প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছি by ড. মাহবুব হাসান

আমার প্রতিবাদের ভাষা আমি হারিয়ে ফেলেছি। কোন ভাষা আমি ব্যবহার করব আজ? আমার মায়ের যে ভাষা আমি রপ্ত করেছি, সেই ভাষায় তো আমি প্রতিবাদ জানাতে পারছি না। কারণ সেই ভাষায় লিখে দেখেছি, সেই প্রতিবাদ কর্ণকুহরে ঢোকে না শাসকদের।
তাঁরা কানে তুলা দিয়েছেন, এই সহজ কথাটি লিখব না। কারণ কানে তাঁরা তুলা দেননি। আমার মনে হচ্ছে, তাঁরা কানে তুলার বদলে বুলেট ঢুকিয়ে রেখেছেন। আর তা যদি না হয়, তাঁরা খোলা রেখেছেন তাঁদের কর্ণগহ্বর। খোলা কানে না শোনার কোনো কারণ নেই। তাঁরা কান খোলা রেখেছেন, যাতে প্রতিবাদের শব্দগুলো এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। এ শুধু আমার কথাই নয়, লক্ষ কোটি প্রতিবাদীর কথা এটাই।
এখন আমরা কী করতে পারি? লেখালেখির বিদ্যা ছাড়া তো আর কিছু শিখিনি। যদি ছেলেবেলা থেকে ফসল উৎপাদনের কাজটা শিখতাম, যদি সেই কাজে পারদর্শী হতাম, তাহলে হাতে কাস্তে নিয়ে প্রতিবাদে বেরিয়ে যেতে পারতাম পথে। কিন্তু সেটা আমার পথ নয় আজ আর। আমি বা আমরা যাঁরা লেখালেখি করি, সাংবাদিকতা করি, চাকরিবাকরি করে জীবন চালাই, তাঁরা মূলত শৌখিন বিপ্লবী বা প্রতিবাদী। আমরা চাষাবাদের দক্ষতা অর্জন করিনি; কিন্তু সেগুলো সম্পর্কে পুরোপুরিই জানি। জানি চাষিরা ফসল ফলিয়ে না দিলে আমাদের মতো 'শৌখিন'দের এবং শাসকদের পেটে খাবার যেত না। এতটা মিথ্যাচারও করতে পারত না শাসকগোষ্ঠী।
শাসকগোষ্ঠী- তারাও চাষিদেরই ছেলেমেয়ে। কিন্তু তারা হারিয়ে ফেলেছে বাংলার মানুষের সেই হাজার বছরের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনসংগ্রামের পাতাগুলো। তারা এখন ওই জীবনের তেমন কিছুই উপলব্ধি করতে পারে না। তারা চোখে দেখে কেবল ক্ষমতার সিংহাসনটি। ধান-পাট আর রবিশস্যের সেই অপরূপ দৃশ্য তারা ভুলে গেছে। তারা ভুলে গেছে যাদের তারা শাসন ও শোষণ করছে, তারা তাদেরই মা-বাবা, ভাইবোন এবং আত্মার আত্মীয়।
২.
