আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বকে জামায়াত যা বোঝাতে চায় সে সম্পর্কে কিছু কথা- স্বদেশ রায়

বাংলাদেশের জঙ্গী নিয়ে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে পৃথিবীর নানান দেশে অনেক গবেষণা হচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে যেমন গবেষণা হচ্ছে, তেমনি গবেষণা হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পূর্ব এশিয়াতেও।
এদেরই এক গবেষকের সঙ্গে সম্প্রতি আলোচনায় তিনি বলছিলেন, দেখ তোমাদের দেশে আমেরিকান এ্যাম্বাসির অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামী নেতাদের উপস্থিতি বড় বেশি চোখে পড়ে। অথচ গোটা পৃথিবীতে এ মুহূর্তে জঙ্গীদের বিরুদ্ধে আমেরিকার মতো সরব অন্য কোন দেশ নয়। এবং আমেরিকার মতো কঠোর অবস্থান জঙ্গীদের বিরুদ্ধে নিতে পারছে খুব কম দেশ। আমি তাকে বলি, দেখ তুমি শুধু আমেরিকান এ্যাম্বাসির কথা বলছো কেন, পশ্চিমা সকল দেশ শুধু নয়, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত যারা বাংলাদেশের ভিতর বেড়ে ওঠা জঙ্গীদের শিকার হয়েছে একের পর এক তাদের এ্যাম্বাসির অনুষ্ঠানেও জামায়াতে ইসলামীকে দেখতে পাবে তুমি।
ওই গবেষক এরপর আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমার ধারণা কি? কেন পশ্চিমা দেশ থেকে শুরু করে ভারত অবধি এ কাজ করে? আমি বিনয়ের সঙ্গে বলি, তুমি গবেষক, তুমি তাদের কাছে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারো। আর আমাকে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে, তাদের মনোভাব যতটুকু আমরা বিভিন্ন সময়ে বুঝতে পারি ও নিজের বিশ্লেষণ থেকে। তিনি আমার কাছে সেই উত্তরই চাইলেন। তাকে বলি, দেখ আমার যা মনে হয়, আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলো যতটা না মনে করে, তার থেকে জামায়াতে ইসলামী তাদের এই ধারণা দিতে সমর্থ হয়েছে যে, জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনী রাজনীতিতে থাকার ফলে বাংলাদেশে ইসলামী মৌলবাদী জঙ্গী সৃষ্টি কম হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামী সফল হচ্ছে, যারা ইসলামের নামে রাজনীতি করে তাদের নিয়মতান্ত্রিক বা নির্বাচনী রাজনীতিতে আনতে। যদি জামায়াতে ইসলামীকে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়া হয় তাহলে জেএমবি, হুজির মতো জঙ্গী সংগঠনগুলো বেড়ে উঠবে দ্রুত। এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। জামায়াতে ইসলামীর এই যুক্তির অন্তঃসার যাই থাকুক না কেন, আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলো কেন যেন এর কিছুটা বিশ্বাস করে। এবং তারা মনে করে জামায়াতে ইসলামী নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে থাকলে তাদের পক্ষে বাংলাদেশে জঙ্গী নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে। অন্যদিকে ভারতের বিষয়টি আমার কাছে একটু ভিন্ন মনে হয়। তাদের মানসিক সমর্থন যেখানেই থাকুক না কেন, ১৯৭৫ সালের পর থেকে তাদের আচরণ দেখলে মনে হয়, তাদের ধারণা বাংলাদেশে কখন কী ঘটবে সেটা ধারণা করা সম্ভব নয়। তারপরও বাংলাদেশ তাদের প্রতিবেশী। তাদের বড় মার্কেট। বাংলাদেশও তাদের ছাড়া চলতে পারবে না। তাই সবখানেই দরজা না হোক একটা জানালা তারা রাখতে চায়। যেমন, সম্প্রতি বেগম জিয়াকে তারা ভারতে অনেক সম্মান দিয়েছে। