পদ্মা সেতু ॥ দুই আসামি গ্রেফতার, কোর্টে আজ রিমান্ড চাওয়া হবে- পলাতক অন্যদের ধরতে অভিযান চলছে ॥ দুদক

 পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক যাচাই প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম প্রধান দুই আসামি সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোঃ মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (নদী শাসন) কাজী মোঃ ফেরদৌসকে গ্রেফতার করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদক পরিচালক উইং কমান্ডর মোঃ তাহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে সাদা পোশাকে র‌্যাব বুধবার দুপুর দুটার দিকে রাজধানীর গণপূর্ত ভবনের সামনে থেকে তাদের গ্রেফতার করেন। এর আগে দুই আসামি এদিন সকালে ওই মামলায় জামিন নিতে হাইকোর্টে গিয়েছিলেন। কিন্তু অবকাশকালীন হাইকোর্ট বেঞ্চ আবেদনটি শুনানি না করে নিয়মিত বেঞ্চে যাবার কথা বলেন। আজ বৃহস্পতিবার নিম্ন আদালতে নিয়ে তাদের ৭ থেকে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হবে বলে জানান সংস্থাটির কমিশনার মোঃ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু।
পদ্মা সেতু দুর্নীতির ষড়যন্ত্রে দুদকের দায়ের করা মামলায় আরও পাঁচ আসামি পলাতক রয়েছে। তারা হলেন- সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ রিয়াজ আহমেদ জাবের, এসএনসি-লাভালিনের স্থানীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড প্ল্যানিং কনসালটেন্ট লিমিটেডের (ইপিসি) উপ-মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মোস্তফা, কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস, একই প্রতিষ্ঠানের ইন্টান্যাশনাল প্রজেক্ট ডিভিশনের সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল এবং আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ এবং দুদক পরিচালক উইং কামান্ডার তাহিদুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, বাকি আসামিকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
গত ১৭ ডিসেম্বর দুদকের উপ-পরিচালক আবদুল্লাহ আল জাহিদ বাদী হয়ে রাজধানীর বনানী থানায় সাতজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। মামলার পর সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে ওএসডি করা হয় এবং দুদক সাত আসামিকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়। একই সঙ্গে ওই মামলার সন্দেহভাজন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীকে বিশেষ নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
মামলাটির এজাহারে বলা হয়, একে অপরকে আর্থিকভাবে লাভবান করার অসৎ অভিপ্রায়ে অপরাধমূলক অসদাচরণ ও বিধিবিধান ভঙ্গ করে ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রম তারা পরিচালনা করেছে। এর মাধ্যমে পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্মাণকাজে নির্মাণ তদারকি পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যতম দরদাতা এসএনসি-লাভালিন ইন্টারন্যাশনাল ইনকরপোরেটকে কার্যাদেশ পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা তারা করেছে। এই কাজ দ-বিধির ১৬১ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারা অনুযায়ী অপরাধ করার অভিপ্রায়ে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র। এ ধরনের ষড়যন্ত্র দ-বিধির ১২০ (বি) ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আরও বলা হয়, নির্মাণ তদারকি পরামর্শক হিসেবে এসএনসি-লাভালিন কার্যাদেশ পেলে ঘুষ লেনদেন সম্পন্ন হতো।
