যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে আবার খেলায়

রাজশাহীর প্রতিদ্বন্দ্বী আবদুল মতিনকে ফাইনালে দাঁড়াতেই দিলেন না মিজানুর রহমান। ২০০৬ কলম্বো এসএ গেমসের সোনাজয়ী দাপটেই জিতলেন নিজের ইভেন্টের সোনা।
৮০ কেজি ঊর্ধ্ব ওজন শ্রেণীতে ২০০৪ সালে জাতীয় তায়কোয়ান্দোতে প্রথম সোনা পান। গত বছর খেলতে পারেনি জাতিসংঘ মিশনে যাওয়ায়। এক বছরের মিশন শেষে দেশে ফিরে আবার সেরা হলেন। মঞ্চটা ছিল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের জিমনেসিয়ামে কাল শুরু হওয়া ১২তম ট্রাস্ট ব্যাংক জাতীয় ও জাতীয় জুনিয়র তায়কোয়ান্দোর প্রথম দিন। ঘরোয়া শীর্ষ এই প্রতিযোগিতায় মিজানুর রহমান সোনা জয়ের পাশাপাশি বললেন নিজের প্রত্যাবর্তনের গল্পও।
‘কঙ্গোতে এক বছরের মিশনে সারাক্ষণই একটা আতঙ্ক জড়িয়ে থাকত। এই বুঝি স্থানীয় বিদ্রোহীরা হামলা করে! জীবনটা হাতে নিয়েই বের হতাম। সেনাবাহিনীর সৈনিক জীবনে ভয় পেয়ে পিছু হটার কোনো সুযোগ নেই’—বলতে বলতে নস্টালজিক হয়ে পড়লেন মিজান।
বছরব্যাপী মিশন শেষে দেশে ফিরেছেন গত ১৪ অক্টোবর। কিন্তু ভুলতে পারেন না সেই জীবন, ‘একদিন বিকেলে গেম টাইমে আমরা ভলিবল খেলছিলাম। এমন সময় খবর এল, আমাদের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড আক্রান্ত হয়েছেন বিদ্রোহীদের দ্বারা। দ্রুত সবাই ইউনিফর্ম পরে গোলাবারুদ নিয়ে তৈরি হলাম অপারেশনে যাওয়ার জন্য। একটু পর খবর আসে, পার্শ্ববর্তী একটি ইউএন ক্যাম্প থেকে বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করা হয়েছে। পরে আর আমাদের যেতে হয়নি।’
তবে রাতে ঠিকভাবে নাকি ঘুম হতো না। চারদিক থেকে গুলির শব্দ আসত। সেসব দিন স্মরণ করে মিজান বলেছেন, ‘সে এক অন্য জীবন। কেউ না গেলে বুঝতে পারবে না। কতটা আতঙ্কে কাটে সেখানে। গভীর রাতে গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে যেত। প্রতিটি ঘণ্টা হিসাব করতাম। কবে একটা দিন শেষ হবে। পরিবার-পরিজন ও খেলা ছেড়ে এভাবে ১২টি মাস কাটিয়েছি। দেশ ও খেলা ছেড়ে থাকতে কষ্ট হয়েছে, কিন্তু ওটা ছিল আমার দায়িত্ব। দায়িত্বে অবহেলা করিনি কখনো।’
খেলার মাঠে তিনি দেশসেরা। কিন্তু সৈনিকের পোশাকে কঙ্গোর বিদ্রোহীদের তো আর জানার কথা নয়, এই মিজান বাংলাদেশের একজন সোনাজয়ী খেলোয়াড়। গুলি থেকে নিজেকে বাঁচাতে যাঁর গায়ে থাকত বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, মাথায় হেলমেট, হাতে এসএমজি। দাঙ্গা-হাঙ্গামায় বিধ্বস্ত কঙ্গোতে সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়াই ছিল মূল কাজ। কঙ্গো দুর্ভিক্ষপীড়িত আফ্রিকার একটি দেশ। যুদ্ধের জন্য তাই প্রস্তুত থাকতে হতো সারাক্ষণ, জীবন বাজি রেখে অস্ত্র হাতে টহল দিতে হয়েছে নানা জায়গায়।
সেই মিজান কাল সোনা জেতার পর আপ্লুত, ‘লোকে এখন আমাকে চেনে। জীবনে একটু আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে। সম্প্রতি বিয়ে করেছি। খেলায় ফিরে আবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ পেলাম।’
কাল সোনা জিতেছেন ৬২ কেজি ঊর্ধ্ব শ্রেণীতে আনসারের শ্রাবণী বিশ্বাস, ৬৭ কেজি ঊর্ধ্ব শ্রেণীতে একই দলের শাহনাজ পারভীন। তবে যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে আসা মিজানের সোনা জয়ের মাহাত্ম্যই আলাদা।

No comments

Powered by Blogger.