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, তারা শতভাগ নিশ্চিত যে বেগম জিয়া আগামীতে ক্ষমতায় আসছেন। বরং তাদের ভেতর অনেকেই আছেন, যারা মনে করেন, বেগম জিয়ার রাজনীতি এখন ক্ষয়িষ্ণু দালানের মতো। এটা একটি অতীতের ঢিবি হওয়া সময়ের বিষয় মাত্র। তারপরও তারা মনে করে, যেহেতু বাংলাদেশ শেখ মুজিবকেও হত্যা করেছে। তাই বাংলাদেশ নিয়ে স্থির কোন সিদ্ধান্তে না গিয়ে সবখানে একটা জানালা রাখি। এই জানালা রাখতে গিয়ে বা ছোট একটা দরজা রাখতে গিয়ে তাদের অবস্থা কী হয় সেটা তারা যাই বুঝুক না কেন, বাস্তবতা হিসেব করলে তাদের লোকসানই হয়। কারণ, বাংলাদেশে বেগম জিয়ার সরকার রেখে তারা যে ব্যবসা এখানে করবে তার থেকে দশ গুণ অর্থ তখন তাদের ব্যয় করতে হবে তাদের উত্তর-পূর্ব ভারতের জঙ্গীবাদ ঠেকাতে। কারণ, বেগম জিয়া পুরো সামরিক ও বেসমারিক প্রশাসন দিয়ে ওই জঙ্গীবাদকে সমর্থন করে যাবে। বেগম জিয়া ক্ষমতায় থাকা মানে পাকিস্তানী ইন্টেলিজেন্স আইএসআইয়ের অবাধ বিচরণ ভূমি বাংলাদেশ। এর পরিণামে দিল্লীর পার্লামেন্টে হামলাতে, পুরুলিয়ায় অস্ত্র ফেলাতে বাংলাদেশের অনেক কিছুই ব্যবহৃত হবে। যাই হোক, তার পরে সেটা ভারতের নিজস্ব বিষয়। ভারতের নীতি সম্পর্কে এ কথা বলার পরে ভদ্রলোক আমার কাছে জানতে চান, সম্প্রতি ভারতীয় কিছু গবেষক ও পূর্ব এশিয়া ও ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলভিত্তিক সন্ত্রাসবাদের ওপর কয়েকটি বই বেরিয়েছে সেগুলো আমি পড়েছি কি না? তাকে বলি, সবগুলো পড়া শেষ হয়নি। গোটা তিনেকের মতো পড়েছি। তিনি বললেন, তারও ওই বইগুলো পড়ে মনে হচ্ছে, ভারতের বাংলাদেশ নীতি নিয়ে আমি যেমনটি ভাবছি অন্তত জঙ্গী বিষয়ে তাদের ভাবনার ভেতর এই বিষয়গুলো রয়ে গেছে।
যাই হোক, তিনি ভারত প্রসঙ্গে আর বেশি না এগিয়ে আমার মতামত জানতে চান যে, আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোকে জামায়াতে ইসলামী যে কথা বোঝাতে সমর্থ হয়েছে বলে অনেকে মনে করে এই কথাটা কতটা সঠিক বলে আমি মনে করি? আমি তাকে বলি দেখ, আমেরিকা বা পশ্চিমা অন্যান্য দেশ জামায়াত সম্পর্কে ঠিক অমনটি মনে করে কি না এটা তো আমি শতভাগ নিশ্চিত নই। এটা একটি ধারণা মাত্র। এমনকি তোমারও ধারণা এটা। তিনি তখন আমার কথার সঙ্গে আরও একটি তথ্য যোগ করলেন দেখ, এ ধারণা করার আরও অনেক উপাদান আছে। কারণ, আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টেও জামায়াত নেতারা যায়। তাছাড়া ভারতের সাম্প্রদায়িক ও নরহত্যাকারী নেতা নরেদ্র মোদিকে যখন আমেরিকা ভিসা দেয় না তখন আমেরিকা বা ব্রিটেন কীভাবে জামায়াত নেতা সাঈদী, গোলাম আযম, নিজামী এদের ভিসা দেয়? তিনি বেশ জোরের সঙ্গে বললেন, এসব উপাদানগুলোকে তুমি অস্বীকার করতে পারো না।
