ইতিহাস কেন?- স্বদেশ রায়

সুন্দরবনে আমরা অনেকেই অনেকবার গেছি। শত বছর ধরে বাঘ দেখছেন এমন মানুষও অনেকেই আছেন। নিজের জীবনেও অর্ধশতক বছর ধরে বাঘ দেখছি। বাঘের আচরণের কোন পরিবর্তন দেখিনি।
তাদের চিন্তা-ভাবনার কোন পরিবর্তন দেখিনি। বাঘ সেই একই রকমের বাঘ আছে। শিকার ধরা আর সন্তান উৎপাদনের মধ্যেই তার জীবন সীমাবদ্ধ। সুন্দরবনে যে বসন্তের চাঁদনী রাত যায়, যা দেখে অনেকে অনেক সুন্দর কবিতা লিখেছেন, বাঘের পক্ষে ওই বনে বাস করেও কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।
অথচ এই সুন্দরবনের পাশে গত কয়েক শত বছরের মানুষের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, এই জঙ্গলের পাশে বাস করেও বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের মতো মানুষ হয়েছেন, ভারতরতœ ডাক্তার বিধান রায় হয়েছেন, সর্বত্যাগী রাজনীতিক প্রফুল্ল সেন (পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী) হয়েছেন। এ সারিকে আরও দীর্ঘতর করা যায়।
একই জঙ্গলের কাছাকাছি বাস করে বাঘ ও মানুষের এই পরিবর্তনের মধ্য এই পার্থক্য কেন? এমনকি মানুষের জন্মের ঘটনায় যদি যাই, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী সবই তো সমুদ্রজাত এক কোষী উদ্ভিদ থেকে প্রথম যাত্রা শুরু করেছিল। বিবর্তনও প্রায় সমান তালে হয় সেই জঙ্গল জীবনে মানুষ ও পশুর। কিন্তু তারপরও মানুষ কেন দ্রুত আজকের এই উন্নত অবস্থানে পৌঁছাল? আর কেন পশু পশুই থেকে গেল? এর মূল কারণ মানুষ তার অভিজ্ঞতার ভা-ার তার পরবর্তী প্রজন্মকে বলে যেতে পারে। পরবর্তীতে তার জন্য লিখে রেখে যেতে পারে। পশু সেটা পারে না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মানুষ এই যে অভিজ্ঞতার ভা-ার প্রবাহিত করেছে এটাই কিন্তু মানুষকে জঙ্গলের মানুষ থেকে আধুনিক মানুষে পরিবর্তন করেছে।
ইতিহাস কাকে বলে তার সঠিক সংজ্ঞা আমি বলতে পারব না। কারণ আমি ইতিহাসের ছাত্র নই, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ইতিহাস পড়িনি। কিন্তু একজন মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে হলে তাকে কিছুটা মানুষের ইতিহাস বা মানবসভ্যতা জানতে হয়, সেইটুকু ইতিহাস পড়ে আমি ধরে নিয়েছি, মানুষের সকল অতীত অভিজ্ঞতার ভা-ারকে ইতিহাস বলে। মানুষ যখন তার সকল অতীত অভিজ্ঞতার ভা-ার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তখন মানুষের উৎকর্ষতা থেমে যায়। মানুষ এগুতে পারে না। মানুষের অবস্থা অনেকটা ওই সুন্দরবনের বাঘের মতোই হয়ে যায় অর্থাৎ খাদ্য গ্রহণ ও সন্তান উৎপাদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তার মানে মানুষ আবার জঙ্গলে ফিরে যায় মানসিকভাবে। কোন নতুন প্রজন্মকে যদি তার অতীতের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়, ওই মানুষ তখন আর স্বাধীন থাকে না। সে পরাধীন অনেকটা জংলী হয়ে যায়। তার জীবনের সকল উৎকর্ষতা থেমে যায়। থেমে যায় জাতীয় জীবনের উৎকর্ষতাও।
ইংরেজরা এখানে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করলে ভারতীয়দেরকে নিজস্ব আসল ইতিহাস পড়তে দেয়নি। কারণ তারা জানত এর ভিতর দিয়ে তারা তাদের অতীত জানতে পেরে নিজেকে সমৃদ্ধ করে উৎকর্ষতা লাভ করবে, এগিয়ে যাবে। ভারতীয়রা যখন নিজ চেষ্টায় নিজের ইতিহাস জানতে শুরু করে তখন তাদের পরিবর্তন শুরু হয়। এবং পরিবর্তনের সকল ক্ষেত্রে ইতিহাসের কতটা প্রয়োজনীয়তা তার ছোট্ট একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। প্রখ্যাত রসায়ন বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ভারতীয়দেরকে বিজ্ঞানী হিসেবে গড়ে তোলার ব্রত নিয়ে নেমে দেখলেন, আগে তার ছাত্রদের ভারতের বিজ্ঞানের ইতিহাস পড়ানো দরকার। তিনি রসায়ন বিজ্ঞানী। তাই তিনি ভারতীয় রসায়ন বিজ্ঞানের ইতিহাস লিখলেন, হিস্ট্রি অব হিন্দু কেমেস্ট্রি (এই হিন্দু বলতে কোন ধর্ম নয়, সিন্ধু তীরের কূল বেয়ে আসা মানুষ)। ঠিক তেমনিভাবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সাহিত্যও যদি দেখি বঙ্কিম থেকে শুরু করে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় হয়ে শচীন বাবুর সিরাজউদ্দৌলা অবধি, সবই কিন্তু ইতিহাসনির্ভর। কারণ, নিজের ইতিহাস না জানলে মানুষের উৎকর্ষতা আসে না, তার স্বাধীন সত্তার জন্ম হয় না। এবং সেদিন এই ইতিহাসনির্ভর সাহিত্য কী ফল দিয়েছিল তার জন্য মনে হয় বেশি উদাহরণের দরকার নেই। শুধু শাহ সুজা নাটকের ‘ধন ধান্য পুষ্পভরা’ গানটি মনে করলেই যথেষ্ট।