কে যেন আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি রক্তাক্ত ছবি পেস্ট করেছে। যে ছেলেটিকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখে মারছে, প্রথমেই ধক করে বুকে একটা শব্দ হলো ছবিটা দেখে! রক্তাক্ত ছেলেটি কি আমার? ভালো করে তাকিয়ে দেখি- না, আমার ছেলে নয়। তখনই মনে হলো, আমার ছেলে কেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যাবে? দিনটি ছিল বিএনপি ও ১৮ দলের অবরোধের দিন। খবর পড়ে জানলাম, ছেলেটি বিএনপির নয়, অবরোধে অংশগ্রহণকারীও নয়। সে যাচ্ছিল তার কাজের জায়গায়। পথে বোমা মেরে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল কে বা কারা। সে আতঙ্কিত হয়ে আশ্রয় নিয়েছিল একটি ক্লিনিকে। সেই ক্লিনিকে তাকে ধাওয়া করে আসে সন্ত্রাসীরা। তারা তাকে চাপাতি দিয়ে কোপায় আর রড দিয়ে মারতে থাকে। ছেলেটি আত্মরক্ষা করতে বলছিল, সে বিএনপির কেউ নয়, সে হিন্দু। সে দৌড়ে নিচে নেমে আসে। সেখানে অনেক মানুষের সামনেই সন্ত্রাসীরা কোপাতে থাকে তাকে। যখন ছাড়ে তারা, তখন সে মৃতপ্রায়। উৎসাহী ও সাহসী কয়েকজন বলেছিল ছেলেটিকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু ছেড়ে দেয়নি সন্ত্রাসীরা। তারা বিশ্বাস করেনি ছেলেটির কথা। যেহেতু বুলেট পোরা ছিল তাদের কানে, তাই কোনো কথাই তারা শুনতে পায়নি। ছেলেটি বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু সন্ত্রাসীরা তাকে বাঁচতে দিল না। ছেলেটির নাম বিশ্বজিৎ। আমি জানি, আমার ছেলে নয়। কিন্তু নিরাপত্তাহীনতায় তো আমার ছেলে ও পরিবার-পরিজনও রয়েছে। শুধু আমার কেন, ঢাকা মহানগরীর সব মানুষই তো আজ ওই সব সন্ত্রাসী-খুনির নাগালের মধ্যেই বাস করছে। মহানগরীর বাসিন্দাদের কোনো নিরাপত্তাই দিতে পারছে না সরকার বা পুলিশ। রাজনৈতিক সরকার ও পুলিশ যখন এককাতারে দাঁড়ায়, তখন দেশে অরাজকতাই শাসক হয়ে ওঠে। এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী মহাজোট নয়, ক্ষমতায় জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা, যাদের কর্ণকুহরে পোরা রয়েছে তপ্ত বুলেট। তাই নির্যাতিত-নিপীড়িত, অবহেলিত ও নিরাপত্তাহীন গরিব মানুষের আর্তচিৎকার তাদের কানে পৌঁছে না।
বিশ্বজিৎকে হিন্দু ধরব, না আওয়ামী লীগের বলব? কেউ কেউ বলেছে, সেমসাইড হয়েছে। তার মানে কী? আওয়ামী সমর্থক বলে কি সে মানুষ নয়? আর তার জন্য আমাদের কোনো কথা বলা ঠিক হবে না? ইতিহাস বলে, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা- এই সত্য রাজনৈতিকভাবে যেমন সত্য, তেমনি অরাজনৈতিকভাবেও সত্য। কোনোভাবেই সন্ত্রাসের জন্ম দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু কে শোনে সে কথা!
সন্ত্রাস দমন করতে হবে কঠোর হাতে। আর ভালোবাসতে হবে মানুষকে। মানুষকে মানুষ হিসেবে ভালোবাসতে না পারলে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীদের দমন করে জননিরাপত্তা দেওয়া যাবে না। সন্ত্রাস ও জঙ্গি চারদলীয় জোট সরকারের আমলে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল ব্যাপক হিংসা আর বিদ্বেষ নিয়ে। সেই নগ্ন-নিষ্ঠুর রূপ আমরা দেখেছি '৭২ থেকে '৭৫ সাল পর্যন্ত একবার। তারপর '৮৪ থেকে '৯০ সাল পর্যন্ত দেখেছি রাষ্ট্রযন্ত্র কিভাবে সন্ত্রাসবাদ কায়েম করেছিল নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু প্রতিবাদী জনতার স্রোতে ভেসে গেছে এরশাদের সেই স্বৈরশাসন ও সন্ত্রাসীরা। রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের উদ্ভব '৭২ সালে হলেও তা কায়েমি হয়ে ওঠে এরশাদের শাসনামলে। জিয়ার শাসনামলে তারা মাথাচাড়া দিতে পারেনি। কিন্তু রাষ্ট্রপতি সাত্তারের আমলে ইমদু নামের সন্ত্রাসী ও তাদের পারিষদরা জুড়ে বসেছিল শাসকদের পাশাপাশি। এরপর এরশাদ ক্ষমতায় এসে সেই সন্ত্রাসীদেরই রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার করেন। সেই ধারাবাহিকতাই আমরা লক্ষ করছি ছাত্ররাজনীতিতে মাস্তান-সন্ত্রাসীদের নেতা মনোনয়নের মাধ্যমে। সেই ধারাবাহিকতায় শাজাহান খান মন্ত্রী হয়েছেন। তাঁর মতো শ্রমিক নেতা যখন মন্ত্রী হন, তখন বোঝা যায়, শেখ হাসিনার মন্ত্রী মনোনয়নে কতটা ধস নেমেছে। তাঁকে বলা হয় গণতন্ত্রের কন্যা। আর তিনি মন্ত্রী বানান সন্ত্রাসীদের। আমরা ছাত্রশিবিরকে রগকাটা সন্ত্রাসী হিসেবে চিনেছি। এখন তারাও হেরে গেছে অন্য সন্ত্রাস ও হত্যাযজ্ঞের কাছে। তারা এতটাই বেহুঁশ যে তাদেরই সমর্থক ভোটদাতা একজন নিরীহ কর্মজীবী মানুষকে বিনা কারণে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্য দিবালোকে, জনসমক্ষে। এর চেয়ে ন্যক্কারজনক আর কী হতে পারে!