তখন আমি তাকে বলি, দেখ আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলো যদি জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে এমন ধারণা করে তাহলে সেটা তারা শতভাগ ভুল করছে। এমনকি তারা তাদের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করতেও অনেকটা ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ, মোটা দাগে আমাদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অবধি যখন এ দেশে ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল তখন কিন্তু এখানে জামায়াতে ইসলামী গোপন সংগঠন হিসেবে ওইভাবে কোন তৎপরতা চালাতে পারেনি। সিরাজ সিকদারের দলের ভেতর ঢুকে, জাসদের ভেতর ঢুকে তারা কিছু সন্ত্রাসী কর্মকা-ে সহায়তা করে তখন। কিন্তু সেটাও ছিল সামান্য। এবং ক্রমে সেটা কমে যেত। জামায়াতে ইসলামীর ও জঙ্গী মৌলবাদী রাজনৈতিক দলের উত্থান বাংলাদেশে ঘটেছে কিন্তু রাষ্ট্র ক্ষমতার প্রশ্রয়ে। এর শুরু হয় জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পরে যখন পুরোপুরি ভাবে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাকে মৌলবাদী রাজনীতির উত্থানের কাজে লাগানো হয়। এবং আইএসআই নির্বিঘেœ বাংলাদেশে বসে তাদের কাজ করার সুযোগ পায়। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের আগে বাংলাদেশে একটিও মৌলবাদী রাজনৈতিক দল ছিল না। কিন্তু জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার দুই বছর না যেতেই বাংলাদেশে ইসলামী মৌলবাদী দলের সংখ্যা হয় ৭৯টি। এবং এর সবই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এবং সামরিক ও বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রশাসনের অন্যান্য অংশের পরিচর্যার ফলে। এবং এই ধারাবাহিকতা পুরো এরশাদ আমলে ছিল। বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসক জিয়ার পথ অনুসরণ করে এরশাদও জামায়াতে ইসলামীসহ সব জঙ্গী সংগঠনকে লালন করে গেছেন। যার ফলে শক্তি সঞ্চয় করেছে জামায়াতে ইসলামী। এবং এই যে ৭৯টি ইসলামী মৌলবাদী দল এদেরও ডালপালা গজিয়ে ১৩০-এর কাছাকাছি চলে যায়। এদের অনেকের সঙ্গেই সরাসরি যোগ রয়েছে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনগুলোর। এরাই কিন্তু লোক রিক্রুট করে তালেবান হবার জন্য আফগানিস্তানে পাঠিয়েছে। এবং সেই আফগান ফেরত ট্রেনিং নেয়া তালেবানরা এখন বিভিন্ন নামে করা জামায়াতে ইসলামীর এই জঙ্গী সংগঠনে কাজ করছে।
বিস্তৃত ইতিহাসে না গিয়ে সংক্ষেপেই বলা যায়, এর পরে নির্বাচনের রাজনীতির ভেতর দিয়ে ২০০১-এ জামায়াতকে ক্ষমতার অংশ করা হয়। ২০০১-এর নির্বাচনটি ষড়যন্ত্র। ওই ষড়যন্ত্রের পেছনে তখন অনেকেই ছিল। তাদের ভেতর অনেকের ধারণা ছিল, নির্বাচনের ভেতর দিয়ে ভাল শক্তি নিয়ে যদি জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় আসে তাহলে তারা পুরোপুরি ডানপন্থী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলে পরিণত হবে। তারা জঙ্গীবাদ থেকে সরে আসবে।
