সম্ভাব্য সংকটের মুখে কিছু দেশচিন্তা by এম আবদুল হাফিজ

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন মহাজোট তার মেয়াদের চার-পঞ্চমাংশ সময় সম্প্রতি অতিক্রম করেছে। যদিও তাদের আগামী নির্বাচনের কাউন্টডাউন অনেক আগেই শুরু হয়েছে।
গণভবনে প্রধানমন্ত্রী বছরখানেক ধরে যে জেলাওয়ারি দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করে আসছেন, তা দশম সংসদের জন্য নির্বাচনী প্রচারণারই প্রাথমিক পর্যায়। বিএনপিও তার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটকে সঙ্গে নিয়ে বিক্ষোভ-অবরোধ হরতালের নামে বছরখানেক ধরে যে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, তাও আগামী নির্বাচনের লক্ষ্যেই পরিচালিত। এতে অস্বাভাবিকতার কিছু নেই। তা সত্ত্বেও দেশে বিদ্যমান অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা ও সহিংসতার প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে নির্বাচন অনুষ্ঠান হওয়া পর্যন্ত দেশ যে কোন আঙ্গিকে দেখা দেবে, তা নিয়ে উদ্বেগের অন্ত নেই।
রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা, আন্দাজ-অনুমান ও হিসাব-নিকাশ আজকাল আমাদের এই স্বাধীন দেশে একপ্রকার সর্বজনীনতা পেয়েছে। যেহেতু রাজনীতির ইস্যুগুলো সব মানুষকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্পর্শ করে, তাই তাদের এ নিয়ে না ভেবেও উপায় নেই। এমনকি একজন দিনমজুরকেও রাজনীতি নিয়ে সচেতন থাকতে হয়। তা না হলে তার অজ্ঞতার জন্য কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে কাজ না জুটলে তাকে এর খেসারত দিতে হবে। এমন এক সময় এ দেশে এসেছে, যখন সংসারবিবাগী সাধুসন্তরও রাজনীতি না জেনে উপায় নেই। তাই ঘর থেকে বেরোলে যেখানেই যার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে, যেকোনোজনকে একই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে- ভাই, কী অবস্থা দেশের? ঘুরিয়ে বললে প্রশ্নকর্তা আসলে জানতে চান, আমরা আওয়ামী গ্যাঁড়াকল থেকে কবে মুক্তি পাব? বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের রাজপথে তাণ্ডব থেকে কখন বেরিয়ে আসতে পারব? ইলেকশন কি যথাসময়ে হবে, না মিলিটারি আবার আসবে? নাকি সরকার জরুরি অবস্থা দেবে? ইত্যাকার প্রশ্ন, যার কোনো সদুত্তর নেই।
গুজবে গিজগিজ করে মধ্যবিত্তের বৈঠকখানা, বাস, স্টিমার, বিয়ের আসর, এমনকি হাসপাতালে যাওয়া রোগীদের মধ্যে বা ব্যাংকে কাজ সারতে যাওয়া গ্রাহকদের মধ্যে। সবার চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা। সবাই প্রশ্ন করে বা তথ্য দেয় হলমার্কের, পদ্মা সেতুর ও ডেসটিনির। মনে হয়, সাধারণ্যেও অনেকে অনেক কিছুই জানে। নিজেকে নির্বোধ মনে হয়। একাত্তরজুড়ে অসংখ্য গুজবের সঙ্গে সহাবস্থান করছি। স্বাধীনতার পরও গুজবের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়নি। ক্ষমতাকে ঘিরে বরং তা আরো বেড়েছে। সঙ্গে বেড়েছে নানামুখী আতঙ্ক আর নিরাপত্তাহীনতা।
হয়তো ফুরফুরে মেজাজ নিয়েই পৌষালি সন্ধ্যায় মসজিদে হাঁটা দিলাম, অনুচ্চ স্বরে কণ্ঠে জীবনানন্দের কবিতার পঙক্তি : উড়ুক উড়ুক তারা পউষের জোছনায় নীরবে উড়ুক/কল্পনার হাঁস সব ইত্যাদি। রাস্তার মোড়েই দণ্ডায়মান যমদূতের মতো কেউ হয়তো খবর দিল : জানেন স্যার, বিকাশ কয়েক কোটি টাকার লেনদেনে জেল থেকে বেরিয়েছে। সো হোয়াট? বিকাশ, কে সে? প্রথমবারের মতো নাম শুনলাম। আমি না চিনলে কি হবে, পরদিন সব সংবাদপত্রে বিকাশ নামের এক সন্ত্রাসী কাভারেজ দেখলাম এবং যুগপৎ শঙ্কিত হলাম এবং নিজের অজ্ঞতায় লজ্জিত বোধ করলাম।
