চারদিক- ৫০ বছরে আমাদের স্কুল! by সুব্রত ঘোষ

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা শহর সাতক্ষীরার প্রাণকেন্দ্র খুলনা-সাতক্ষীরা সড়কের গা ঘেঁষে সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের অবস্থান। আমাদের প্রিয় বিদ্যালয়টি আজ ৫০টি বসন্ত পার করেছে। ২৮ অক্টোবর আমাদের পুনর্মিলনী।


১৯৬২ থেকে ২০১২। ঠিক ৫০টি বছর। এই সময়ে বিদ্যালয়টি তৈরি করেছে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য মেধাবী মুখ, যাঁরা নিজ গুণে আলোকিত করে চলেছেন আমাদের প্রিয় পৃথিবীটাকে। পৃথিবীর যে প্রান্তেই ছড়িয়ে থাকুন না কেন, তাঁরা গর্ব করে বলতে পারেন, তাঁরা সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র।
একসময় শহরের দক্ষিণ প্রান্তের স্কুল পিএন (প্রাণ নাথ) হাইস্কুলই ছিল শহরের ছাত্রদের একমাত্র ভরসা। তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক এ কে এন সিদ্দিক উল্লাহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আহ্বান করলেন নতুন আরেকটি বিদ্যালয় স্থাপনের কাজ শুরু করার জন্য। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রতিষ্ঠিত হলো সাতক্ষীরা টাউন হাইস্কুল। মধ্যবিত্ত পরিবারের এই উদ্যোক্তাদের আবেগের কমতি না থাকলেও আর্থিক সংগতি তেমন ছিল না। শোনা যায়, অনেকেই তাঁদের স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে কিংবা বন্ধক রেখে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক খরচের টাকা জোগাড় করেন। ১৯৬২ সালের ১ জুলাই থেকে নতুন এই বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে পাঠদান শুরু হয়। গঠন করা হয় বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটি। বিদ্যালয় পরিচালনার প্রথম সাংগঠনিক কমিটি তৈরি হয়েছিল এ রকম—সভাপতি: এ কে এন সিদ্দিক উল্লাহ, মহকুমা প্রশাসক, সাতক্ষীরা ও সম্পাদক: মো. সোলায়মান। সদস্য: আবদুল গফুর এম এন এ, আবদুল আহাদ খান, হায়দার আলী খান, আবুল ওয়ারেস খান, আহম্মদ মিয়া, আরিফ খান ও আবদুল ওহিদ খান। এসব গুণীজনের কেউই আজ আর বেঁচে নেই, তবে বেঁচে আছে তাঁদের অম্লান কীর্তি সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়।
১৯৬২ সালে সাতক্ষীরা টাউন হাইস্কুলে যাঁরা প্রথম শিক্ষক-কর্মচারী হিসেবে যোগদান করেন, তাঁরা হলেন—প্রধান শিক্ষক: শেখ আবদুল করিম, সহকারী শিক্ষক: মো. ইউনুস আলী, মো. মহাতাব মল্লিক, আবদুল আজিজ শেখ, জহুরুল হুদা, মাহবুব হোসেন, আবদুর রহমান, আবদুল হক খান চৌধুরী, অফিস সহকারী: আবদুল কাইয়ুম, পিওন: আবদুল আলিম। বিদ্যালয়ের গর্বিত প্রথম ছাত্রের নাম লিয়াকত আলী খান চৌধুরী (পীয়ারা)। বিদ্যালয়ে কার্যক্রম শুরু করা হয়েছিল প্রধান সড়কের পূর্ব পাশে প্রধান শিক্ষকের বর্তমান বাসভবন এলাকায়, চাঁচের বেড়া আর গোলপাতার ছাউনিবিশিষ্ট শ্রেণীকক্ষে। এই বিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার আলী আহম্মদ। বিদ্যালয়টির মোট জমির পরিমাণ নয় একর ৫৬ শতক। এর মধ্যে সাত