কিন্তু ২০০১ থেকে ২০০৬ অবধি জামায়াতে ইসলামী যখন বিএনপির সঙ্গে ক্ষমতায় ছিল তখন এ দেশের কী ঘটেছিল? তখন কি অবৈধ বা গোপন ইসলামী জঙ্গী সংগঠনের সংখ্যা বেড়েছিল না কমেছিল? তখন কি ভারতীয় জঙ্গী সংগঠনগুলোর জন্য বাংলাদেশ অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল না বাংলাদেশ তাদের কাছে নিষিদ্ধ ভূমি ছিল? তখন কি পাকিস্তানী জঙ্গী সংগঠন, ভারতের জঙ্গী লর্ড দাউদ ইব্রাহিমের লোকজন ও লাদেনের লোকজনের জন্য বাংলাদেশ অবাধ বিচরণ ছিল না নিষিদ্ধ ভূমি ছিল? ২০০১ থেকে ২০০৬ অবধি বাংলাদেশে যে জঙ্গী কর্মকা- ঘটেছিল তার বিবরণ বলতে গেলে কয়েক ঘণ্টার বিষয়। তার পরেও সংক্ষেপে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। ওই সময়ে ভারতের কলকাতস্থ মার্কিন কনসুলার অফিসে জঙ্গী হামলা হয়। ওই জঙ্গী হামলার সঙ্গে বাংলাদেশে তৈরি হওয়া জঙ্গী জড়িত ছিল। তাদের একটা অংশ বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় প্রবেশ করেছিল। ওই সময়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূত আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা হয়েছিল। ওই গ্রেনেড হামালায় যারা জড়িত তারা সবাই যেমন একদিকে জেএমবি ও হুজির সদস্য, অন্যদিকে তারা জামায়াতে ইসলামীর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন ও মজলিসে সূরার মেম্বার। এবং ওই হামলাকারীরা তৎকালীন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সহযোগিতা পায়।
ওই সময়ে দেশের উত্তরাঞ্চলের একটি অংশ পুরোপুরি জঙ্গী নেতা বাংলাভাইয়ের এক ধরনের তালেবানী শাসনের অধীনে চলে যায়। সেখানে মূলত বাংলাভাইয়ের নিয়ন্ত্রণের এক ধরনের প্যারালাল তালেবানী প্রশাসন গড়ে ওঠে। এই বাংলাভাই বা তার সহযোগী নেতারা অনেকেই জামায়াতে ইসলামীর মজলিশে সূরার মেম্বার। তাই জামায়াত বিদেশীদের কাছে যাই দেখাক না কেন, বাস্তবে বাংলাভাইয়ের জেএমবি জামায়াতেরই একটি আন্ডারগ্রাউন্ড সংগঠন। এবং ওই সময়ে উত্তরবঙ্গের প্রশাসনে যারা সৎ ব্যক্তি ছিলেন, তারা সকলেই বলবেন, বাংলাভাই সেখানে গড়ে উঠতে পেরেছিল মূলত সরকারের সহায়তায়। এরপরে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল অবধি জামায়াত-বিএনপি শাসন আমলে বাংলাদেশের প্রচলিত আধুনিক বিচার ব্যবস্থাকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে মৌলবাদী তালেবানী বা ইরানী স্টাইলের বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য। এবং এই বিচার ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে যারা তারা আদালতে বোমা মেরে বিচারক হত্যা করেছে। আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায় আদালতে। যারা এসব কাজ করে তাদের সবারই সঙ্গে রয়েছে জামায়াতের যোগাযোগ। এবং এগুলো সেদিন প্রশাসনের সহায়তায় করা হয়েছিল। এ ছাড়া সেদিন বাংলাদেশকে একটি তালেবানী রাষ্ট্র বানানোর জন্য তারা শক্তি প্রদর্শন হিসেবে বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় এক ঘণ্টার মধ্যে ৫২৭ জায়গায় বোমা ফাটায়। সেদিন এই বোমা ফাটানোর কাজেও ব্যবহৃত হয়েছিল