ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ- অসচেতনতা ম্লান করে দিতে পারে সাফল্য by ওমর কায়সার

সারা দিন ঘরের কাজ করে রান্নাঘরের এক কোনায় ঘুমাতে যায় ছয় বছরের শিশু গৃহকর্মী ইয়াসমিন (ছদ্মনাম)। কিন্তু ঘুম আসে না তার। সারা রাত মশারা তার কানে ভোঁ ভোঁ করে। হুল ফুটিয়ে রক্ত শুষে নেয়। গৃহকর্ত্রীকে বলতেও সাহস হয় না।
এই শহরে ইয়াসমিনের মতো এ রকম অনেক গৃহকর্মীকে মশারি ছাড়া ঘুমাতে হয়। ম্যালেরিয়াসহ মশাবাহিত নানা রোগের ঝুঁকিতে থাকতে হচ্ছে তাদের।
এতো গেল শহরের একটি চিত্র। এবারে গ্রামের একটি চিত্র দেওয়া যাক। পটিয়া থানার হরিণখাইন গ্রাম। মশার উৎপাত থাকে দিনে রাতে। কিন্তু গ্রামের বাসিন্দা সালেহ আহমেদের বাড়িতে কোনো মশারি নেই। সালেহ আহমদের মশারি কেনার সামর্থ্য আছে। কিন্তু নিত্য দিনের কাজের ভিড়ে এই ছোট্ট ব্যাপারটি তাঁর মাথায় থাকে না।
চট্টগ্রামের ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ব্যাপক সফলতা পাওয়া গেছে। কিন্তু মশারি ব্যবহার না করার মতো অসচেতনতা এই সাফল্যকে ম্লান করে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকেরা। পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কর্মসূচিতে স্থবিরতা, পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে কীটনাশকযুক্ত মশারির অপ্রতুলতা ও দুর্বল রোগনির্ণয় ব্যবস্থার কারণেও এই সাফল্য ভেস্তে যেতে পারে।
চট্টগ্রাম জেলার সিভিল সার্জন ডা. আবু তৈয়ব জানান, ম্যালেরিয়া আমাদের নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তার মানে এই নয় যে, মশা নামের প্রাণীটি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মশা যতদিন থাকবে, তত দিন ম্যালেরিয়ার ভয় থাকবে। মশার প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকার ক্ষমতা অনেক বেশি। শরীরের জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে ওষুধকে অকার্যকর করে ফেলতে পারে মশা। তাই চিকিৎসার যত উন্নতি ঘটুক, সরকার যতই সচেষ্ট থাকুক, সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে যদি সচেতনতা না থাকে তবে ম্যালেরিয়াকে জয় করা সম্ভব হবে না।
পটিয়া থানার মনসা গ্রামের বাসিন্দা সিরাজুল হক জানান, এখন শুষ্ক মৌসুম। কদিন পরে ইরি চাষ শুরু হবে। ইরি চাষের সময় সেচের পানিতে বিল ভরে যাবে। তখন মশার উৎপাত বাড়বে। গ্রামের অনেকেই মশারি কেনেন না, কেউ আবার টাকা পয়সার অভাবে কিনতে পারেন না। মশার উৎপাত যখন বাড়ে তখন সরকারের পক্ষ থেকে মশারি বিতরণ করলে সবার উপকার হয়। সিভিল সার্জন দপ্তর সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামের ১৩টি উপজেলায় গত দুই বছরে ম্যালেরিয়ায় একজনেরও মৃত্যু হয়নি। ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যাও কমেছে। ২০১০ সালে মাত্র একজনের মৃত্যু হয়েছে। অথচ এর মাত্র পাঁচ বছর আগে ২০০৫ সালে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ২৭ জন প্রাণ হারিয়েছিল। ২০০৪ সালে ব্র্যাকসহ বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা সরকারের পাশাপাশি ম্যালেরিয়া-বিরোধী কার্যক্রম হাতে নেয়। মূলত এই সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলেই ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে সাফল্য এসেছে। চট্টগ্রামে ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুর রেখাটি গ্রাফে ক্রমে নিচে নামতে শুরু করে ২০০৪ থেকেই। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ সালে ২৫ জন, ২০০৫-এ ২৭ জন, ২০০৬-এ ১৫ জন, ২০০৭-এ সাতজন, ২০০৮-এ তিনজন, ২০০৯-এ একজন এবং ২০১০-এ একজন ম্যালেরিয়ায় মারা যায়। ২০১১ সালে মৃত্যুর হার শূন্যের কোটায় নেমে আসে।
এই পরিসংখ্যান স্বস্তিদায়ক হলেও নিশ্চিন্ত হওয়ার অবকাশ নেই বলে মনে করেন বেসরকারি সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কেননা মশক নিধন ও নির্মূলের ক্ষেত্রে এখনো উদাসীন নগরের কর্তৃপক্ষ ও পৌরসভাগুলো। ১৮৮০ সালে চার্লস লুই আলফোন লাভারেন ম্যালেরিয়ার কারণ শনাক্ত করার আগে যেমন মশা ছিল, তেমনি ১৩০ বছর পরও মশা আছে পৃথিবীতে। অর্থাৎ মশা ছিল এবং থাকবে। আর তাই ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও থেকে যাবে।
সেই আশঙ্কার কথাটিই ফুটে উঠেছে সিভিল সার্জনের মুখে। তিনি বলেন, ‘তিন পার্বত্য জেলাসহ চট্টগ্রামের মানুষ ম্যালেরিয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের এই সাফল্য ধরে রাখতে হবে। ম্যালেরিয়া তাড়াতে শুধু ওষুধ দিয়ে কাজ হবে না। প্রতিরোধের কৌশল জানতে হবে। জনসচেতনতাও বাড়াতে হবে।’

No comments

Powered by Blogger.