ফিরে দেখা ২০১২: আন্তর্জাতিক ফুটবল মেসি ও স্পেনের বছর

ভিভ রিচার্ডস বলতেন, বল জিনিসটাই পেটানোর জন্য। লিওনেল মেসির ভিভকে চেনারই কথা নয়। তবে মেসি চাইলে ভিভের কথাটাই একটু ঘুরিয়ে বলতে পারেন, ‘বল জিনিসটাই গোল করার জন্য।’
বলটাকে কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায় পাঠিয়ে আকাশের দিকে তাকানো। দুই হাতের দুই তর্জনী উঁচিয়ে ধরা। মেসির উদ্যাপনভঙ্গি এ রকমই। এভাবেই তিনি প্রতিটি গোল উৎসর্গ করেন স্বর্গবাসী নানিকে। নানির ভাগে অবশ্য ইদানীং টান পড়েছে। ভাগ বসিয়েছে আরেকজন—ছেলে থিয়াগো। দুজনকেই উৎসর্গ করতে হচ্ছে বলেই কি না আগের চেয়ে গোল করার হারও বাড়িয়ে দিয়েছেন মেসি। ২০১২ লিওনেল মেসির সবচেয়ে সুফলা বছর। এই এক বছরে ৯১টি গোল করেছেন এবং সন্তানের বাবা হয়েছেন।
৯১ গোল অবশ্য এক পঞ্জিকাবর্ষে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ড কি না, এটা নিয়ে বিতর্ক আছে। প্রথমে শোনা গিয়েছিল রেকর্ডটা পেলের, ৭৫ গোলের। সেটি ভাঙতেই নতুন দাবি ওঠে জার্ড মুলারের ৮৫ গোল নিয়ে। মেসি সেটাও ভাঙলেন। এরপর দাবি উঠল জিকোর সপক্ষে, ১৯৭২ সালে এই ব্রাজিলিয়ান নাকি করেছিলেন ৮৯ গোল। সেই রেকর্ড ভেঙেও মেসি স্বস্তিতে থাকতে পারলেন না। জাম্বিয়ার এক অখ্যাত খেলোয়াড় গডফ্রে চিতালু উঠে এলেন আলোয়। এক বছরে নাকি ১০৭টি গোল করেছিলেন জাম্বিয়ার প্রয়াত স্ট্রাইকার। এটাকেই রেকর্ড বলে ফিফার কাছে দাবি জানাল জাম্বিয়ান ফুটবল সংস্থা। ফিফা জানিয়ে দিল, পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে কোনো রেকর্ডকেই স্বীকৃতি দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
বছরটা ব্যক্তি হিসেবে তর্কাতীতভাবেই মেসির। তবে তাঁর দল বার্সেলোনার জন্য ছিল অম্লমধুর। ‘অম্ল’, কারণ বার্সার টানা তিন মৌসুমের আধিপত্য খর্ব করে এ বছরই রিয়াল মাদ্রিদকে লিগ শিরোপা জিতিয়েছেন হোসে মরিনহো। আবার ‘মধুর’ও, কারণ পেপ গার্দিওলার উত্তরসূরি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর বছরের দ্বিতীয় ভাগে বার্সাকে আরও অপরাজেয় একটা দল বানিয়েছেন টিটো ভিলানোভা। নতুন মৌসুমে লিগের ১৭ ম্যাচের ১৬টিই জিতিয়েছেন। ক্লাব ফুটবল দুই বছরের আধাআধি ভাগে হয়। কিন্তু বার্সা নাকি এই বছরেই লিগ শিরোপা নিশ্চিত করে ফেলল! চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়ালের চেয়ে ১৬ পয়েন্টে এগিয়ে, নিকটতম অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের চেয়ে এগিয়ে ৯ পয়েন্টে। বার্সা শিরোপা না জিতলে সেটাই হবে বিস্ময়ের।
বিস্ময় রিয়ালের এভাবে হোঁচট খাওয়াটাও। আগেরবার পুরো লিগে রিয়াল দুটি ম্যাচ হেরেছিল, ড্র করেছিল চারটি। এবার মাঝপথ না পেরোতেই চার পরাজয় আর তিন ড্র। বার্সার জন্য যদি বছরটা অম্ল থেকে মধুর হয়ে যায়, রিয়ালের জন্য হয়েছে মধুর থেকে অম্ল। চেলসির জন্য অবশ্য অভিজ্ঞতাটা আরও ঝাঁজাল। এ বছরই পরম আরাধ্য চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফিটা জিতেছে চেলসি। কিন্তু সেই সুখস্বপ্নের মেয়াদ সাত মাসও স্থায়ী হয়নি। চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে প্রথম দল হিসেবে গ্রুপ পর্বেই বাদ বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা!
ক্লাব ফুটবলে মেসির গোলের মতোই আন্তর্জাতিক ফুটবলে নিয়মিত দৃশ্য হয়ে উঠেছে স্পেনের সাফল্য। ইতালিকে ফাইনালে ৪-০ গোলে গুঁড়িয়ে দিয়ে ইউরো জিতেছে স্পেন। এই জয় স্পেনের সোনালি প্রজন্মের এই দলকে অমরত্বও দিয়েছে ইতিহাসে। ইউরো-বিশ্বকাপ-ইউরো—এই শিরোপাত্রয়ী জেতেনি আর কেউই। ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষস্থানটাও আরও সংহত স্পেনের। প্রথমবারের মতো সেরা দশের বাইরে ছিটকে যাওয়া ব্রাজিল ঝুঁকিতে আছে সেরা বিশেরই বাইরে চলে যাওয়ার। পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের বর্তমানে র‌্যাঙ্কিং ১৮। ওদিকে আফ্রিকান নেশনস কাপে রূপকথার জন্ম দিয়েছে চিতালুর দেশ জাম্বিয়া। প্রথমবারের মতো অর্জন করেছে মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্ব।
বছরটাকে শোকার্ত করে তুলেছে মিসরের লিগ ম্যাচে হাঙ্গামায় ৭০ জনেরও বেশি দর্শকের মৃত্যু। ইউরোপের ফুটবলে নতুন করে দেখা দিয়েছে বর্ণবাদের কালো ছায়া। একটা সুখবরও আছে। ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপে প্রথম পরীক্ষা করা হয়েছে গোললাইন-প্রযুক্তি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে ২০১২ মেসি এবং স্পেনেরই বছর! রয়টার্স।

No comments

Powered by Blogger.