এমনিভাবে আজ দেখতে পাচ্ছি, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত নানান দিক থেকে বিশ্বমানে নিজেকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি এই লেখায় বিস্তারিত উল্লেখ না করে শুধু বলব, এই বিশ্বমানে পৌঁছতে তাদেরকে বিজ্ঞানী এ পি জে আবুল কালাম, সি ভি রমন যে সহায়তা করছেন, আধুনিক ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব, রোমিলা থাপার, বিপান চন্দ তার থেকে কম করছেন না। কারণ তাদের আধুনিক ইতিহাস চর্চা, প্রতি মুহূর্তে সমৃদ্ধ করছে ভারতীয়দের অভিজ্ঞতার ভা-ারকে।
তাই মানব সভ্যতার অভিজ্ঞতার ভা-ার থেকে, জাতীয় অভিজ্ঞতার ভা-ার থেকে কোন জাতিকে বিচ্যুত করার পক্ষে কী যুক্তি আছে সেটা আমার মতো সাধারণ মানুষের মাথায় ঢোকে না। আমাদের শিক্ষানীতি যাঁরা প্রণয়ন করেন তারা অনেক জ্ঞানী মানুষ। তাঁরা অধিকাংশই শিক্ষক, তাই আমাদের মতো অর্ধশিক্ষিত সাংবাদিকরা তাদের ভুল ধরতে গেলে সেটা ধৃষ্টতাই হবে বলে মনে করি। তবে যারা শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন কখনও তাদের শিক্ষানীতির ভিতর দিয়ে বের হয়ে আসার পর ওই মানুষটিকে দিয়ে সমাজের কিছু করাতে হয় কিনা সেটা আমার জানা নেই। কিন্তু আমরা এখন নতুন সাংবাদিক নির্বাচন করতে গিয়ে এই শিক্ষানীতির ভিতর দিয়ে যারা বেরিয়ে আসছেন তাদের নিয়ে কি সমস্যায় পড়ি সেটা হয়তো তাদের জানা নেই। সাংবাদিক নির্বাচন করতে গিয়ে যেসব সমস্যায় পড়ি তা এমনই, যেমনÑবিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে পাস করে আসা এক ছাত্রের ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, শেরেবাংলা কে ছিলেন? সে উত্তর দিলÑউনি রাজনীতি করতেন। কোথায় রাজনীতি করতেন, কী রাজনীতি করতেন? ছেলেটির উত্তর, বাংলাদেশে, মনে হয় বরিশালে? বললাম জওহরলাল নেহরুর নাম শুনেছ, উত্তরÑশুনেছি। কি জান তাঁর সম্পর্কে? বলল, মনে হয় ইন্দিরা গান্ধীর বাবা। ভয়ে আর তার কাছে বঙ্গবন্ধু কে তা জিজ্ঞেস করি না, পাছে বলে বসে, মনে হয় শেখ হাসিনার বাবা! আমরা অতি ক্ষুদ্র মানুষ, যাঁরা শিক্ষানীতি করেন তাদের নামের আগে-পিছে অনেক ডিগ্রী। তাদেরকে প্রশ্ন করার সাহস আমাদের নেই। সাধারণ মানুষের কাছে প্রশ্ন বলুন, এই ছেলেকে নিয়ে আমি সাংবাদিকতায় কি করাব? অথচ তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার ডিগ্রী আছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল ডিগ্রী নিয়ে এসেছে এমন এক ছেলেকে তার সার্টিফিকেট দেখে চাকরি দিয়ে লিখতে দিলাম, মওলানা ভাসানীর ওপর। বললাম, ইয়ার মোহাম্মদ সম্পর্কে জান তো? বলল, জানি ইত্তেফাকের জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন? এখন বলুন আমরা কি করব?
এরপরও যখন শুনি আওয়ামী লীগ সরকার, বাম প্রগতিশীল শিক্ষামন্ত্রী এ সবই বর্তমান থাকতে দেশে ইতিহাস চর্চা বন্ধ করা হচ্ছেÑযার অর্থ মানুষের উৎকর্ষতা থামিয়ে দিয়ে তাকে আবার জঙ্গলে পাঠানোর পথ সৃষ্টি করে দেয়া। মানুষকে ধীরে ধীরে জঙ্গলের জীবনে আনা। তখন এর বিচারের ভার সাধারণ মানুষের ওপর দেয়া ছাড়া উপায় থাকে না। পাকিস্তান ইতিহাস না পড়ে আজ প্রায় জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনের মিডিয়া নিশ্চয়ই দেশটিকে জঙ্গল হিসেবেই উপস্থিত করছে গোটা পৃথিবীতে। আর আমেরিকায় ইতিহাস বাধ্যতামূলক থাকায় তারা আজ পৃথিবীতে রাজত্ব করছে। আমরা কোন পথ বেছে নেব?
swadeshroy@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.