকে পুরস্কার দেয়া। এতে করে অন্য পুলিশ সদস্যরাও মানবাধিকার লঙ্ঘনে উৎসাহিত হবেন। এ ধরনের সাহসিকতার জন্য রাষ্ট্রপতি পুরস্কার দেয়ার প্রশ্নই আসে না। সাবেক এই আইজিপি আরো বলেন, বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ যদি আইন অমান্য করে থাকেন বা ডিউটিরত পুলিশকে গালিগালাজ করেও থাকেন, তাহলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে পারত। তাকে মারধর করার কোনো রাইট পুলিশের ছিল না। তিনি আরো বলেন, মূলত এই পদক দেয়া হয়েছে দলীয় পুলিশ সদস্যদের সন্তুষ্ট করতে। যাতে করে আগামী দিনের দমন-পীড়নে তারা উৎসাহিত হয়। আবদুল কাইয়ূম বলেন, আগামীতে যদি একই ধরনের ঘটনা ঘটে তাহলে তার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দীন খান আলমগীর দায়ী থাকবেন।

এ দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য চূড়ান্ত দায়িত্বহীন ও বেপরোয়া বলে মন্তব্য করেছেন গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার নেতৃবৃন্দ। তারা বলেন, নির্যাতক পুলিশ কর্মকর্তাকে পদক দেয়া প্রশ্নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য চূড়ান্ত দায়িত্বহীন ও বেপরোয়া। গতকাল গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার কেন্দ্রীয় পরিচালনা পর্ষদের এক সভায় নেতৃবৃন্দ এ কথা বলেন। তারা আরো বলেন, এর মাধ্যমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরাসরি পুলিশ কর্মকর্তাদের উসকানি দিচ্ছেন বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের নির্যাতন করার জন্য। শপথ নিয়ে এইভাবে হিংসা ও বিরাগের বশবর্তী হয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করার তৎপরতা সুস্পষ্টভাবে শপথের লঙ্ঘন। কাজেই মন্ত্রী থাকার কোনো নৈতিক অধিকার আর তার নেই। সমন্বয়ক গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকির সভাপতিত্বে বাম মোর্চার নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন এ সভায়।
       

No comments

Powered by Blogger.