মামলা করার পরেরদিন থেকেই দুদক আসামিদের গ্রেফতারে বিভিন্ন জায়গা অভিযান অব্যাহত রাখে। এর মধ্যে মামলা দায়েরের একদিন পর গ্রেফতারকৃত দুই আসামি উচ্চ আদালতে জামিনের জন্য আবেদন করেন। ওই আবেদনে বুধবার উচ্চ আদালতে যান তারা। আদালত পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান দুই আসামিকে জামিন দেয়নি। বিচরপতি মোঃ রেজাউল হক ও বিচারপতি মোঃ কাজী ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত অবকাশকালীন হাইকোর্ট বেঞ্চে জামিন আবেদনটি শুনানির জন্য উপস্থাপন করা হলে আবেদনটি শুনানি না করে নিয়মিত বেঞ্চে উপস্থাপন করতে বলে আবেদনটি ফিরিয়ে দেয় আদালত। মোশাররফ ও ফেরদৌসের পক্ষে তাদের আইনজীবী রফিক উল হক গত ১৯ ডিসেম্বর হাইকোর্টে আগাম জামিনের আবেদন জমা দেন। ওই আবেদন বুধবার দুপুরে হাইকোর্টের অবকাশকালীন বেঞ্চে শুনানির জন্য উপস্থাপন করা হয়। এ জন্য সকালেই আদালত প্রাঙ্গণে আসেন দুই জামিন প্রার্থী। এ সময় আদালত জানতে চায়- কি নিয়ে এই আবেদন। জবাবে রফিক উল হক বলেন, এটা পদ্মা সেতুর বিষয়। জবাবে আদালত বলে, এটা ফেরত নিয়ে যান। নিয়মিত বেঞ্চে আবেদন করেন। এরপর আবেদন নিয়ে ফিরে আসেন রফিক উল হক। বের হওয়ার পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, জামিনের জন্য এখন আমরা নিয়মিত বেঞ্চে যাব। আদালত থেকে বের হয়ে গণপূর্ত ভবনের সামনে এলে সাদা পোশাকের র‌্যাব দুদক পরিচালক উইং কমান্ডার মোঃ তাহিদুল ইসলাম তাদের গতিরোধ করেন। নিজেদের পরিচয় দিয়ে তাদের পদ্মা সেতুর দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে জানিয়ে দুদক কার্যালয়ে নিয়ে আসেন। দুদক কার্যালয়ে এনে তাদের সন্ধ্যা সোয়া ছয়টা পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করেন। দুদকের এ সংক্রান্ত তদন্ত টিমের সদস্যরা তাদের প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসবাদ শেষে ধানম-ি থানা হেফাজতে রাখেন। আজ বৃহস্পতিবার তাদের আদালতে নিয়ে ৭ থেকে ১০ দিনের রিমান্ড চাইবেন বলে জানান দুদক কমিশনার সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, মামলার অপর আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা করা হচ্ছে। পদ্মা সেতুর তদন্ত কাজ স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ করতে হলে কানাডায় আদালতে থাকা রমেশের ডায়েরির প্রয়োজন রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, দুদক কানাডার কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের মাধ্যমে এমএলআর পাঠিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কানাডা থেকে কোন জবাব আসেনি। পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া গেলে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী এবং সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে পুনরায় উল্লেখ করেন তিনি। আসামিদের গ্রেফতারের মাধ্যমে তদন্ত কাজ এগিয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান। তিনি বলেন, এটা তদন্তাধীন বিষয় এ বিষয়ে বেশি কথা না বলা ভাল। আবুল হাসান ও সৈয়দ আবুল হোসেন কি দুদকের নজরদারিতে আছেন সাংবাদিকরা এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, সব কিছু আপনাদের বলে দিলে হবে না।
পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২৯০ কোটি ডলার। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক সর্বোচ্চ ১৫০ কোটি ডলার অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যা মোট ব্যয়ের প্রায় ৫২ শতাংশ। এর মধ্যে ১২০ কোটি ডলার ঋণের জন্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রয়োজনে আরও ৩০ কোটি ডলার দেবে বিশ্বব্যাংক এমনটাই কথা ছিল। কিন্তু কানাডীয় কোম্পানি এসএনসি-লাভালিনের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ ওঠার পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে ২৯০ কোটি ডলারের পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি স্থগিত করে বিশ্বব্যাংক। দুদক এরপর তদন্ত শুরু করলেও সরকারের সঙ্গে মতভেদ না কাটায় গত জুন মাসে ঋণচুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক।
এরপর সরকারের নানামুখী তৎপরতায় বিশ্বব্যাংক তাদের সিদ্ধান্ত বদলে পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরে আসার ঘোষণা দেয়। তাদের দেয়া শর্ত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সাবেক প্রসিকিউটর লুই গাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্যানেল দুদকের তদন্ত পর্যবেক্ষণে দুই দফা ঢাকা সফর করে। এই পর্যবেক্ষক প্যানেলের প্রতিবেদনের ওপরই নির্ভর করছে বহু প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু নির্মাণ, যা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি।

No comments

Powered by Blogger.