একর দুই শতক জমি স্থানীয় বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে আত্তীকরণ করা। অবশিষ্ট দুই একর ৫৪ শতকের মধ্যে ৮৭ শতক জমি দান করেন বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সম্পাদক মো. সোলায়মান। পরিচালনা পর্ষদের সদস্য আহম্মদ মিয়া দান করেন দুই বিঘা জমি। আত্তীকৃত সাত একর দুই শতক জমির টাকা আবদুল গফুর ও এম এন এ (বাটকেখালী) ব্যক্তিগত তহবিল থেকে দান করেন। প্রতি বিঘা জমির দাম ধরা হয়েছিল ৭১৫ টাকা। বিদ্যালয়ের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন শেখ আবদুল করিম। তারপর পর্যায়ক্রমে প্রতাপচন্দ্র (পি সি) পাটওয়ারী, শেখ গহর আলী ও মো. আবুল হোসেন। যাঁদের কাছ থেকে জমি আত্তীকরণ করা হয়, তাঁরা হলেন: ফুটবল মাঠ এলাকা আবদুল আলী দালাল, বর্তমান বিদ্যালয় ভবন এলাকা দীনেশচন্দ্র দত্ত (কর্মকার), বিদ্যালয়ের সম্মুখভাগ অর্থাৎ দক্ষিণ পাশের মাঠ আবেদার রহমান ও আনন্দ।
তৎকালীন সাতক্ষীরা মহকুমার একটি বিদ্যালয় সরকারীকরণের প্রস্তাব এলে পিএন হাইস্কুল ও টাউন হাইস্কুলের মধ্যে এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলতে থাকে। এ সময় টাউন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন মো. আবুল হোসেন। তিনি, তখনকার সহকারী শিক্ষক হাবিবুল হুসাইন ও পরিচালনা পর্ষদের কিছু সদস্যের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৬৮ সালের ১ মে সাতক্ষীরা টাউন হাইস্কুল সরকারীকরণ হয়। ১৯৬৮ সালের এক বছর বিদ্যালয়টি ‘টাউন সরকারি বিদ্যালয়’ নামে চলে। পরে ‘সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়’ নামকরণ করা হয়। বিদ্যালয় সরকারি হলে প্রথম প্রধান শিক্ষক হিসেব যোগ দেন আজিজুর রব। তাঁর পরে আসেন আবদুর রশিদ। এরপর আবার আবুল হোসেন প্রধান শিক্ষক হন। বিদ্যালয়টি সরকারি হলে কোনো শিক্ষক-কর্মচারী চাকরিচ্যুত হননি।
১৯৭১ সালে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানিদের অমানুষিক অত্যাচার, নির্যাতন ও শোষণের বিরুদ্ধে বীর বাঙালি খেপে উঠে ছিনিয়ে নিয়েছিল স্বাধীনতা। দুঃখের বিষয় হলো, আজ পর্যন্ত এই বিদ্যালয়ের পেছনে শহীদদের গণকবর সংরক্ষণ করা হয়নি। নির্মাণ করা হয়নি কোনো স্মৃতিসৌধ। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীতে গণকবরে শায়িত শহীদদের প্রথমবারের মতো স্মরণ করা হয়।
এই বিদ্যালয়ের অসংখ্য ছাত্র-শিক্ষক দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে গিয়ে শহীদ হন বিদ্যালয়ের ছাত্র সিরাজুল ইসলাম।
বন্ধুরা এসো, শত ব্যস্ততা ভুলে একটু সময় করে একে অপরকে স্মরণ করি ২৮ অক্টোবরে। এসো, সবাই মিলে সাতক্ষীরার অবহেলিত-দুঃখী মানুষের জন্য কিছু করি যার যার সাধ্যমতো। এসো, সবাই মিলে আমাদের প্রাণপ্রিয় বিদ্যালয়টির সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবটি সফল করে আমাদের নিজেদের অত্যুজ্জ্বল উপস্থিতি জানান দিই আরও একটিবার।
সুব্রত ঘোষ
subrato_ilika@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.