৩.
বিশ্বজিৎ হত্যার পর সারা পৃথিবীর মানুষই দেখেছে সেই নৃশংসতা টিভির পর্দায়, টুইটারে, ফেসবুকে এবং আরো বহু রকম সোশ্যাল সাইটে। ফেসবুক অত্যন্ত কার্যকর এক সংবাদমাধ্যম হয়ে উঠেছে। আমি লক্ষ করলাম, কী অবিশ্বাস্য গতিতে ফেসবুকে বিশ্বজিৎ হত্যার নিউজ ক্লিপিং উইথ ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে!
পুলিশ একটা দায়সারা গোছের মামলা করেছে। সেখানে সব আসামিই অজ্ঞাত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম খা আলমগীর বললেন, বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের আটজনকে ধরা হয়েছে। পুলিশ বলেছে, না, কেউ ধরা পড়েনি। তারা বলেছে, যাদের ধরা হয়েছে, তারা বিশ্বজিৎ হত্যার আসামি নয়।
টিভির ফুটেজে দেখা গেল এবং দেশবাসী ও বিশ্ব দেখল, কারা বিশ্বজিৎকে হত্যা করছে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আর রড দিয়ে মেরে। কিন্তু সেই চিহ্নিতরা পুলিশের কাছে অজ্ঞাত। তারা চিহ্নিতদের ধরতে উৎসাহী নয়। তাই কোনো মিডিয়ার কাছে থেকে ফুটেজও নেয়নি বা এ ব্যাপারে তৎপর নয়। কারণ পুলিশ জানে, তারা হচ্ছে সরকারের নির্দেশ পালনকারী পুলিশ-ক্যাডার। সোজা কথায় সরকারের পোষ্য আইনানুগ মাস্তান বা আইনি সন্ত্রাসী। পুলিশের সামনেই সেদিন বিশ্বজিৎকে খুন করেছে সন্ত্রাসীরা। সে সময় পুলিশ হাত গুটিয়ে দর্শকের ভূমিকা নিয়েছে। কেন? তারা তো আইনের রক্ষকই কেবল নয়, মানুষের জানের জিম্মাদারও। কিন্তু পুলিশ সন্ত্রাসীদের ফেরায়নি, আটকও করেনি হত্যার অপরাধে বা সন্ত্রাসের কারণে।
এই সন্ত্রাসীদের টিট করতে শুরু করেছিল বিগত চারদলীয় জোট সরকার। র‌্যাব গঠন করে সেই বাহিনীকে দায়িত্ব দিয়েছিল সন্ত্রাসী দমনে। র‌্যাব সেই দায়িত্ব ভালোভাবেই সূচনা করেছিল রাজধানীর শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আটকে, ক্রসফায়ারে মেরে। কিছু সন্ত্রাসী সীমান্ত পেরিয়ে কলকাতায় আশ্রয় নেয়। তাদের কেউ কেউ এখনো সেই কলকাতায়ই বসবাস করছে। দিন কয়েক আগে সুব্রত বাইন নামের টপ সন্ত্রাসী ধরা পড়েছে সেখানে।
র‌্যাবের সেই সব অপারেশন আমরা দেখেছি। চিহ্নিত ও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ধরে ক্রসফায়ারে পরপারে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। আমরা যাঁরা শৌখিন মানবাধিকার রক্ষার সংগ্রামী, তাঁরা তৎক্ষণাৎ চিৎকার দিয়ে উঠেছিলাম মানবাধিকার হরণ হচ্ছে বলে। বিচারবহির্ভূত হত্যা হচ্ছে। জাতির বিবেকরা যেমন এই সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী দমনে বাধা দিতে থাকলেন, তেমনি আন্তর্জাতিক হিউম্যান রাইটসের প্রতিনিধিরাও এ রকম দমন বা হত্যা বন্ধ করার আহ্বান জানাতে থাকলেন। এভাবে চলতে থাকল। র‌্যাবের সাহসে ভর করে পুলিশও কিছু সন্ত্রাসীকে আটক ও ক্রসফায়ারে দিয়ে সুনাম কামিয়েছিল। সুনামটি ছিল জনগণের তরফ থেকে। সুশীল বা দুঃশীলদের পক্ষ থেকে নয়।
