মুক্তিযোদ্ধার বাঁচার লড়াই -দেশমাতৃকার জন্য যাঁরা যুদ্ধে নেমেছিলেন তাঁদের অনেকেই আজ লড়ছেন দুবেলা দুমুঠো খাবারের জন্য। তাঁদের জীবনচিত্র নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন-দিনমজুরি করে চলেন শমির উদ্দিন by শামস শামীম

মুক্তিযোদ্ধা শমির উদ্দিনের ঠিকানা বলতে এক কক্ষের মাটির একটি খুপরি ঘর যদিও বসতভিটাটি নিজের নয়, ভাইয়ের। স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে ওই ঘরে গাদাগাদি করে থাকেন। সংসার চালাতে ৬৬ বছর বয়সেও প্রতিদিন শ্রম বিক্রি করেন।
অন্যের ঘরদোর সংস্কারসহ কৃষি শ্রমিকের কাজ করে যা পান, তা দিয়েই সংসার টেনে নিচ্ছেন জমিজমাহীন এই মুক্তিযোদ্ধা। নিভৃতচারী, স্বল্পভাষী ও লাজুক স্বভাবের শমির উদ্দিন নিরন্তর অভাবে তাড়িত হলেও কখনো কারো কাছে মাথা নোয়ান না। একাত্তর তাঁকে শিখিয়েছে মাথা না নোয়াতে।
সদর উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের মোহনপুর গ্রামে শমির উদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, প্রতিদিনের মতো কাজে বেরোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গ্রামেই দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে একটি পরিবারের ঘর বানানোর দায়িত্ব নিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি মাঠে ধান কাটা, ধান লাগানোসহ কৃষি শ্রমিকের কাজও করেন। ওই দিন কাজে যাওয়ার আগে দেখা গেল, পরনে মলিন একটি লুঙ্গি ও ফুটপাত থেকে কেনা একটি জ্যাকেট। তাঁর এক কক্ষের মাটির বসতঘরে কোনো খাট-চৌকি, চেয়ার-টেবিল নেই। বড় দুই মেয়ে ও এক ছেলের বিয়ে দেওয়ার পর ঘরের এক দিকে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন, আরেক দিকে থাকে তিন সন্তান।
ভাইয়ের একখণ্ড ভিটায় মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলেও শমিরের পাঁচ সদস্যের পরিবারের নিয়মিত দুই বেলা খাবার জোটে না। দেশকে হানাদারমুক্ত করতে একদিন হাতে অস্ত্র নিয়ে রণাঙ্গনে অসীম সাহস ও শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। বয়সের কারণে এখন শরীরের শক্তি কমে এসেছে, ভারী কাজ করতে গিয়ে হাত-পা কাঁপে। তাই বলে মনোবল কমেনি। তাই ভিক্ষা কিংবা অনুকম্পার বদলে শ্রম দিয়েই বাকিটা জীবনটা কাটিয়ে দিতে চান শমির। দুই কিশোর ছেলেও এখন শ্রম বিক্রি করে তাঁকে কিছুটা সহযোগিতা করছে। অভাবের কারণে সন্তানদের পড়ালেখা করাতে না পারাটাই শুধু আফসোসের।
শমির উদ্দিন জানান, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ-দেশীয় দোসরদের বর্বোরচিত তাণ্ডব দেখে ২৬ বছর বয়সে মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখানোর জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। প্রতিবেশী মহব্বত আলী ও কালা ময়নাকে সঙ্গে নিয়ে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের তখনকার সভাপতি আরজদ আলীর কাছে গিয়ে অনুরোধ করেন তাঁদের মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিংয়ে পাঠানোর জন্য। আরজদ আলী একটি চিঠি দিয়ে তাঁদের পাঠিয়ে দেন সীমান্তবর্তী বালাটে। সেখানে সুনামগঞ্জের সংগ্রাম কমিটির সংগঠক হোসেন বখত তাঁদের চিনতে পেরে কাছে ডেকে নেন। তিনি ইকো ওয়ানের ৩১ নম্বর ব্যাচে তাঁদের ট্রেনিংয়ে পাঠান। ২১ দিন ট্রেনিং নিয়ে জুন মাসে ৪ নম্বর সেক্টরে সিআর দত্তের অধীনে প্লাটুন কমান্ডার সুবেদার আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে যুদ্ধে নামেন শমির। সাত মাসে তিনি তিনটি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। একটি সম্মুখযুদ্ধের স্মৃতি মনে হলে এখনো কেঁপে ওঠেন। ওই সম্মুখযুদ্ধে তিনজন ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ১৫ জন পাকিস্তানি সেনাকে তাঁরা হত্যা করেন।
শমির উদ্দিন বলেন, গোয়াইনঘাটের কচুয়ারপাড় এলাকায় পাকিস্তানিরা তাঁদের চারদিক থেকে ঘিরে হাতবোমা ও গুলিবর্ষণ শুরু করে। ওই অবস্থায় দিশেহারা হয়ে পড়ে তাঁদের পুরো ইউনিট। এক পর্যায়ে মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তাঁরা। গুলি ও বোমা ছুড়ে সামনে এগোতে থাকেন। মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্বার প্রতিরোধে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে হানাদাররা পিছু হটতে থাকে।
শমির উদ্দিন যুদ্ধশেষে ১৯৭২ সালে সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে যোগ দেন ৩৪৬ টাকা বেতনে। ১৯৮২ সালে স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন। শমির বলেন, 'জীবনে একটাই সান্ত্বনা পাইছি, এইটা অইল স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতারে ধরে রাখন লাগব।'

No comments

Powered by Blogger.