ইদানীং বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়েও উত্তপ্ত আলোচনা- অমুক দল কি ঠিক করেছে, তবে তার প্রতিপক্ষ ঠিক করেনি? এখনকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নতুন উপসর্গ সংযোজিত হয়েছে তাণ্ডব ও ভাঙচুরের এবং প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মারমুখী অবস্থান, যেটা আগে শুধু পুলিশের এখতিয়ারে ছিল। পুলিশ এমনভাবে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীকে হরতাল বা অবরোধে লাঠিপেটা করত যে তা নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলতে পারত না। যেন তা সরকারের সবুজ সংকেত সাপেক্ষে অমন পেটাইয়ের সপক্ষে ওপেন লাইসেন্সেরই কাজ করত। এখনো দেখা গেছে, অবরোধ কর্মসূচিতে পুলিশই অবরোধকারীদের এক নির্দিষ্ট পরিসরে অবরোধ করে রাখে।
এখন দেখা যাচ্ছে, পুলিশি বাড়াবাড়ির সীমা অতিক্রম করলে পাবলিকও প্রত্যাঘাত করে। আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করে করে বিভিন্ন দল বা সংগঠনের প্রচুর অভিজ্ঞতা জন্মেছে যে ইটটি খেলে কী করে পুলিশকে পাটকেলটি ছুড়ে মারতে হয়। আন্দোলনকারীরা এখন শক্তির মহড়া দেখাতে কৌশলেরও আশ্রয় নিতে শিখেছে। সম্প্রতি জামায়াত-শিবিরের পুলিশকে চোরাগোপ্তা হামলায় নাস্তানাবুদ বা ঝটিকা মিছিলের মাধ্যমে পুলিশের ওপর চড়াও হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। দৃশ্যত দেশবাসী, সরকার ও প্রশাসন এ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।
এদিকে এ দেশের রাজনীতির প্রধান দুই খেলাড়ির মধ্যে বিদ্বেষপূর্ণ সম্পর্কের কারণে রাজপথের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দল বা গোষ্ঠীর তীব্র ও তিক্ত প্রতিযোগিতায় গণমানুষের উদ্বেগ এখন তুঙ্গে। সবাই শুধু জানতে উন্মুখ, কী হতে যাচ্ছে এ দেশে আগামী এক বছরে বা তার পরেও? এ দেশের রাজনৈতিক পরিসরে মতাদর্শগত ও মনস্তাত্তি্বক বিভাজন ও দূরত্ব এত দুস্তর যে আপাত দৃষ্টিতে তা দূর করা অসম্ভবই প্রতীয়মান হয়, যদি না অলৌকিকভাবে কোনো ত্রাতার আবির্ভাব ঘটে।
ষাটের দশকের শেষের দিকে পশ্চিম ইউরোপের তরুণরা এক প্রকার নব্য কমিউনিস্ট ব্যানারে ইউরোপের রক্ষণশীল দেশগুলোর সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল। পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক তারিক আলীরা এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাদেরই অনুকরণে জামায়াত-শিবিরের ঝটিকা আন্দোলন ইউরোপের সেই আরবাল গেরিলা অ্যাকটিভিজমের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কর্তৃপক্ষ তাদের নিষিদ্ধ ঘোষণার যেসব কথা বলছে, তাতে তাদের আন্ডারগ্রাউন্ডে বা আরো হার্ডলাইনে যাওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
প্রতিপক্ষ প্রতিপক্ষই। কদাচিৎ তা পছন্দনীয় হয়। তবু বিশ্বজনীন নিয়ম অনুযায়ী তাদের সঙ্গে মুখোমুখি বসতে হয়। গত শতাব্দীর চলি্লশের দশকে মাও সে তুং তাঁর চীনা বিপ্লব ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি আলোচনার জন্য চীনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। মার্কিনরা তা অগ্রাহ্য করে চীনের আপত্তি সত্ত্বেও কোরিয়ায় সেনা পাঠায়। মাত্র দুই দশকের ব্যবধানে মার্কিনরা অন্যের দূতিয়ালির মাধ্যমে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ১৯৭২ সালে নিঙ্নের চীন সফরের ব্যবস্থা করেছিল।
এ দেশে এখন নির্বাচন পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া নিয়ে সংবিধানে বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী আনয়ন করে ক্ষমতাসীনরা যে জটিলতার জন্ম দিয়েছেন, তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে না পারলে জটিলতা ও রাজনৈতিক উত্তাপ শুধু বাড়বেই। আর এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকেই। তবে এ ব্যাপারে দায়িত্বের পাল্লা ভারী ক্ষমতাসীনদের জন্য। মনে রাখতে হবে, এ নিয়ে সংঘাতে গিয়ে কেউ কাউকে নির্মূল করতে পারবে না, নির্মূল ও নিস্তেজ হবে শুধু জাতির প্রাণশক্তি। দেশের নেতৃত্ব তা উপলব্ধি না করলেও, এ নিয়ে জনগণের উপলব্ধি শতভাগ। তাই শুধু তাদের মধ্যেই এত উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা।

লেখক : সাবেক মহাপরিচালক
বিআইএমএম ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.