স্কাইপে সংলাপ হ্যাকিং, রি-ট্রায়ালের আবেদন পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র- শুরু থেকেই জামায়াত যুদ্ধাপরাধ বিচার বিলম্বিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে by আরাফাত মুন্না

 একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলা যখন রায়ের অপেক্ষায়, ঠিক সেই মুহূর্তে আসামি পক্ষ থেকে রি-ট্রায়ালের (পুনর্বিচার) আবেদন করাকে সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছেন আইনজ্ঞরা।
তাঁরা বলেছেন, বিচারপতির স্কাইপে সংলাপ হ্যাকিং থেকে শুরু করে রি-ট্রায়ালের আবেদন সম্পূর্ণ পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। এর মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের বিচার কাজকে ব্যাহত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আইনজ্ঞরা আরও বলেছেন, জামায়াত ইসলামী প্রথম থেকেই যুদ্ধাপরাধের বিচার কাজ ব্যাহত করতে প্রকাশ্যে সভা, সমাবেশসহ সকল প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে, ফলে বিচার কাজের শুরুতেই বিচারপতিকে বিতর্কিত করা, বিচারপতির স্কাইপি সংলাপ হ্যাকিং করা, রি-ট্রায়ালের আবেদন করা সব একই সূত্রে গাথা বলে প্রতীয়মাণ হচ্ছে। আইনজ্ঞদের ধারণা বিচার কাজ পুনরায় শুরু হলে এ বিচার শেষ করতে আবার একই সময় লাগবে। এর ফলে সরকারের বর্তমান মেয়াদে বিচার কাজ শেষ করা সম্ভব নয়। এছাড়া রি-ট্রায়াল বা পুনর্বিচারের কোন বিধান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ্যাক্টে নেই। আসামি পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে তাতেও এ বিষয়ে আইনের কোন বিধান উল্লেখ করা হয়নি। তাই এ আবেদন সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।
সূত্র মতে, একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী নানা অপরাধের বিচারে ২০১০ সালের মার্চ মাসে গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর পরই এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে হাইকোর্টে রিট আবেদন দায়ের করা হয়। ট্রাইব্যুনালে বিচারক নিয়োগ, ট্রাইব্যুনাল আইন ও ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে জামায়াত নেতাদের পক্ষে পৃথক তিনটি রিট আবেদন দায়ের করা হয়। আবেদনে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেফতারের প্রক্রিয়া আইনগতভাবে সঠিক হয়নি উল্লেখ করে তা বাতিল চাওয়া হয়। আবেদনে বলা হয়, কোন অভিযোগ গঠন না করেই বেআইনীভাবে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। ওই বছরই শুনানির শেষে এসব আবেদন খারিজ করে দেয় হাইকোর্ট।
এর পরও বিচারপতি নিজামুল হকের প্রত্যাহার চেয়ে ট্রাইব্যুনালেই একাধিক আবেদন করে আসামিপক্ষ। তাদের আবেদনের মূল কথা, বিচারপতি নিজামুল হক আইনজীবী থাকাকালে গণতদন্ত কমিশনের সচিবালয়ের সদস্য ছিলেন। গণ-আদালতের বিচারের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। তাই ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে তিনি নিরপেক্ষ নন। তিনি একটি পক্ষ। বিচারপতি নিজামুল হকের অনুপস্থিতিতে ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই বিচারক আদেশ দিলেও আসামিপক্ষ থেকে নতুন করে আবেদন করা হয়। বিচারপতি নিজামুল হককে শেষ পর্যন্ত আদেশ দিতে হয়। এসব আবেদনের ওপর কয়েক দিন শুনানি হয়। যদিও উভয় আদেশেই আবেদন খারিজ করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, ওই সময় থেকেই বিচারপতি নিজামুল হককে তার পদ থেকে সরানোর ছক তৈরি করে জামায়াত।
সর্বশেষ দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলায় উভয় পক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ, জেরা ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করে যখন আদেশের অপেক্ষায় ঠিক ওই সময়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপি সংলাপ হ্যাক করে তা প্রচার করে বিচারপতি নিজামুল হককে বিতর্কিত করা হয়। এর ফলে ট্রাইব্যুনাল-১-এর প্রধানের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান নিজামুল হক। পরে তার পদত্যাগ ও ট্রাইব্যুনাল-১-এ নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের যোগদানকে কেন্দ্র করে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আটক তিন আসামি স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম, জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী ও জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী মামলার কার্যক্রম রি-ট্রায়ালের আবেদন করেছে আসামিপক্ষ।
ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১৪ জুলাই সাঈদীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয়া হয়। ৭ ডিসেম্বর থেকে সাঈদীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের পক্ষে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীসহ তদন্ত কর্মকর্তার (আইও) জবানবন্দী ও অভিযুক্তদের পক্ষে সাফাই সাক্ষীদের জবানবন্দী ও জেরা শেষ হয়। এরপর ঠিক এক বছরের মাথায় চলতি বছরের ৬ ডিসেম্বর উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপনও সমাপ্ত হয়। ওই দিন নির্দিষ্টভাবে রায় দেয়ার দিন ধার্য না করে যে কোন দিন রায় দেয়া হবে বলে আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। তারপর থেকে উঠে আসে বিচারপতির স্কাইপি বিতর্ক। এক পর্যায়ে বিচারপতি লন্ডনের বিখ্যাত সংবাদপত্র ‘দ্য ইকোনমিস্ট’-এর বিরুদ্ধে রুল দেন ও হ্যাক করা কথোপকথন প্রকাশ না করার নির্দেশ দেন। কিন্তু বিদেশী সূত্র থেকে পেয়েছে উল্লেখ করে স্কাইপির এই কথোপকথন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে দৈনিক ‘আমার দেশ’ পত্রিকা। এক পর্যায়ে বিতর্কের মুখে গত ১১ ডিসেম্বর চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দেন বিচারপতি নিজামুল হক। তার পর বিচারকাজ বিঘিœত করতে জামায়াত নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করে। এর অংশ হিসেবে জামায়াতের তিন শীর্ষ নেতার বিচার কাজ পুনরায় করার জন্য আবেদন করে তারা। এদিকে সাঈদীর মামলা প্রায় দীর্ঘ এক বছরে সাঈদীর বিরুদ্ধে তালিকাভুক্ত মোট ২০ প্রত্যক্ষদর্শী এবং জব্দ তালিকা থেকে আরও ৯ জন মিলিয়ে ২৭ জন মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ (আইও) মোট ২৮ সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। বাকি আরও ৪৬ সাক্ষীর মধ্যে প্রসিকিউশনের আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৬ সাক্ষীর তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেয়া জবানবন্দীকে তাদের অনুপস্থিতিতে সাক্ষ্য হিসেবে আমলে নিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। অপর দিকে সাফাই সাক্ষী হিসেবে সাঈদীর পক্ষে ১৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। প্রসিকিউশন সাফাই সাক্ষীদের জেরা করেছে।
আইনজ্ঞদের ধারণা, বিচারকাজ পুনরায় শুরু হলে এ বিচার শেষ করতে আবার একই সময় লাগবে এর ফলে সরকারের বর্তমান মেয়াদে বিচারকাজ শেষ করা সম্ভব নয়। এছাড়া রি-ট্রায়াল বা পুনর্বিচারের কোন বিধান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ্যাক্টে নেই। তারা যে আবেদন করেছে তাতেও এ বিষয়ে আইনের কোন বিধান উল্লেখ করেনি। তাই এ আবেদন সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।
এ বিষয়ে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক এ্যাডভোকেট মমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদী জনকণ্ঠকে বলেন, ট্রাইব্যুনালে আসামি পক্ষ রি-ট্রায়ালের যে আবেদন করেছে তা যুদ্ধাপরাধের বিচারকে ব্যাহত করার ষড়যন্ত্রের একটি অংশ। তারা যে আবেদন করেছে সে ধরনের কোন বিধান যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে নেই। শুধু ট্রাইব্যুনাল এ্যাক্ট নয়, কোন আইনেই তা নেই।
এ বিষয়ে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক এ্যাডভোকেট শ ম রেজাউশ করিম জনকণ্ঠকে বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ্যাক্ট-১৯৭৩-এ মূল আইন এবং বিধিতে রি-ট্রায়াল বা পুনর্বিচার অনুষ্ঠানের কোন বিধান নেই। যেহেতু এ আইনটি একটি বিশেষ আইনের ফলে আইনের আওতায় রি-ট্রায়ালের কোন বিধান না থাকায় খোদ ট্রাইব্যুনালও আইনের পরিপন্থী কোনরূপ সিদ্ধান্ত নিতে এখতিয়ার সম্পন্ন নয়।
তিনি বলেন, আসামিদের আবেদন অবশ্যই সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধির আওতায় হতে হবে। সেই বিবেচনায় পুনর্বিচার অনুষ্ঠানের আবেদন আইনের কোন্ ধারা বা বিধিতে করা হয়েছে তা উল্লেখ করা অনিবার্য ছিল। কিন্তু আসামি পক্ষের আবেদনে এ ধরনের কোন ধারা বা বিধি না থাকায় এ আবেদন গ্রহণযোগ্য নয়।
তিনি আরও বলেন, প্রথম থেকেই এ বিচারকাজ ব্যাহত করতে প্রকাশ্যে সভা, সমাবেশসহ সকল প্রকার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়েছে। ফলে বিচারকাজের শুরুতে বিচারপতিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করা, বিচারপতির স্কাইপি সংলাপ হ্যাকিং করা এবং পুনর্বিচারের আবেদন করা একইসূত্রে গাথা বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক জনকণ্ঠকে বলেন, ট্রাইব্যুনাল আইনের রুলস অব প্রসিডিউরের ৪৬ (এ) তে বলা আছে, ন্যায়বিচারের স্বার্থে আদালত যে কোন আদেশ দিতে পারে। তিনি বলেন, এখানে যেহেতু ট্রাইব্যুনা-১-এর চেয়ারম্যান বিচার সংক্রান্ত বিষয়ে প্রসিকিউটরদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং সে বিষয় আবার স্কাইপি সংলাপের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালে বাইরের একজন ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা করেছেন তার সঙ্গে পরামর্শ করেছেন তাই আমরা মনে করি এখানে ন্যায়বিচার লঙ্ঘিত হয়েছে। জনকণ্ঠের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনাল আইনে সরাসরি রি-ট্রায়ালের বিষয়ে কোন ধারা নেই।
উল্লেখ্য, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে ২০১০ সালের মার্চ মাসে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর ও বিচারপতি জহির আহমদকে নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এরপর ২০১২ সালের মার্চ মাসে বিচারপতি ফজলে কবীরকে চেয়ারম্যান করে গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।

No comments

Powered by Blogger.