কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিশু হত্যা- ছাত্রলীগের নেতাদের ধরছে না পুলিশ by মোশতাক আহমেদ ও কামরান পারভেজ

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের গোলাগুলিতে শিশু নিহত হওয়ার ঘটনায় মূল আসামিদের ধরছে না পুলিশ। এ মামলায় ১৭৫ জন আসামির মধ্যে যে ২৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁদের প্রায় সবাই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী।
অভিযোগ উঠেছে, সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের নেতাদের রক্ষা করতে নানাভাবে চেষ্টা চলছে। নিহত শিশু রাব্বির পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বিষয়টি সমঝোতা করার জন্য বলা হচ্ছে। রাব্বির বাবা ও মামলার বাদী দুলাল মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা কোনো সমঝোতা চান না, সন্তান হত্যার বিচার চান।
এ ছাড়া উপাচার্য রফিকুল হক বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগের অপকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো একটি অংশকে প্রশ্রয় দিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। একাধিক শিক্ষক বলেন, সর্বশেষ শনিবারের সংঘর্ষের আগে একটি নিয়োগ নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি শামছুদ্দিন আল আজাদকে নিজের পক্ষে টানতে চেয়েছিলেন উপাচার্য। তাঁরা জানান, এ কারণে পুলিশ প্রশাসনও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উৎসাহ দেখায় না।
তবে উপাচার্য রফিকুল হক এ অভিযোগ অস্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কখনোই ছাত্রলীগের অন্যায়কে প্রশ্রয় দিইনি। বরং ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে বেশ কিছু ব্যবস্থাও নিয়েছি।’
সংঘর্ষের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটি এখনো প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি। এ পরিস্থিতিতে আগের মতো এ ঘটনাও ধামাচাপা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত শনিবার কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সদ্যবিলুপ্ত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটির সভাপতি শামছুদ্দিন আল আজাদ ও সাধারণ সম্পাদক রফিকুজ্জামানের নামে গড়ে ওঠা দুই উপদলের গোলাগুলিতে ক্যাম্পাসের পাশের গ্রাম বয়রা বেপারিপাড়ার এক দরিদ্র পরিবারের ১০ বছরের শিশু রাব্বী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। পরদিন রাব্বীর বাবা ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা করেন। কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও গ্রামের লোকজন বলছেন, আসামিদের ধরতে পুলিশের তেমন তৎপরতা চোখে পড়ছে না। সংঘর্ষের দিনও পুলিশ নীরব ছিল।
তবে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু মো. ফজলুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসামিদের ধরা হচ্ছে না, এটা ঠিক নয়। ধরার চেষ্টা চলছে। আশা করছি, শিগগিরই ধরা পড়বে। এখানে ছাড় দেওয়ার কোনো বিষয় নেই।’
এজাহার থেকে জানা যায়, মামলার ১ নম্বর আসামি হলেন বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি শামছুদ্দিন আল আজাদ। এর পরই আছে সাধারণ সম্পাদক রফিকুজ্জামানের নাম। উল্লেখযোগ্য অন্য আসামিরা হলেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহীন মাহমুদ, পারভেজ আনোয়ার, সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুজ্জামান। এঁদের কেউই গ্রেপ্তার হননি। ঘটনার দিন আটক চারজনকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এঁদের তিনজনের নাম এজাহারে আছে।