রাষ্ট্রীয় প্রশাসন। এছাড়া ওই সময়ে ভারতের জঙ্গী সংগঠন উলফাকে সহযোগিতা করার জন্য চট্টগ্রামে দশ ট্রাক অস্ত্র নামানো হয়েছিল। যে অস্ত্র নামানোর কাজে সরাসরি জড়িত ছিল জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা যারা সেদিন সরকারের মন্ত্রী ছিল। যত দূর জানা যায়, আইএসআইয়ের তত্ত্ববাধায়নে চীন থেকে ওই অস্ত্র কেনা হয়েছিল। এবং বাংলাদেশে নামানোর কাজে সেদিন যে পুরো সামরিক ও বেসামরিক গোয়েন্দা বিভাগকে ব্যবহার করা হয়েছিল সে সব সত্য এখন বিচারের সময় বের হয়ে আসছে। এছাড়া ওই সময়ে ঘটানো হয়েছিল ভয়াবহ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা। যে হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। এখন বিচারের মাধ্যমে বের হয়ে আসছে সে হত্যাকা-ের পরিচালনা ও পরিকল্পনায় যারা জড়িত ছিল তারা মূলত জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক। তারা বেনামে অন্য সংগঠনে আছে এবং বিএনপিতে আছে। তাছাড়া জামায়াতে তো রয়েছেই।
এর থেকে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনী বা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে শুধু নয়, রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশ করলেও জামায়াতে ইসলামী মূলত তাদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে যায়। এবং তাদের ইতিহাস বলছে তারা বাংলাদেশে ধীরে ধীরে যে শক্তিশালী হয়েছে এটা মূলত সরকারের সহায়তায়। বরং যখনই তাদের নিষিদ্ধ করা হয়েছে বা সরকার তাদের বিপক্ষে গেছে তখন আর তারা বাড়তে পারেনি। যেমন স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পূর্ব অবধি যখন জামায়াত নিষিদ্ধ ছিল। ওই সময়ে কিন্তু জামায়াত বাড়তে পারেনি। জন্ম ঘটেনি বাংলাদেশে কোন মৌলবাদী জঙ্গী সংগঠনের। এরপর থেকে বাংলাদেশে তাদের যে বৃদ্ধি এটা মূলত সরকারের সহায়তায়, সরকারী প্রশাসনের সহায়তায় ঘটেছে। আবার এ মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের নীতি জঙ্গীবিরোধী তাই বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী গত চার বছরে ওইভাবে কোন জঙ্গী তৎপরতা চালাতে পারেনি। এবং যারা বলতে চান জামায়াতে ইসলামীকে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে রাখলে দেশে জঙ্গী-মৌলবাদ কমবে, তাদের ধারণা যে শতভাগ ভুল সেটা তারা ২০০১ থেকে ২০০৬ এবং ২০০৮ থেকে আজ অবধি তুলনা করলে বুঝতে পারবেন। তারা শুধু তথ্য পর্যালোচনা করলে ২০০১ থেকে ২০০৬ অবধি বাংলাদেশে কত জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটেছিল এবং সে সময়ে এ দেশ আর্ন্তজাতিক জঙ্গীদের জন্য কতটা অবাধ ভূমি ছিল, এর বিপরীতে এখন কী চিত্র দেখা যাচ্ছে? যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা জেলে থাকার ফলে এবং বর্তমানের উদার ও গণতান্ত্রিক সরকার কোন রূপ জঙ্গীবাদকে সমর্থন না করার নীতিতে বিশ্বাসী হবার ফলে গত চার বছরে বাংলাদেশে কোন জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটেনি। এ ছাড়া গত চার বছরে বাংলাদেশে কোন আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনের কোন নেতা প্রবেশ করতে পেরেছে এমন ঘটনাও ঘটেনি। তার বিপরীতে দেশী ও বিদেশী অনেক জঙ্গী বর্তমান সরকার গ্রেফতার করেছে, পুশব্যাক করেছে এবং বিচার করছে।