আমরা দেখেছি, প্রথম যখন এক শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ক্রসফায়ারে মারা হলো, তখন সাধারণ মানুষ মিছিল করেছে। আরো শীর্ষ সন্ত্রাসী মারা গেলে এলাকার মানুষজন মিষ্টি বিতরণ করেছে। এ সবই আমরা জেনেছি পত্রিকা পড়ে।
এভাবে দেশ অনেকটাই সন্ত্রাসী ও সন্ত্রাসমুক্ত হয়েছিল। সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারও অব্যাহত রেখেছিল কাজটি। কিন্তু হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার সেই সন্ত্রাস দমন অভিযান বন্ধ করে দিয়ে সন্ত্রাস লালন করতে থাকে। যারা নিয়মিত সংবাদপত্র পড়ে, তাদের মনে আছে নিশ্চয় যে ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি, জুলুম আর সন্ত্রাসী অপকর্মে অতিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী তাদের উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। আবার কবে তিনি তাদের উপদেষ্টার পদে আসীন হয়েছেন তা আমরা জানতেও পারিনি।
৪.
বিশ্বজিৎ কার ছেলে, কার ভাই তা আমরা জানি না। সে হিন্দু, না মুসলমান, সেটাও আমাদের জানার দরকার নেই। সে বিএনপি, ছাত্রলীগ, না আওয়ামী লীগ করত, সেটাও বিবেচ্য নয়। সে এ দেশের একজন নাগরিক ছিল। তার অধিকার ছিল বেঁচে থাকার। তার সেই অধিকার হরণই কেবল করা হয়নি, তাকে না-ফেরার দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে চাপাতির আঘাতে। এই হত্যার দায় এখন সরকারের; যদিও সরকার এই হত্যা করেনি। সরকার তার নিরাপত্তা দিতে পারেনি। বরং সরকার সন্ত্রাসীদেরই নিরাপদ রাখার জন্য সচেষ্ট। পুলিশের চোখে খুনিরা অজ্ঞাত। রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষ থেকে যখন এভাবে খুনিদের আশ্রয় দেওয়া হয়, তখন এটা আমরা বলতেই পারি, সরকারই সন্ত্রাসীদের জন্মদাতা এবং লালনকারী। এই সরকার সাধারণ মানুষের জীবনের কোনো নিরাপত্তা দিতে পারে না। কিন্তু সন্ত্রাসীদের নিরাপদে রাখে। এই ব্যর্থতার দায় কাঁধে নিয়ে সরকারের উচিত গদি ছেড়ে দেওয়া। এর কোনো বিকল্প আমাদের মাথায় আসে না।
সরকারের মাথা যথেষ্ট উর্বর। কেননা মাস্তান, সন্ত্রাসী, পাকিস্তানিদের সহযোগী, পাকিস্তানফেরত স্বৈরশাসক এরশাদ তাদের সঙ্গে আছেন; অতএব...।

লেখক : কবি, সাংবাদিক, যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী

No comments

Powered by Blogger.