সমঝোতার জন্য ফোন: বয়রা গ্রামে গিয়ে কথা হয় শিশুটির পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। বাড়ির বাইরে একটি চায়ের দোকানে বসে ছিলেন শিশুটির বাবা দুলাল মিয়া। আশপাশে স্বজনদের ভিড়। তিন ছেলের একজনকে হারিয়ে টেম্পোচালক দুলাল মিয়া যেন কথা হারিয়ে ফেলছেন। বারবারই বলছিলেন, ‘আমার আর কোনো চাওয়া নেই; শুধু সন্তান হত্যাকারীদের বিচার চাই।’ এ সময় দুলাল মিয়ার মামাতো ভাই ফারুকুল ইসলাম বলেন, ‘গত সোমবার রাত নয়টার দিকে ছাত্রলীগ পরিচয়ে একজন ফোন করে সমঝোতা করে ফেলার জন্য বলেন। কিন্তু আমরা সমঝোতা চাই না, বিচার চাই।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত পেছাচ্ছে: এ ঘটনায় কারা জড়িত, তা চিহ্নিত করার জন্য ঘটনার পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফসল উদ্ভিদবিজ্ঞানের শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমানকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। গতকাল প্রতিবেদন জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল, কিন্তু দেওয়া হয়নি।
কমিটির প্রধান মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার মূল সাক্ষী শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় সাক্ষী নেওয়া যায়নি। এ জন্য সাত কর্মদিবস সময় চাওয়া হয়েছে। তিনি আশা করছেন, এই সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে যাবে।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্রগুলো বলছে, ১০-১২ ফেব্রুয়ারির আগে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সম্ভাবনা কম। অবশ্য শিক্ষকেরা ২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার জন্য প্রশাসনকে বলেছেন। আকস্মিক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম স্থবির হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন পর আবারও সেশনজটের আশঙ্কা করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। শনিবারের গোলাগুলির পর পরই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
প্রশাসনের প্রশ্রয়ে ছাত্রলীগ: ক্যাম্পাসের একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সদ্যবিলুপ্ত (রাব্বী হত্যার দিন বিলুপ্ত) কমিটির নেতা-কর্মীরা দুই বছর ধরে ক্যাম্পাসে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। ২০১১ সালের এপ্রিলে শামছুদ্দিন আল আজাদকে সভাপতি ও রফিকুজ্জামানকে সাধারণ সম্পাদক করে ১০১ সদস্যের কমিটি গঠনের পর থেকেই নেতা-কর্মীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। একের পর এক ঘটনা ঘটালেও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে উপাচার্য রফিকুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। দুষ্কৃতকারীদের ধরার জন্য পুলিশকে আহ্বানও জানিয়েছি। কিন্তু দুঃখজনক হলো, পুলিশ সেই আহ্বানে সাড়া দেয়নি।’
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সূত্রগুলো বলছে, এই কমিটির নেতা-কর্মীরা ২০১১ সালে তৎকালীন প্রক্টর আবু হাদী নূর আলী খানের গাড়ি ও বাড়িতে হামলা করেন। ছাত্রলীগের ছিনতাইয়ের ঘটনা ধরে ফেলার কারণে তাঁর ওপর এ হামলা হয়। একই সময় কয়েকজন শিক্ষকের ওপরও হামলা চালান তাঁরা। এরপর গত বছরের মে মাসে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি দরপত্রে অংশ নিতে আসা সাবেক এক ছাত্রনেতাও ছাত্রলীগের ক্যাডারদের হাতে মারধরের শিকার হন। এরপর কামাল-রঞ্জিত (কে আর) মার্কেটে দোকান ভাঙচুর, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য স্থাপনাও ভাঙচুর করেন তাঁরা। গত বছরের ৯ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের অন্তত ১৫-২০ জন নেতা-কর্মীকে পুলিশের সামনেই প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা ধরে পিটিয়ে জখম করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যেকোনো ঠিকাদারি কাজে ছাত্রলীগের এই কমিটির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বখরা দিতে হতো। বিভিন্ন নিয়োগেও তাঁরা ভাগ বসান।
সর্বশেষ শিশু রাব্বী হত্যার ঘটনা ঘটে এই নিয়োগবাণিজ্য ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিভিন্ন পদে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। আর এতে কে বেশি ভাগ পাবেন, তা নিয়ে দুই উপদলের মধ্যে সংঘর্ষে রাব্বী নিহত হয়। এর আগের তিন দিন দুই উপদলের মধ্যে সংঘর্ষও হয়। কিন্তু প্রশাসন কোনো ভূমিকা নেয়নি। পুলিশের ভূমিকাও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।
এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য ছাত্রলীগের নেতাদের পাওয়া যায়নি। মামলা হওয়ার পর তাঁরা গা ঢাকা দিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.