তাই আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলো যদি এমন ধারণা করে থাকে যে, জামায়াতকে নির্বাচনী রাজনীতিতে রাখলে এ দেশে ইসলামী জঙ্গীবাদ কম থাকবে সেটা তাদের ভুল ধারণা। বরং এটাই সত্য জামায়াতকে যতদিন টিকিয়ে রাখা হবে ততদিন ইসলামী জঙ্গীবাদ বাংলাদেশে টিকে থাকবে। তাই বাংলাদেশকে জঙ্গী মুক্ত করতে হলে উদার গণতান্ত্রিক শক্তির বৃদ্ধির সহায়ক হতে হবে। অবশ্য পশ্চিমা বিশ্ব একটি বিষয় মনে করে যে, কোন মুসলমান অধ্যুষিত দেশ থেকে কোনক্রমেই উদার গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে সম্পূর্ণ মৌলবাদ নিশ্চিহ্ন করা যাবে না। তাদের এই ধারণা অন্যান্য মুসলিম অধ্যুষ্যিত দেশের জন্য এমনকি এই উপমহাদেশের পাকিস্তানের জন্যও ঠিক হতে পারে। তবে বাংলাদেশের জন্য ঠিক নয়। তারা যদি অন্যান্য মুসলিম অধ্যুষিত দেশের সঙ্গে বাঙালী মুসলমানকে এক করে দেখে তাহলে তারা ভুল করছেন। কারণ, বাঙালী মুসলিম মূলত সহজিয়া। এটা লালনের দেশ, এটা একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরির দেশ। এখানে ফুলে ফুলে ঢেকে যায় সমাধিস্থল। বাঙালী মুসলিমের মানসিক গঠন ও তার হাজার বছরের ইতিহাসের ভেতর রয়ে গেছে ভিন্ন উপাদান যা কোন কট্টর পন্থা দিয়ে আটকানো যায় না। বরং সত্য হলো, এখানে জামায়াতে ইসলামীর মতো সংগঠনগুলো মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠনের টাকায়, পাকিস্তান আইএসআইয়ের টাকায় এখানে কিছু মানুষের দারিদ্র্যর সুযোগ নিয়ে তাদের মৌলবাদী বানাচ্ছে। এবং কিছু তরুণকে বিভ্রান্ত করছে।
ওই গবেষক বন্ধুটিকে এ ধরনের উত্তর দেবার পরে তিনি আমাকে প্রশ্ন করেন, তাহলে তোমার দেশের সিভিল সোসাইটির সদস্যরা থাকা সত্ত্বেও কেন জামায়াতে ইসলামী পশ্চিমা দেশগুলোকে এভাবে বিভ্রান্ত করার সুযোগ পাচ্ছে? তার উত্তরে তাকে বলেছিলাম, আসলে তারা বিভ্রান্ত হচ্ছে কিনা, জামায়াত এ সুযোগ সত্যি সত্যি পাচ্ছে কিনা সেটা আমার পুরোপুরি জানা নেই। তবে একটা বিষয় বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার এখানে সিভিল সোসাইটির পরিচয়ে একটি অংশ আছে যারাও আজ সিভিল সোসাইটির অংশ হয়েছে সামরিক সরকারের সহায়তায়। অর্থাৎ তাদের ও জামায়াতের উৎপত্তিস্থল ও বৃদ্ধিস্থল এক। তাই তারাও জামায়াতে ইসলামীর মতো একই কথা বলে। এবং নানা কারণে এরা এখন সমাজে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃত। এরা জামায়াতের মতো অত ক্ষতিকর না হলেও বাংলাদেশের প্রকৃত গণতন্ত্র বিকাশের পথে আরেকটি বাধা। এরাও চায় এক ধরনের সিভিল সোসাইটির শাসন, যা শেষ অবধি জঙ্গীবাদকে সহায়তা করে। কারণ জনগণের দ্বারা সৃষ্ট উদার গণতন্ত্র ছাড়া যে কোন শাসন চালু করলে তা শেষ বিচারে জঙ্গীবাদকে সহায়তা করবে।
swadeshroy@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.